‘গাধা ও ঘোড়ার মিলনে খচ্চর, তেমনি খারেজী ও ওহাবী মিশ্রণে কওমীদের সৃষ্টি’
20 May, 2014
সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনানুযায়ী দেশের কওমী মাদ্রাসাসমূহকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় বিদ্রুপ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বই প্রকাশিত হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকাশিত এ বইতে বলা হয়েছে, কওমী মাদ্রাসাসমূহ জঙ্গি তালেবান সৃষ্টি করে। গাধা ও ঘোড়ার মিলনে যেমন খচ্চর সৃষ্টি হয়, তেমনি খারেজী ও ওহাবী সংমিশ্রণে কওমীদের সৃষ্টি। জামায়াত যেমন ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে অনুরূপভাবে দেওবন্ধী তথা কওমীরাও একই ভূমিকা পালন করে কামিয়াব হয়েছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংরক্ষণেরও কঠোর সমালোচানা করা হয়েছে ঐ বইতে। বইটিতে বলা হয়েছে, সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম স্থাপন করায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার হরণ করা হয়েছে।
বইতে আরো বলা হয়, সংবিধান কোন ধর্ম গ্রন্থ নয়। আর ‘আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ অংশটুকু সংবিধানে অর্ন্তভুর্ক্তির অর্থ হবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপর ’আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ চাপিয়ে দেয়ার নামান্তর। বইতে লেখা হয় মহানবী (স:) থেকে শুরু করে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী সময়েও কোন মুসলিম শাসক কর্তৃক ’আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালা বা সংবিধান প্রণয়নের দৃষ্টান্ত নেই।
তবে বইটির লেখক অধ্যক্ষ মাওলানা কাযী আবুল বয়ান হাশেমী জানিয়েছেন এ ধরনের কথা তার প্রদত্ত পান্ডুলিপিতে ছিল না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোঃ আফজাল নিজ থেকে লিখে বইটি ছাপা’র প্রাক্কালে এ কথাসমূহ সংযোজন করে লেখকের নামে বইটি ছাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়ে পত্র দিয়েছেন। বিগত সংসদে সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংরক্ষণ করেছেন। এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ কিংবা সংবিধান নিয়ে সমালোচনা করার কোন অবকাশ নেই। এরূপ লেখা সংবলিত বইসমূহ ৭ দিনের মধ্যে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানিয়ে ইফা’র ডিজি’র কাছে পত্র দিয়েছেন। প্রয়োজনে তিনি এ ধরনের প্রতারণা ও জালিয়াতি ঘটনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন পূর্বে প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশনা বিভাগ থেকে “শানে রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (অবমাননার পরিণতি ও বিধান)” নামক একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির লেখক হলেন চট্টগ্রামের আহসানুল উলুম জামেয়া গাউছিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা কাযী আবুল বয়ান হাশেমী। বইটির মূল কপির বাইরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ৬ পৃষ্ঠার একটি নতুন অধ্যায় যোগ করা হয়। এতে বিতর্কিত, সংবিধানবিরোধী এবং মনগড়া কতিপয় বক্তব্য ছাপানো হয়।
বইটিতে দেশের কওমী মাদ্রাসা সমূহকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় বিদ্রুপ করা হয়। এর ৩৪ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়, আব্দুল ওহাব নজদীর অনুসারীরা দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ না করে বিশেষ এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে জঙ্গি তালেবান ও সমাজবিচ্যুত গোঁড়া, ধর্মান্ধ আজব কিসিমের মানুষ তৈরি করে। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে এরা খারেজি ও ওহাবী নামে পরিচিত ছিল। গাধা ও ঘোড়ার মিলনে যেমন খচ্চর সৃষ্টি হয়, তেমনি খারেজি ও ওহাবি সংমিশ্রণে এরাই ৮০-র দশক থেকে কওমী নাম ধারণ করে। তারা জানে না যে কুরআন হাদিসে কওম শব্দটি অভিশপ্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে-যেমন কওমে আদ, কওমে লুত, কওমে সামুদ, কওমে নূহ ইত্যাদি।
বির্তকিত এ বইটি’র ৩৫ নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়, বিদেশি দাতা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে টাকা এনে তারা হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, হিজবুত তাহরির ও হেফাজতে ইসলাম সৃষ্টি করে দেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বানাতে চায়। হুন্ডির টাকা হালাল করতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কওমী মাদ্রাসা নির্মাণ করে তা হেফাজতি জঙ্গিদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করছে। বইতে ৩০ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়, জামায়াত যেমন ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে অনুরূপভাবে দেওবন্ধী তথা কওমীরা ও একই ভূমিকা পালন করে কামিয়াব হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইফা’র একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তোলা এবং দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের লক্ষ্যেই উক্ত বইটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
বইটির ৫ম অধ্যায় অর্থাৎ ১৯তম পাতা থেকে ২৪তম পাতা পর্যন্ত” নবী ছাড়া শুধুমাত্র আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস মুসলমানদের ঈমান আক্বীদাহ পরিপন্থী” শিরোনামে ৬ পৃষ্টার একটি অধ্যায় সংযোজন করা হয়। এতে কওমী মাদ্রাসাসমূহকে ওহাবীইজমের ধারক বাহক উল্লেখ করে বলা হয় ওহাবীইজমের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব। তিনি বৃটিশ ও ইহুদীচক্রের চর ছিলেন। বইটিতে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহবকে ভন্ড নবীর দাবীদার মুসায়লামা কাজ্জাবের বংশধর হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বই-এর ২০ তম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে’ সংবিধান কোন ধর্ম গ্রন্থ নয়।’ ২১ তম পৃষ্ঠায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংবিধানে ‘আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ অংশটুকু অর্ন্তভুর্ক্তির অর্থ হবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের উপর ’আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ চাপিয়ে দেয়ার নামান্তর। সংবিধানে এ বিষয়টি রাষ্ট্রপরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ও আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস বাক্য দ্বারা শপথ বাক্য পাঠ ও হলফনামা প্রদান করা বাধ্যতামূলক হবে। একই পাতায় অর্থাৎ ২১ তম পাতার দ্বিতীয় প্যারায় বলা হয় সংবিধানের শুরুতে ’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংরক্ষণ করে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। ২২তম পাতায় লেখা হয়েছে, মহানবী (স.) থেকে শুরু করে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী সময়েও কোন মুসলিম শাসক কর্তৃক ’আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও আস্থা’ অন্তভুক্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালা বা সংবিধান প্রণয়নের দৃষ্টান্ত নেই। বইটির বিষয়ে মন্তব্য করতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন দেশে ধর্মীয় হানাহানী ও মারামারীর পরিবেশ সৃষ্টি করা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের কাজ নয়। সরকারী অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের ধর্মীয় বিভক্তিমূলক কাজ অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
বইটির লেখক অধ্যক্ষ মাওলানা কাযী আবুল বয়ান হাশেমী তার প্রতিবাদ লিপিতে বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংরক্ষণ করেছেন। এ নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ কিংবা সংবিধান নিয়ে সমালোচনা করার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া আমি রাজনীতিবিদ নই। সর্বোপরি এ ধরনের লেখা আমি লিখিনি। আমার জমা দেয়া কপি প্রয়োজনে সম্পাদনা করার অধিকার মহাপরিচালকের রয়েছে। ছাপানোর উপযুক্ত মনে না হলে তা ফেলে দেয়ার অধিকারও তার রয়েছে। কিন্তু আমার লেখা নয় -এরূপ বিষয়কে আমার লেখা হিসেবে ছাপিয়ে দেয়ার অধিকার কারো নেই। এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উৎসঃ ইনকিলাব
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন