কী ঘটেছিল শেষ ৪ ঘণ্টায়?
02 May, 2014
ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী সাদ ইবনে মমতাজ হত্যায় নানা প্রশ্ন নিয়ে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ নানা শ্রেণীর ও পেশার মানুষ। কী ঘটেছিল সাদ হত্যাকাণ্ডের শেষ চার ঘণ্টা?
হাসপাতালের ময়নাতদন্তকারী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত সাদ হত্যার রহস্যকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠেছে-মমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাদকে কারা সেদিন বাইরের ট্রমা সেন্টারে নিয়ে গেল? কেনই বা সেদিন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল? কেনইবা ট্রমা সেন্টার কর্তৃপক্ষ সাদকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে চার ঘণ্টা তাদের সেন্টারে রেখে দিল?
এছাড়াও সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে সাদের বড় ভাই মোয়াজ ইবনে মমতাজের সঙ্গে কথা বলে সাদ এবং তার চিকিৎসা হচ্ছে এবং ভালো লাগছে একথা জানালেও পরবর্তীতে এক ঘণ্টায় কী হয়েছিল যে সাদকে মরতে হলো। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকে। সাদকে আশরাফুল হক হলের ভেতর কক্ষে আটকে সহপাঠীদের নির্যাতন ও পরে উদ্ধার করা থেকে থেকে শুরু করে মমেক হাসপাতালে ভর্তি এবং হাসপাতালের বাইরে নিয়ে ট্রমা সেন্টারে ফেলে রাখা পর্যন্ত প্রতিটি পদে পদে ছিল সংশ্লিষ্টদের চরম গাফিলতির ছাপ। অথচ সাদ হত্যায় জড়িত ছয় জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও হত্যা নিশ্চিতকারীদের এখনো বের করা যাচ্ছে না।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর প্রায় ৯ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন ছিল সাদ। আর হাসপাতালের বাইরে ট্রমা সেন্টারে পড়েছিল প্রায় ৪ ঘণ্টা। পুলিশ এই ট্রমা সেন্টার থেকেই বেলা ১১টায় সাদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায়। হাসপাতালে ৯ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন সাদ অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রমা সেন্টারে এমন কী ঘটল যে সাদকে লাশ হয়ে বের হতে হল? প্রশ্ন সহপাঠীদের।
ঘটনার পর থেকে ট্রমা সেন্টারের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আনোয়ারসহ অনেকে নিয়মিত আসছেন না বলে জানান ট্রমার চিকিৎসক ডা. মতিউর রহমান। নিজেও পারিবারিক অসুবিধার জন্য ছুটি নেয়ার কথা জানান তিনি। তবে সাদ হত্যা নিয়ে কোনো মন্তব্য কিংবা বক্তব্য দিতে অপরাগতার কথা জানান তিনি।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক এএনএম আল মামুন জানান, নির্যাতনে সাদের লিভার ফেটে ভেতরে মারাত্মক রক্তক্ষরণসহ মস্তিষ্কে রক্তক্ষণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে তার। মাথার পেছনেও ছোট্ট আঘাতের চিহ্ন ছিল।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লিভার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. চিত্ত রঞ্জন দেবনাথ জানান, নির্যাতনে লিভার ফেটে রক্তক্ষরণসহ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাদের মৃত্য হবার কথা। এছাড়া বমি, অজ্ঞান হওয়াসহ পালস ও রক্তচাপ দ্রুত কমে খারাপের দিকে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাওয়ার কথা। এই ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর প্রায় ৯ ঘণ্টায় তার এরকম কোনো লক্ষণ না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এর আগে হলের ভেতর নির্যাতনের পর উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে আসা পর্যন্ত সাদ আরও কয়েকঘণ্টা পার করেছিল। ওই সময়েও তার অবস্থা স্বাভাবিক ছিল বলেই দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ কেয়ার সেন্টারের চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদের।
ভোর ৬টার পর হাসপাতাল থেকে বের করে বাইরের ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার পর সাদ মারা যায় বেলা ১১টায়। ট্রমা সেন্টারের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা.আনোয়ারের দাবি এ সময় সাদকে ট্রমা সেন্টারের নীচতলার মেঝেতে রেখে স্যালাইন ও অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়েছিল।
সকাল ৭টার পর সাদকে ট্রমা কর্তৃপক্ষ মেঝেতে দেখতে পান। এই হিসেবে ৪ ঘণ্টা সাদ সেখানে পড়েছিল।
ট্রমা কর্তৃপক্ষ জানায়, ভোরের দিকে কয়েকজন যুবক জোরপূর্বক সাদকে ট্রমা সেন্টারে রেখে চলে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, সাদকে এই ৪ ঘণ্টা ট্রমাতে না রেখে মাত্র ৫০ মিটার দূরের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়নি কেন? জবাবে ট্রমা কর্তৃপক্ষ জানায়, সাদের সঙ্গে কেউ না থাকায় এটি সম্ভব হয়নি। ময়মনসিংহ মেডিকেলে ৯ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন সাদের কিছু না হলেও মাত্র ৪ ঘণ্টায় ট্রমা সেন্টারের ভেতরে এমন কী ঘটল যে সাদকে লাশ হয়ে বের হতে হল? প্রশ্ন সাদের সহপাঠী ও শিক্ষকসহ সকলের।
ট্রমার ভেতরের ঘটনা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ছাত্রলীগের সভাপতি মোর্শেদুজ্জামান খান বাবু। ছাত্রলীগের এই নেতার দাবি, ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে বিরোধে নিয়ে সাদকে পেটালেও তার আঘাত গুরুতর কিংবা আশঙ্কাজনক ছিল না। হল থেকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর ভোর ৬টা পর্যন্ত হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ছবিতে সাদকে অনেকটাই সুস্থ্য ও স্বাভাবিক দেখা গেছে বলে জানান তিনি।
অভিযোগ করে এই ছাত্রলীগ নেতা জানান, পরিকল্পিতভাবে হত্যার জন্যই খুনীচক্র সাদকে কৌশলে হাসপাতাল থেকে বাইরের ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যায়। এ সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সিসি ক্যামেরা বন্ধ থাকার বিষয়টিকেও রহস্যজনক বলে মনে করছেন এই ছাত্রলীগ নেতা।
সিসি ক্যামেরা ফুটেজ:
মমেক হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার রেকর্ড করা ছবিতে দেখা গেছে গত ৩১ মার্চ রাত সাড়ে ৯টার দিকে চার যুবক হাসপাতালের ট্রলিতে করে সাদকে নিয়ে আসে হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সার্জারি ইউনিট ৩ এ। এ সময় সাদকে মাথা তুলে পানি খেতে দেখা গেছে। রাতের খাবারও খেয়েছেন বলে জানিয়েছে কর্তব্যরত ডাক্তার। ট্রলিতে শুয়ে থাকা সাদকে একটি পা ভাজ করে রাখতে দেখা যায় ছবিতে। সঙ্গে আসা পরিচিত যুবকদের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা গেছে। ভোরে সাদ তার বাবা মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও বড় ভাই মোয়াজ ইবনে মমতাজের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন।
তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার কথা দাবি করে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফসিউর রহমান এনডিসি জানান, ভর্তির পর থেকে ভোর পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার ছবিতে সাদকে অনেকটাই সুস্থ্য ও স্বাভাবিক দেখা যায়। এ সময় সাদের অবস্থা মোটেও আশঙ্কাজনক মনে হয়নি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ কেয়ারের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, সহপাঠীরা তাকে আশরাফুল হক হলে ডেকে নিয়ে যায়। বলা হয় একজন ব্যথা পেয়েছে, ব্যথানাশক ইনজেকশন ‘ক্লোফেনাক’ নিয়ে যেতে হবে। ডা. আজাদ ব্যথানাশক ক্লোফেনাক নিয়ে হলে যান সাদকে দেখতে। এ সময় সাদের হাত ও পায়ে নির্যাতনের চিহ্ন দেখে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ইস্যু করে দেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আশরাফুল হক হল থেকে সাদকে নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
হেলথ কেয়ার সেন্টারের চিকিৎসকের দাবি এ সময় সাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক মনে হয়নি। তারপরও উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানোর পরার্মশ ছিল তার। তবে তিনি কোনো ব্যথানাশক ইনজেকশন দেননি সাদকে।
হাসপাতালে ভর্তির পর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া এবং পরদিন পহেলা এপ্রিল ভোরে ওয়ার্ড থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সব ছবি হাসপাতালের সিসি ক্যামেরায় থাকলেও জরুরি বিভাগ থেকে ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তের কোনো ছবি নেই সিসি ক্যামেরার রেকর্ডে। কারণ ওই সময়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ক্যামেরা ছিল বন্ধ। ফলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অপেক্ষমান হোন্ডারোহী কিংবা রিকশায় করে ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যাওয়া যুবকদের চেনা যায়নি।
ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় জানায়, ওই যুবকরা ট্রলিতে করেই সাদকে ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ওয়ার্ডবয় রাজি না হওয়ায় প্রথমে হোন্ডায় তুলতে চায়, পরে রিকশায় করে সাদকে নিয়ে যান তারা।
হাসপাতালে ভর্তির পর সাদের এক্সরে ও সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ ছিল হাসপাতাল চিকিৎসকদের। ভোর ৬টার দিকে এক্সরে করার কথা বলেই সাদকে হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী পুলিশ কেস কিংবা ভর্তির পর কোনো রোগীকে হাসপাতাল থেকে বাইরে পরীক্ষার জন্য নিতে হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকের অনুমতি নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে কোনো রকম অনুমতি কিংবা বাধা বিঘ্ন ছাড়াই ৯ ঘণ্টা চিকিৎসাধীন থাকার পর সাদকে হাসপাতালের বাইরে ট্রমা সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে সাদকে বাইরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে হাসপাতালে রোগীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ভর্তির পর থেকে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সাদের পাশে ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক কিংবা হল প্রশাসনের কেউ।
এর আগে আশরাফুল হক হলের ২০৫ নম্বর কক্ষে সাদকে আটকে রেখে এবং কার্পেট দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় রড ও ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পেটানো হয়।
হলের প্রত্যক্ষদর্শী কর্মচারীরা জানায়, কর্তব্যরত কর্মচারীর কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে একদল ছাত্রকে নীচতলার আলমিরা খুলে ক্রিকেট খেলার ব্যাট ও স্ট্যাম্প নিয়ে দু’তলার ২০৫ নম্বর কক্ষের দিকে যেতে দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, ক্লাস প্রতিনিধি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ৩১ মার্চ সোমবার ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে বাকৃবির মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ও আশরাফুল হক হল ছাত্রলীগ শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ ইবনে মোমতাজকে ছাত্রলীগের অপর গ্রুপ নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করে। পরদিন পহেলা এপ্রিল শহরের চরপাড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সাদ মারা যায়।
সাদ হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগের ৬ কর্মীর মধ্যে ৩ জনকে আজীবন, ২ জনকে ৪ বছর এবং ১ জনকে ২ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। গত ৯ এপ্রিল সকাল ১০টায় প্রশাসন ভবনে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উৎসঃ বাংলামেইল২৪ডটকম
Share on facebook Share on email Share on print
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন