ইরাক সংকট: সৌদি বাদশাহর দ্বিমুখী নীতি
19 Jun, 2014
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সুন্নী জিহাদিদের সমর্থনদান বন্ধ করতে সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
সুন্নী যোদ্ধারা, দা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড গ্রেটার সিরিয়া বা আইসিস, ইরাকের উত্তরপশ্চিম অঞ্চল দখল করে নেয়ায় ওই সতর্কবাণী আজ আরো বেশি সময়োপযোগী। তারা শিয়াদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং এখন বাগদাদের শিয়াদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আর মালিকির জন্য এমন বিপর্যয়ের স্বপ্ন বহুদিন থেকেই দেখে আসছিলেন সৌদি বাদশাহ আবদুল্লা্হ। তিনি মালিকিকে ইরানের চামচা মনে করেন এবং এ কারণে বাগদাদে রাষ্ট্রদূত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান।
সহযোগী উপসাগরীয় অন্যান্য দেশ-কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, আরব আমিরাত এবং ওমানকে একই পথ অনুসরণ করতে প্ররোচিত করেন তিনি।
অবশ্য নিজ দেশে তাদেরও আল-কায়েদার বিপদ রয়েছে। বিশেষ করে কুয়েত ও কাতার নিজ নাগরিকদের সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সক্রিয় জাবাত আল-নুসরার মত কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ সহায়তা দেবার বেলায় চোখ বুঝে থাকার নীতি গ্রহণ করেছে।
বর্তমানে মরক্কোতে অবকাশযাপনে থাকা ৯০ বছরের বেশি বয়স্ক বাদশাহ আবদুল্লাহ ইরাকের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত নীরব রয়েছেন।
তবে ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত পরিবর্তন হওয়ায় সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরতে পারেন তিনি। তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন যে সিরিয়ায় আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইরানকে বিপাকে ফেলার তার কৌশল কাজে লাগেনি। এখন ইরাক তার জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে।
এসব ঘটনাপ্রবাহে অনেক পর্যবেক্ষক বিভ্রান্ত হয়েছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কিছু বিপরীতে খবরও পাওয়া যাচ্ছিল।
ইরানের সাথে সৌদি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে কুয়েতের আমির তেহরান সফরে যান। দু’দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের সফর বিনিময়ও হয়।
অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও ছিল। সৌদি আরব প্রথমবারের চীনা ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করে যা তেহরানে আঘাত হানতে সক্ষম। আরব আমিরাত দেশটির যুবকদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
বাদশাহ আবদুল্লাহকে ফেরাতে ওয়াশিংটন প্রচেষ্টা চালালেও তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা। গত ৪ জুন আরব আমিরাতের প্রকৃত শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ সৌদি বাদশার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর মিশরের নতুন প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে বৈঠক করেন।
মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী সিসিকে রিয়াদ ও আবু ধাবি বাড়তি কদর করছে। ইসলামপন্থী এই দলটির সাথে আরবের রাজতান্ত্রিক শাসকদের সম্পর্ক সবসময়ই শীতল ছিল।
এই মুহূর্তে বাদশাহ আবদুল্লাহ, জায়েদ ও সিসিই আরব বিশ্বের প্রধান তিন নেতা। আরব দেশগুলোর ভবিষ্যৎও হয়তো তাদের ওপর নির্ভর করছে।
যারা আরব জাহানের বিভাজন নিয়ে বিভ্রান্ত এবং ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ থিওরিতে বিশ্বাস করছেন আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শিয়া-সুন্নী বিরোধের কথা তাদের মাথায় রাখতে হবে।
ভূরাজনৈতিক সংজ্ঞায় শিয়া-সুন্নীর সেতুবন্ধন তৈরি করেছে ইরাক। দেশটির বেশিরভাগ লোক শিয়া কিন্তু নৃতাত্ত্বিকভাবে আরব। সৌদি আরবের একটি বিভ্রান্তিকর কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নীতি রয়েছে- দেশের বাইরের সুন্নী কট্টরপন্থীদের সমর্থন এবং নিজ দেশে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা। ওসামা বিন লাদেন যখন আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল তখন সৌদি সরকার তাকে সমর্থন দিয়েছে। এছাড়া বসনিয়া, চেচনিয়া ও সিরিয়ার জিহাদিদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব।
দ্রুত পরিবর্তনশীল এই ইরাকি যুদ্ধের বহু মাত্রা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০,০০০ বেসামরিক লোক এখনো ইরাকে কাজ করছেন। ইরানের বিরাগভাজন না হয়েই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ খুঁজছে কাতার। প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে দেশটি বিরুদ্ধে। পাঁচ তালেবান নেতাকে আশ্রয় দিয়ে কাতার বুঝিয়ে দিয়েছে যে শিয়া-সুন্নী বিরোধের তারা কার পক্ষে।
সৌদি আরবের ঐতিহাসিক নজির বলছে তারা যেমন আইসিস যোদ্ধাদের অগ্রযাত্রার সহায়তা করবে তেমনি নিজ দেশে তার বিকাশ চাইবে না। ঊনিশ’ বিশের দশকে বর্তমান সৌদি বাদশাহর পিতা ইবনে সউদ কট্টরপন্থী ইখওয়ান যোদ্ধাদের সহায়তা নিয়ে আরব দখল করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে সাবিলার যুদ্ধ নিয়ে ইখওয়ান সউদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে ইবনে সৌদ ইখওয়ানের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালান।
ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকার এই সংঘাত শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনই কল্পনা করা কঠিন। তবে এই পর্যায়ে শিয়া ইরান ও সুন্নী সৌদি আরবের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তবে সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড সদস্যদের সরাসরি অংশগ্রহনের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়া যায় না।
তবে এটা স্পষ্ট যে সিরিয়ার গ্রহযুদ্ধের সাথে যোগ হবে ইরাকের গৃহযুদ্ধ। আইসিসের কল্পিত ভূখন্ডের একটি নাম রয়েছে – আল-শামস খেলাফত।
মার্কিন ফরেন পলিসি সাময়িকীতে প্রকাশিত The Battle for Iraq Is a Saudi War on Iran নিবন্ধ (সংক্ষেপিত)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন