বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন, ২০১৪


হায় আল্লাহ, তুমি বিচার কইরো’ 19 Jun, 2014 সাতক্ষীরার দেবহাটার নওয়াপাড়া হয়ে নাংলা বাজার। বাজার পার হয়ে হাতের বাঁ দিকে একটি সরু রাস্তা। রাস্তার ওপরে দেখা মিললো ১০-১১ বছরের একটি শিশুর। বাইসাইকেল চালাচ্ছে। চলন্ত মোটরসাইকেল থেকেই জানতে চেয়েছিলাম আনারুলের বাড়ি চেনো। ‘কোন আনারুল, ওই যে মইরে গেছে?’ জানতে চাইল শিশুটি। হ্যাঁ, জবাব পেতেই শিশুটি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলোÑ ‘ওই যে সামনের ইটের রাস্তা দিয়ে মাথায়।’ বাড়ির সামনে যেতেই ভেতর থেকে শোনা গেলো, ‘হায় আল্লাহ তুমি বিচার কইরো।’ বাড়িতে কেউ আছেন জানতে চাইলে সেই মহিলা বেরিয়ে এলেন। জানতে চাইলাম আনারুলের বাড়ি কিনা? মহিলার আবারো দীর্ঘশ্বাস। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, ‘বাবা, আনারুল আমার ছেলে। মাইরে ফেলছে। এখন আমাদের মাইরে ফেলতে চায়। ভয়ে আনারের বাবা এখন বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। কোথায় আছেন জানি না। মাঝে মধ্যে ফোন করে বাড়ির খোঁজখবর নেন। মাছের ঘের, দোকান-পাট সব বন্ধ। প্রতিপক্ষরা ধরে নিয়ে গেছে ঘেরের লাখ লাখ টাকার মাছ।’ এরই মধ্যে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তিন-চারটি শিশু। সাত-আট বছরের একটি শিশুর হাতে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো তীর আর পাটখড়ির ধনুক। দাদীর চোখে পানি দেখে শিশুটি নিজেই বলতে শুরু করে তার বাবাকে কিভাবে মারল। ‘আনারুল আমার বাবা, ঘেরে কাজ করছিল। তখন পুলিশ আর যৌথ বাহিনী এসে আমার বাবাকে ধরতে যায়। বাবা দৌড়ে দু’টি ঘের পার হয়েছিল। তারপরই গুলি করে। বাবার পায়ে লাগে। পড়ে যায় ঘেরের পানিতে। সেখানে পানিতে চুবিয়ে বাবাকে মেরে ফেলে। তুমি কি দেখেছ? জানতে চাইলে শিশুটি বলে, বাবার পায়ে গুলির দাগতো দেখেছি।’ গত ১৩ জানুয়ারি যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত হন আনারুল। তার পিতার নাম আব্দুল হান্নান গাজী। যৌথ পরিবারে দুই ছেলে, স্ত্রী, বাবা-মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে বসবাস করতেন আনারুল। নাংলা বাজারে একটি দ্বীতল ভবন রয়েছে। সেখানে কয়েকটি দোকান আর মাছের ঘের দিয়েই তাদের উপার্জন। ওই ভবনেরই দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে তার অফিস ছিল। আনারুলের স্ত্রী তাসলিমা জানান, ঘটনার দিন ফজরের সময় তিনি বাজার থেকে বাসায় আসেন। ওই দিন তিনি দোকানে ছিলেন। ভোরে বাসায় ফিরে ফজরের নামাজ পড়ে কোদাল নিয়ে ঘেরে চলে যান। সকাল ৯টার দিকে তারা জানতে পারেন তার স্বামীকে যৌথ বাহিনী গুলি করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তিনি ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন। আনারুলকে যখন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে ফেলে তখন তিনি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। দু’টি ঘের অতিক্রম করে তৃতীয়টি পার হওয়ার সময় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাকে ধরে ফেলে। এ সময় আনারুল চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমাকে মারবেন না, আমার দু’টি ছোট্ট ছেলে আছে। আমারে জীবন ভিক্ষা দিন।’ এ কথা শেষ না হতেই গুলির শব্দ। এরপর আনারুলকে ঘেরের পানিতে চুবিয়ে রাখা হয় কিছু সময়ের জন্য। পরে তার নিথর দেহ রাস্তায় নিয়ে আসা হয়। আনারুলের মা খোদেজা বিবি জানান, তার ছেলের কোনো দোষ ছিল না। কোনো অপরাধের সাথে তার ছেলে জড়িত ছিল না। বিনা কারণে তার ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, দীঘির কান্দা হাদিপুর ব্রিজ সংলগ্ন তাদের দু’টি মাছের ঘের আছে। ওই ঘেরের দেখাশুনা ও ব্যবসায় নিয়ে দিন কেটে যেত আনারুলের। ওই রকম সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিল না। এভাবে কেন তার ছেলেকে হত্যা করা হলো তা বুঝতে পারছেন না তিনি। তিনি বলেন, এলাকায় কিছু লোক আছে যারা তাদের শত্রু। তারাই যৌথ বাহিনীকে দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে তার ধারণা। খোদেজা বিবি বলেন, ওই লোকগুলোর নাম তারা জানেন। কিন্তু ভয়ে বলতে পারছেন না। ওই লোকগুলো সার্বক্ষণিক তাদের পাহারা দিয়ে রাখে। মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলেই তাদের হুমকি দিয়ে যায়। এর আগে তারা আনারুল ও তার বাবার নামে মামলাও দিয়েছে বলে খোদেজা বিবি অভিযোগ করেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এ নিয়ে কারো কাছে অভিযোগ করেছেন কিনা। উত্তরে তিনি বলেন, ‘কার কাছে বলব। আমার তো কেউ নেই।’ তিনি বলেন, ‘জোরে কান্নাকাটি করব তারও সুযোগ নেই। ওরা কাঁদতেও নিষেধ করে গেছে। এখন নিরালে বসে কান্দি।’ পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, আনারুল হত্যার পরে তার লাশটি পর্যন্ত আত্মীয়স্বজনদের সবাইকে দেখতে দেয়নি। হাসপাতালে কাউকে যেতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। আনারুলের ছোট্ট ছেলে অহিদুজ্জামান অপু বলেন, বাবার পায়ে গুলির দাগ দেখেছি। বুকেও গুলি লাগতে পারে। বুকটা কাটা ছিল। স্থানীয় সূত্র জানায়, আনারুলকে হত্যার পরে তার বাবা আব্দুল হান্নান গাজীও বাড়িছাড়া। তাকেও এভাবে ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। ঘটনার পর একটি গ্রুপ আনারুলের দোকান ও ভবন দখলের চেষ্টা করে। বাড়িঘর ভাঙচুরের চেষ্টা করে। খোদেজা বিবি বলেন, তখন সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যাই। ছেলের লাশ নিয়ে কাঁদব, তাও পারিনি। এখনো মুখ বুজে ঘরের মধ্যে বসে কাঁদতে হয়। আনারুলের স্ত্রী বলেন, এখন ভয়ে দিন কাটাতে হয়। সব সময় দু’টি ছেলে নিয়ে ভয়ের মধ্যে থাকি। তিনি বলেন, এক সময় তাদের সব ছিল। ঘেরে মাছ ছিল, ব্যবসায় ছিল। এখন অসহায়। কোনোমতে দিন কাটছে তাদের। ঘেরে যে মাছ আছে তা-ই বিক্রি করে কোনোমতে দিন কাটাতে হয়। ছোট ছেলে শহীদুজ্জামান লিপু (২) এখনো বুঝতে শেখেনি বাবা কী। তাসলিমা বলেন, যখন ও বুঝতে শিখবে, বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে তখন আমি কী জবাব দিবো। কান্নায় ভেঙে পড়েন তাসলিমা। আনারুলের পরিবারের সদস্যরা বলেন, এখনো একটি গ্রুপ তাদের নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। চরম ভয়ের মধ্যে তারা দিন যাপন করছেন। খোদেজা বিবি বলেন, এভাবে আর কত দিন। ছেলেকে মেরে ফেলেছে, স্বামী বাড়িছাড়া, ঘরে খাবার নেই, বুক ভাসিয়ে কাঁদব তারও সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এভাবে না করে সবাইকে এক সাথে মেরে ফেললেইতো ভালো। উৎসঃ নয়াদিগন্ত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন