তুরস্ক সফর >> ইসলামী সংগঠনের কংগ্রেসে যা দেখলাম
19 Jun, 2014
নূরুল আমিন
তুরস্কের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গবেষণা কেন্দ্রের আমন্ত্রণে মে মাসের ২৮ থেকে জুন মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত তুরস্ক সফরে ছিলাম। সফরকালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম কমিউনিটিজ-এর ২৩তম কংগ্রেস, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের দ্বাদশ জেনারেল অ্যাসেম্বলী এবং মুসলিম ইউথ কালচারাল কো-অপারেশন-এর ৯ম আন্তার্জাতিক সম্মেলন ছাড়াও কোজাইলী স্টেডিয়ামে আয়োজিত কনস্টানটিনোপল (ইস্তাম্বুল) বিজয়ের ৫৬১তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগদান করার আমার সুযোগ হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম কমিউনিটিজ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে মুসলিম মিল্লাতের একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২৩ বছর আগে তুরস্কের মিল্লি গুরুজ তথা সাদাত পার্টির প্রধান এবং দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ড. নাজমুদ্দিন আরবাকান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সত্য, ন্যায় ও ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের আলোকে একটি নতুন পৃথিবী গঠন ছিল এর মূল লক্ষ্য। মুসলিম মিল্লাতকে পর্যায়ক্রমে ঐক্যবদ্ধ করা এবং একটি ইসলামী কমন মার্কেট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার উদ্যোগে উ-৮ নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে তার অনন্য কীর্তি।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম কমিউনিটিজ-এর এই বছরের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল এষড়নধষ ঞযৎবধঃং অহফ ওংষধসরপ ডড়ৎষফ. সারা বিশ্বের ৭৫টি দেশের ১৮৫ জন প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে মুসলিম দেশ ও তাদের প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫০ ও ১২০। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ইসলামী আন্দোলন, সিভিল সোসাইটি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং ইসলামী বিশ্বের খ্যাতনামা প-িতবর্গ।
এই সম্মেলনটি ব্যক্তিগতভাবে শুধু আমি নই অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিনিধিকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছে। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত এত নেতাকর্মী দুনিয়ায় একনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন এবং ঝড়ঝাপ্টা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলছেন তাদের একসাথে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সম্মেলনের কার্যকরী অধিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে চা ও কফি বিরতি ও খাবার টেবিল এবং অধিবেশন শেষে কক্ষে কক্ষে গিয়ে পরস্পর পরস্পরের সাথে মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় ইস্তাম্বুলের এয়ারপোর্ট এলাকার হোটেল হলিডে ইনকে এক মহামিলন মেলায় পরিণত করেছিল। এই মিলনমেলা সাদা-কালোর ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়েছিল। আলোচনা ও অধিবেশন চলাকালে কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি এবং বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সমস্যাবলী আলোচনা ও তার বিশ্লেষণ বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল যে, মুসলিম জাতি এক ও অভিন্ন। তার অবস্থান পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন।
আগেই বলেছি, সারা বিশ্বের মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রতিনিধিরা এতে অংশগ্রহণ করেছেন। একটি বিষয় আমাকে অভিভূত করেছে এবং সেটি হচ্ছে জামায়াত নামের ডজন খানেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের এতে অংশগ্রহণ। লেবানন, কাশ্মীর, সেনেগাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল প্রভৃতি দেশের জামায়াত নেতারা এতে সরব ভূমিকা পালন করেছেন। জর্দান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, জার্মানী ও কসোভোর জামায়াত প্রতিনিধিরাও এতে অংশগ্রহণ করেছেন। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের জামায়াত নামক প্রতিনিধিসমূহের মূল নাম জামায়াতে ইসলামিয়া। কিন্তু এদের কার্যক্রমের সাথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দেশের ইসলামী আন্দোলনসমূহের যথেষ্ট মিল রয়েছে। ২৩তম কংগ্রেসটি শুরু হয়েছে ২৯ মে এবং শেষ হয়েছে ৩১ মে। এটি উদ্বোধন করেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক গবেষণা কেন্দ্রের প্রেসিডেন্ট এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং সাবেক আইন প্রণেতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান বিশেষজ্ঞ জনাব রেজাঈ কুতান এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন তুরস্ক সরকারের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ড. এমরুল্লাহ ইজলাহ, সাদাত পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. মুস্তফা কামালাখ, উ-৮ সেক্রেটারি জেনারেল ড. সাইয়েদ আলী মুসাভী। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা মাহমুদ হোসেন। পাকিস্তান জামায়াতের নায়েবে আমীর হাফিজ মোহাম্মদ ইদ্রিস এবং তাজিকিস্তানের নাহদা পার্টির প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন কাবেরীসহ বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের খ্যাতনামা নেতৃবৃন্দ। তারা তাদের বক্তৃতায় বর্তমান সময়কে মুসলিম মিল্লাতের জন্য কঠিন পরীক্ষার সময় বলে উল্লেখ করে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষাকে আঁকড়িয়ে ধরার পরামর্শ দেন এবং মুসলিম ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বের মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকেন এবং পরস্পর পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এবং ইসলামের শিক্ষা থেকে যদি বিচ্যুত না হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে জাহেলী শক্তির মোকাবিলা করেন তাহলে দুনিয়ার কোনো শক্তি তাদের অগ্রাভিযানকে রোধ করতে পারবে না।
বৈশ্বিক উপনিবেশবাদ উন্নয়ন ও ইসলামী বিশ্ব, ইসলামী বিশ্বের রাজনৈতিক স্থিতিহীনতার কারণ ও ব্যাপকতা, ইসলামী বিশ্বের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিশীলতা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় ইসলামী মতামতের প্রতিনিধিত্বের পন্থা, বিশ্ব শান্তি ও ইসলামিক ঐক্য, সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে নতুন বিশ্বের পুনর্গঠন এবং ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ তৈরিÑ এই ৭টি বিষয়ের উপর সমগ্র কংগ্রেসটি সাতটি অধিবেশনে বিভক্ত ছিল। এতে বক্তব্য পেশ, প্রবন্ধ উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর আলোচনা অনুষ্ঠান এবং সুপারিশমালা পেশ করা হয়। ষষ্ঠ অধিবেশনে ‘এষড়নধষ ঞযৎবধঃ, ওংষধস ধহফ ঞযব উঁঃরবং ড়ভ ঃযব টসসধয’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ আমি পেশ করেছি। প্রবন্ধে আমি মানবতার প্রতি প্রকৃত হুমকিসমূহ সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি এবং যারা প্রকৃতি হুমকিসমূহকে পাশ কাটিয়ে হুমকির নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করে মানবিক মূল্যবোধ ও তাদের আদর্শ এবং লাখ লাখ মানুষের আবাসভূমি ধ্বংস করে বিশ্বব্যাপী নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে এবং মানুষকে পশুতে পরিণত করে তাদের চিহ্নিত করার প্রয়াস চালিয়েছি। এতে ইসলামকে যারা সন্ত্রাসের প্রতিভূ বলে মনে করে বিশেষ করে পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক শক্তিগুলোর মুখোশ উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে মুসলিম বিশ্বের সামনে বিদ্যমান বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ বিশেষ করে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, মুসলিম শাসকদের ইসলামবিরোধিতা ও দুর্নীতি, মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী শিক্ষার প্রতি উপেক্ষা ও রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা, ঐক্যের অভাব, পরিচিতি সমস্যা এবং ইসলামের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন শিক্ষা পদ্ধতি, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বব্যাপী সক্রিয় ইসলামী আন্দোলনসমূহের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাব, গণমাধ্যমের উপর মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং ইহুদি মুশরিক ও খৃস্টান অপশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন গণমাধ্যমের ইসলাম বিদ্বেষ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব শক্তিসমূহের ইসলাম বিরোধিতা, মুসলিম দেশসমূহের অনৈক্য, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, মুসলিম সামজে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিতকরণ এবং সংখ্যালঘু ইস্যু ও শিক্ষার ইসলামীকরণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনের জন্য উম্মাহর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
হেড ফোনে অধিবেশনসমূহের কার্যবিবরণী আরবী, ইংরেজি ও তুর্কি ভাষায় শোনার সুযোগ থাকলেও আরবী ভাষায় আমাদের দীনতা আমাকে নিদারুণভাবে পীড়িত করেছে। এ ব্যাপারে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান আমাদের চেয়ে অনেক এগি গেছে। কংগ্রেসের সমাপ্তি অধিবেশনে শান্তি ও সংহতি কামনা করে সমগ্র মানবতার জন্য সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক নতুন বিশ্ব গঠনের আহ্বান জানিয়ে ইস্তাম্বুল ঘোষণা ২০১৪ গৃহীত হয়। এতে ইসলামী ঐক্যের পথে বিরাজমান বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাধাসমূহ দূর করা এবং ইসলামী দেশসমূহের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ওপর যে জেল-জুলুম নির্যাতন চলছে এবং মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে তাদের ফাঁসির দ- দেয়া হচ্ছে, তা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিসর, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ইরাক, আরাকান, পূর্ব তুর্কিস্থান, লিবিয়া, সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মারি, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, চেচনিয়া ও ক্রিমিয়ার মুসলমানদের ওপর পাশ্চাত্য শক্তির অনুপ্রেরণায় যে নির্যাতন চলছে তার নিন্দা করা হয় এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো ছাড়াও ইসলামী আন্দোলনে নিয়োজিত বিশ্বের সকল ইসলামী সংস্থা ও রাজনৈতিক দলসমূহকে ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা এবং নির্যাতিতদের সকল প্রকার আর্থিক ও নৈতিক সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়। ৩১ মে পূর্বাহ্নে ইস্তাম্বুল ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক ছাত্র ফেডারেশন এবং যুব ফোরামের জেনারেল অ্যাসেম্বলি শুরু হয়। এতে বিশ্বনেতৃত্বে ছাত্র ও যুব সমাজের ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং বলা হয় যে, অবনতিশীল এই বিশ্বে শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা আনার প্রধান দায়িত্ব যুবকদের। কেননা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে বৃদ্ধরা গতায়ু, শিশুরা অনাগত এবং যুবকরা হচ্ছে বর্তমানের কা-ারি। তাদের সামনে দুটি বিকল্প রয়েছে। একটি হচ্ছে পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয়া এবং অন্যটি পরিবর্তন অনুযায়ী চলা ও গা ভাসিয়ে দেয়া। মুসলিম যুবকদের অবশ্যই প্রথম বিকল্পটি গ্রহণ করতে হবে। কেননা কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যই তাদের জন্ম হয়েছে। ছাত্র, কংগ্রেস ও যুব সম্মেলন পয়লা জুন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ৩১ তারিখ দুপুরে বসফরাস ট্যুর ও লাঞ্চের পর কোজাইনী স্টেডিয়ামে ইস্তাম্বুল বিজয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম।
কোজাইলী শহরটি ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ। এই অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তুরস্কের আপামর জনসাধারণের সামনে ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। এখানে রোমান ও বাইজেলটাইন সাম্রাজ্যকে কীভাবে মুসলিম নৌ ও পদাতিক বাহিনী খান খান করে দিয়েছিল তার একটি খ-চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং যুব সমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ৫৬১ বছর আগে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিজয়ী সেনাবাহিনীর সামনে শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস যে কুরআন ও সুন্নাহ ছিল, তা এখনো অবিকৃত অবস্থায় তাদের সামনে রয়েছে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা আজো বিশ্বের বিজয়ী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। কোজাইলী স্টেডিয়ামের গ্যালারি ও মাঠ এই দিন ছিল লোকে-লোকারণ্য। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছাত্র, যুবক। সংখ্যা ছিল অন্যূন ১০ লাখ। এই যুবকদের মধ্যে ইসলামী জাগরণের যে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা ও আবেগ আমি দেখেছি, তা ছিল অভূতপূর্ব, ইসলামী ঐতিহ্য ও সভ্যতার সংস্কৃতির প্রতি তুর্কিদের বন্ধন ও প্রীতি ভালোবাসা ও পুনরুদ্ধারের জযবা ভোলার মতো নয়। তাদের মধ্যে জাগরণের যে জোয়ার আমি দেখেছি, তা রোধ করা সহজ নয়। তবে একটি বিষয় আমি মানতে পারিনি, তা হচ্ছে নামাযের সময় বিরতি ছাড়া অনুষ্ঠান অব্যাহত রাখা। এই সময়ে বিরতি দেয়া হলে সকলে একসাথে অথবা ভাগাভাগি করে স্টেডিয়ামেই নামায পড়তে পারতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। যে যার মতো করেই দর্শকরা নামায পড়েছেন। অনুষ্ঠান রাত আড়াইটা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। তার সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার ফলে এমন এক সময় এসেছিল, যখন জানাযার নামায পড়ানো এবং এমনকি মসজিদে ওয়াক্তিয়া নামাযে ইমামতি করার জন্য আলেমের অভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেই তুরস্ক নেই। তুরস্কের মসজিদগুলো এখন খুলে গেছে। প্রত্যেকটি মসজিদে পুরুষ এবং মহিলা নামাযীদের জন্য নামায পড়ার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আছে। সর্বত্র ব্যাপক কুরআন-হাদীস চর্চা হচ্ছে। হিজাবধারী মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে, পাশাপাশি আবার বেপর্দা স্বল্প বসনা নারীদেরও দেখা যায়। কিন্তু কেউ তাদের টিজ করে না। রাস্তাঘাটে মানুষের নিরাপত্তা বিঘিœত হয় না।
তুর্কিরা এখন নিজেদের মুসলিম পরিচয়ে শুধু গর্বিতই নয়, তারা দুনিয়ার সকল প্রান্তের মুসলমানদেও অত্যন্ত আপন করে নেয়। যে দেশেই মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে, তুর্কিরা সে দেশেই নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। লাখ লাখ সিরীয়, ফিলিস্তিনী, সোমালীয়, ইরাকী, কুর্দি উদ্বাস্তু এখন তুরস্কের মেহমানদারীতে আছে। তুরস্ক তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। তুর্কি সরকার এবং জনগণের এটি একটি বড় উদারতা। এই বিষয়টির প্রশংসা না করে পারা যায় না। খ্যাতনামা লেখক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ আমি পড়েছি। আমার বিশ্বাস, তিনি জীবিত থাকলে এই পত্রের কাঠামো আজকের তুরস্কের আলোকে তিনি হয়তো পরিবর্তন করতেন।
তুরস্কের আরেকটি বিষয় আমাকে বিমোহিত করেছে। উন্নয়ন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির ধারা আমি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অধিকাংশ দেশেই উন্নয়নের ইউনিফরমিটি প্রত্যক্ষ করিনি। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, ডেনমার্ক প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশ এবং চীন, জাপানসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে। প্রায় সর্বত্রই উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু না কিছু বৈষম্য আমি দেখেছি। কিন্তু তুরস্কের বেলায় তা খুব একটা আমার নজরে পড়েনি। ইস্তাম্বুল আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন শহর। তার উন্নয়ন অবকাঠামো অতুলনীয়। এবার বাসে আঙ্কারাসহ কয়েকটি ছোট ছোট শহরেও আমি গিয়েছি। কিন্তু সর্বত্র উন্নয়নের যে ইউনিফরমিটি আমি দেখেছি, তা অতুলনীয়। ছবির মতো একটি দেশ এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন একে পার্টি তুরস্কের অগ্রগতির অনুঘটক হিসেবে যে ভূমিকা পালন করছে আমার মনে হয়েছে, তা অতুলনীয়। এ উন্নয়নই মানুষের কাম্য। অবশ্য তুরস্কের এই উন্নয়ন ধারা ও ইসলামী পুনরুত্থানকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা যে নেই, তা নয়। বিরোধীরা বসে নেই। প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের জীবননাশের প্রচেষ্টা ১৭ বার ব্যর্থ হয়েছে। বারান্তে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার আশা রাখছি, ইনশাআল্লাহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন