বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন, ২০১৪


ওবামার এশিয়া নীতির মুখ থুবড়ানো পরিণতি-১ 19 Jun, 2014 পুর্ব চীন সাগরে চীন ও জাপানের দ্বন্দ্ব আর দক্ষিণ চীন সাগরে পড়শিদের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব এশিয়ায় এক বড় ইস্যু। এর ভিতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলী এন্টি-চীন অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও জাপান দেশ দুটি সফর করে এলেন। বলা বাহুল্য, চীন-জাপান দ্বন্দ্বের মধ্যে আমরা কারও কোন শর্ত বা লোভে পরে কারও পক্ষ না নিয়ে একমাত্র নিজের স্বার্থের মধ্যে থেকে দুদেশের সাথেই ভারসাম্যপুর্ণ সম্পর্ক গড়াই একমাত্র সঠিক অবস্থান। কুটনৈতিক ভাষায় যাকে ব্যালেন্সিং বলা হয়। এশিয়া ভারকেন্দ্রিক গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন পরিস্থিতিতে ছোট বা বড় কোন শক্তির দ্বন্দ্বে শুধু বাংলাদেশ তো অবশ্যই (এবং সম্ভবত সকল রাষ্ট্রই) নিজস্ব স্বার্থমুখি একটা ব্যালেন্সিং অবস্থানে থেকে কূটনৈতিক দক্ষতা দেখানোর যুগে আমরা সবাই প্রবেশ করেছি। অর্থাৎ পুরানা রাশিয়া-আমেরিকার ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ের ব্লকে ভাগ অবস্থান নেয়া একালে ঘটতে দেখা যাবে না। অথবা একালে চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কহীন ভারত ও আমেরিকার কোন জোট অথবা আমেরিকার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কহীন ভারত ও চীনের জোট এমনটা দেখতে পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। এমন অবস্থা আর ফিরে আসছে না। পরস্পরের সবার সাথে সবার অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক থাকবেই। এটা থাকার পরেও স্বার্থের সংঘাত বিরোধগুলোও চলতে থাকবে। গ্লোবাল অর্থনীতির নতুন বিন্যাস এই নব উত্থানের সময়ের বার্তা এটাই। তবু সব রাষ্ট্রের ব্যালেন্সিং অবস্থানের মধ্যে মোটা দাগে কেবল একটাই ভাগ জ্বলজ্বলে দৃশ্যমানভাবে ভেসে থাকবে। এই ভাগের ভিত্তি হবে – কে কে পুরানো ভঙ্গুর গ্লোবাল অর্ডার ধরে রাখার পক্ষে আর কে কে নতুন অর্ডার কায়েম করতে চায়। পুরানো গ্লোবাল অর্ডার মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আমেরিকার নেতৃত্ত্বে জাতিসংঘ, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক, ডব্লিউটিও ইত্যাদি বিভিন্ন নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যা কায়েম করা হয়েছিল এবং বাকি দুনিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে টিকে আসছে, বর্তমানে শেষ জীবন পার করছে সেই গ্লোবাল অর্ডার। মাতব্বরির এই নিয়ম-শৃঙ্খলার নামে এই অর্ডার ভাঙ্গা গড়ার এই লড়াই এখনকার মুখ্য বিষয় যা প্রবলভাবে হাজির ও ক্রমে স্পষ্ট থেকে ষ্পষ্টতর হয়ে উঠছে। বলার অপেক্ষা রাখে না পুরানা অর্ডারের যাতায় পড়ে বাংলাদেশের মত যারা এত যুগ নিগৃহীত হয়ে আসছে তারা এই ভাঙ্গাগড়া থেকে, আলগা দুর্বল হয়ে পড়া পরিস্থিতি থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব তুলনামূলক মুক্ত করার চেষ্টা করা, আর বুদ্ধিমানের মত এথেকে সর্বোচ্চ সুবিধা বের করে নিবার চেষ্টা করা – এটা যে যত আগে বুঝবে, হোমওয়ার্ক করে সে প্রস্তুতি নেয়ায় এখনকার কাজ। তবে একটা সাবধানবানী খেয়াল রাখা দরকার পুরানা অর্ডার আর নতুন অর্ডার বলে যে ভাগের কথা বললাম এর মানে এমন নয় যে যারা পুরানোর পক্ষে তাদের সাথে যারা নতুনের পক্ষে এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন বিনিময় নির্ভরশীলতা এগুলো ছিন্ন করে নিয়ে তা করতে হবে। সম্পর্ক বজায় রেখেই সে সম্পর্কের ভিতর এক নতুন বিন্যাস বা সাজানো, নতুন ভারসাম্য তৈরির প্রক্রিয়া হিসাবে ঘটবে এটা। ফলে জবরদস্তিতে সম্পর্ক ছিন্ন করে আগাতে হবে এমন করে আমরা যেন না ভেবে বসি। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরে নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যপদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা জাপানের পক্ষে ছেড়ে দেয়া ও ভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আসলে কি হাসিল করতে চেয়েছেন কি পেয়েছেন তা আমরা এখনও স্পষ্ট কিছু জানি না। যদিও বিশাল অংকের ঋণের প্রতিশ্রুতির কথা আমরা শুনছি। অপরদিকে চীন সফরে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রসঙ্গে সমঝোতা চুক্তির বিষয়টা ঝুলে গেছে তা বুঝা যাচ্ছে। পদ্মা সেতুতে কোন বিদেশী বিনিয়োগ থাকছে না এটা এখন পরিস্কার। কেবল নির্মাণ ঠিকাদার হিসাবে এবং একমাত্র ঠিকাদার হিসাবে চীনা কোম্পানীর কথা শুনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটা কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যদিও নিজের অর্থে সেতু নির্মাণের একটা সোজা অর্থ হল, ১% এর নিচের সুদের জায়গায় আমাদেরকে এখন কমপক্ষে ১২% সুদের অর্থে এই সেতু নির্মাণ দায় নিতে হচ্ছে। এতে শেষ চাপটা গিয়ে পড়বে সেতু পারাপারের টোলের অর্থে। প্রতি পারাপারে টোলের অর্থ কত দাঁড়াবে সেটার অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটি কি হবে, থাকবে কি না এনিয়ে কোন ষ্টাডি কোথাও হয়েছে আমরা জানতে পারি নাই। কারণ সেতু নির্মাণ বিষয়টা এখন যেভাবে দাড়িয়েছে এর মূল বিবেচ্য অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটি নয়, বরং সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ইজ্জত বাঁচানো। ওদিকে চীন সফরে যে পাঁচটি চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে এগুলোরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিবেচনা কতটুকু তা আমরা জানতে আগ্রহী, জানা দরকারও। হাসিনার জাপান ও চীন সফরে যা কিছু বিনিয়োগ চুক্তি হচ্ছে তা সরকারের ন্যায্যতার পক্ষে স্বীকৃতি ও পলিটিক্যাল লিভারেজ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা থাকবে বলা বাহুল্য। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে এটাকে বাংলাদেশের সাথে তাদের চুক্তি হিসাবে বুঝলে সঠিক হবে। ইতোমধ্যেই এটাকে সরকারের পলিটিক্যাল লিভারেজ বা স্বীকৃতি হিসাবে মিডিয়া প্রচার হতে দেখেছি আমরা। তবে আগেই বলা যায় এতে কোনভাবেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বৈধতার সঙ্কট কাটাবে না। ২. পরাশক্তিগত ঝগড়া বিবাদ এমনকি যুদ্ধ দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। নতুন হল, যারা পরাশক্তি হয়ে ছিল বা আছে তাদের সাইজ ছোট হয়ে আগের গুরুত্ত্ব হারাবে আর নতুন অনেকের পরাশক্তিগত উত্থান ঘটবে – এবিষয়গুলো ক্রমশ আসন্ন হয়ে উঠছে। আলামত ফুটে উঠছে চারদিকে। আর এসব উলটাপালটের ভিতরে আবার যেটা একবারেই নতুন এবং যেদিকটায় আমাদের অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে তা হল, পরাশক্তিগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক। এখনকার দুনিয়াতে হবুসহ পুরানো পরাশক্তিগুলো সকলে গভীরভাবে অর্থনীতি, বাণিজ্য, লেনদেন ইত্যদিতে এক পরস্পর নির্ভরশীলতার সম্পর্কে ক্রমশ সবাই ডুবে যাচ্ছে এবং তা আরও গভীর হতে থাকবে। থাকতেই হবে, কারণ কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছা পছন্দ-অপছন্দের উর্ধে এ এক অবজেকটিভিটি বা বাস্তবতা। দুনিয়া জুড়ে একক গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম আরও প্রবলভাবে বিস্তারি হয়ে উঠছে, পরাশক্তিসহ সকল রাষ্ট্র বা অর্থনীতিকে যা ধরে রেখেছে, সকলেই সেখানে অন্তর্ভুক্ত। পরস্পর নির্ভরশীলতার এই সম্পর্কের দিকটাই একেবারেই নতুন। এখানে কেন্দ্রীয় বিষয় “পরস্পর নির্ভরশীলতা” এবং গ্লোবাল একটা ক্যাপিটালিজম অর্ডার। এর আগের ল্যান্ডমার্ক সময় হিসাবে যদি দুটো বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে রাখি, যখন আজকের চলমান অর্ডারের জন্ম হয়েছিল সে সময়গুলোতেও “পরস্পর নির্ভরশীলতার” এমন বাস্তবতা হাজির ছিল না। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পঞ্চাশের দশক থেকে আমেরিকা-সোভিয়েত ঠান্ডাযুদ্ধের রেষারেষির কালে দুনিয়ায় প্রথম পরিকল্পিতভাবে যে দুটা আলাদা আলাদা (পরস্পর নির্ভরশীলতাহীন ভাবে) অর্থনীতির ধারা তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল, তাও টিকে নাই। বদলে যাওয়া ১৯৭১ সাল থেকে চীনের নতুন ধারা এবং ১৯৯১ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে পড়ার ভিতর দিয়ে সে উদ্যোগের সমাপ্তি ঘটেছে। তারচেয়েও বড় কথা সেটাও আর ফিরে আসছে না, আসবে না। বরং আগামিতেও “পরস্পর নির্ভরশীলতা” দুনিয়ায় মুখ্য হয়ে থাকছে। আর নতুন এই দিকটাতে আমাদের অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এমন প্রশ্ন আমাদের অনেকের মনে আছে যেমন, চীনের বদলে যাওয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে পড়া কি ভাল হয়েছে? এমনভাবে বা এমনদিক থেকে প্রশ্ন করে যেন আজকের আগামি ব্যাপারটাকে আমরা বুঝতে না যাই। কারণ এটা উচিত-অনুচিত অথবা ভাল-খারাপের প্রশ্ন নয়। আবার দুনিয়াব্যাপী শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব আকারে দুনিয়াকে বুঝতে যাওয়া কি ভুল ছিল? না একেবারেই তা নয়। ক্যাপিটালিজমের ভিতরে অনেকেরই দুনিয়ার এম্পেয়ারের ভুমিকায় হাজির হওয়া, কমিউনিষ্টরা যেটাকে “সাম্রাজ্যবাদ” শব্দ দিয়ে ধরে ব্যাখ্যা করতে চায় তা এখনও আগের মতই সমান বিপদজনক শত্রু হয়ে আছে। ফলে এদিক থেকে বুঝার মধ্যে আমাদের কোন ভুল নাই। কারণ লড়াই সংগ্রামের মৌলিক বিষয় একই আছে। তাহলে ঘটল কি? আসলে ঘটেছে যা তা হলঃ কোর্স বা গতিপথে বদল। অথবা বলা যায় লড়াই সংগ্রামের মূল বিষয় বা নীতি নয় কৌশলে বদল। যেমন, আগে মনে করা হয়েছিল লড়াইটা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এম্পেরিয়াল প্রকাশের বিরুদ্ধে আলাদা প্যারালাল এক গ্লোবাল (“কমিউনিষ্ট”) অর্থনীতি কায়েম করে লড়াটাই উপযুক্ত ও সঠিক কৌশল। কিন্তু সেটা খুব কার্যকর হয় নাই, কাজের হয় নাই। আকাঙ্খিত ফল দেয় নাই। ফল দেয় নাই এই অর্থে যে এটা শত্রু পরাস্ত হওয়ার দিক থেকে যত না তারচেয়ে বেশি হল নিজেরই অর্থনৈতিক বিকাশ, নিজের জনগণকে ভাল অর্থনীতিক জীবন দেয়া, কাজের সংস্থান ইত্যাদি করা যায়নি। আসলে একাজে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম থেকে আলাদা ও প্যারালাল অর্থনীতি কায়েমের চেষ্টা, এটা অনেকটা পুরানা আগে থেকে হাজির ক্লাবে যোগ দিয়ে তাদের সাথে খেলব না, আলাদা নিজেই ক্লাব বানিয়ে নিজের নিয়মে খেলা এধরণের ঘটনা ছিল সেটা। আর আজকের নতুন পরিস্থিতিতে যা হতে দেখছি, চলতি ক্রমশ পরাশক্তিগত উলটপালট নতুন বিন্যাস পরিবর্তনের ভিতর যে অভিমুখ এখানে নতুন কৌশলটা হল, পুরানা ক্লাবে যোগ দিয়ে তাদের সাথে খেলতে খেলতেই ক্লাবের কর্তৃত্ত্বে ভাগ বসিয়ে আগের খেলার নিয়ম বদলে দেয়া। একথা বলে আবার এমন দাবি করা নয় যে কৌশলের এই বদলটা খুব ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা করে নেয়া হয়েছে। বরং আগের কোর্স বা পথ কাজ করে নাই বা ফলদায়ক হচ্ছিল না বলে সেই পরিস্থিতিতে বাস্তবে বিকল্প কি করা যায় সে বিবেচনা থেকে নেয়া। এর পিছনে তত্ত্বগত স্বচ্ছতা ছিল কি ছিল না বা আছে কিনা আমরা হদিস পাই না। ফলে কথাগুলো বলা হচ্ছে নতুন আসন্ন অবজেকটিভ বাস্তবতাকে যেমন দেখা যাচ্ছে এর অর্থ তাতপর্যের দিককে ব্যাখ্যা করে। তাহলে যেকথা বলছিলাম আসন্ন বা পুরানা পরাশক্তিগুলোর নতুন বিন্যাস এবং গুরুত্বপুর্ণ বিষয় তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক –সেটা গভীর পরস্পর নির্ভরশীলতার এক সম্পর্ক। কিন্তু গভীর পরস্পর নির্ভরশীলতা সম্পর্ক পরাশক্তিগত বিন্যাস নতুন আকার নিচ্ছে একথা বলার অর্থ এমন নয় যে আগের মত পরাশক্তিগত ঝগড়া বিবাদ প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন উবে গেছে। বরং সবলভাবে বহাল আছে। সর্বশেষ ইউক্রেন প্রসঙ্গে পরিস্থিতি ও এর গতিপ্রকৃতির দিকে নজর দিলেই আমরা তা বুঝব। এবং এটা কোনভাবেই আগের ঠান্ডাযুদ্ধের কালের লড়াই এর মত নয়। সেটা আর ফিরে আসবে না। উপরের এই পটভুমিতে এবারের লেখার প্রসঙ্গ “সাউথ চায়না সি বা দক্ষিণ চীন সাগর”। গৌতম দাস: রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক উৎসঃ অনলাইন বাংলা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন