ভোজ্যতেলের ৮৭ শতাংশই ভেজাল!
06 May, 2014
বিগত দুই দশকে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় দেশীয় ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেলের জোগান বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৮-২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ চাহিদার বিপরীতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দুই থেকে চার লাখ টন ভোজ্যতেল। ফলে চাহিদার প্রায় পুরোটাই মিটছে আমদানির মাধ্যমে। আর আমদানি করা বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেলেই ভেজালের ব্যাপকতা রয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) পরীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে বিক্রি হওয়া ভোজ্যতেলের ৮৭ শতাংশই ভেজাল। এসব ভোজ্যতেলে এসিটিক এসিডের মাত্রা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভোজ্যতেল ও তেলবীজ আমদানি ছিল ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকার। পরের দুই অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩৩৬ কোটি ও ১৪ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আমদানি কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) প্রথম প্রান্তিকেই আমদানি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা।
এদিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সম্প্রতি মান যাচাইয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে ৪০০টি সয়াবিন তেলের নমুনা সংগ্রহ করে। এসব তেল পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় করার পর ৩৪৯টি অর্থাৎ ৮৭ দশমিক ২৫ শতাংশ নমুনায় ভেজাল শনাক্ত হয়। এর মধ্যে মাত্র ৫১টি বা ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ নমুনায় সব উপাদান সঠিক মাত্রায় পাওয়া যায়। বাকি নমুনায় এসিটিক এসিডের মাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সাধারণত ভোজ্যতেলে উপাদানটি এক শতাংশের নিচে থাকতে হয়। আইপিএইচের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ভোজ্যতেল, বিশেষ করে সয়াবিন তেলে এ ধরনের ভেজালের কারণে মানবদেহে শক্তির জোগান ও টিস্যু গঠন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আর তেলে বিদ্যমান এসিটিক এসিডের অতিরিক্ত মাত্রা হার্টের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগও হতে পারে। এছাড়া মানহীন ভোজ্যতেল হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিসসহ শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরির পরীক্ষক ও মান বিশ্লেষক আইয়ূব খান বলেন, সয়াবিন তেলের মান পরীক্ষা করে উচ্চমাত্রার ভেজাল পাওয়া গেছে। এসব সয়াবিন তেলের মধ্যে পাম বা নিুমানের তেল মিশ্রণের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া পরীক্ষায় অধিকাংশ কোম্পানির তেলে এসিডের মাত্রা বেশি রয়েছে। যেসব নমুনায় উপাদানগুলো সঠিক অনুপাতে পাওয়া যায়নি, সেগুলোকেই ভেজাল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) তথ্যানুযায়ী, সঠিক মানের সয়াবিন তেল নির্ণয় করতে তেলের রং, এসিড ও আয়োডিন ভ্যালু, রেজিস্টিভ ইনডেক্স ও মেল্টিং পয়েন্ট পরীক্ষা করা হয়। যেসব তেল সঠিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরিশোধন করা হয়, সেগুলোয় এসিড ভ্যালু কম থাকে। যেগুলোয় এসিড ভ্যালু বেশি থাকে, সেগুলো পরিশোধন ছাড়াই বা স্বল্প পরিশোধনে বাজারজাত করা হয়।
অন্যদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (এফএও), গ্লোবাল ফোরাম ফর নিউট্রিশন ও আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৩০ শতাংশ আসা উচিত ভোজ্যতেল থেকে। অথচ বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ তো দূরের কথা, ক্যালরির সামান্যই আসছে ভোজ্যতেল থেকে। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু বার্ষিক ভোজ্যতেল ব্যবহারের হিসাবে দৈনিক প্রাপ্ত ক্যালরির মাত্র ৯ শতাংশের উৎস ভোজ্যতেল। অত্যবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড, যা মানবদেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়, তারও উৎস হতে পারে ভোজ্যতেল। কিন্তু অতিমাত্রায় ভেজালের কারণে কাক্সিক্ষত মাত্রায় মিলছে না এসব। উল্টো স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও বিএসটিআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলা বলেন, ভেজাল ও মানহীন ভোজ্যতেলের নিয়মিত ব্যবহার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। স্বল্প মেয়াদে বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, খাবারে অরুচি ও হৃদপিণ্ডের ক্ষত সৃষ্টি করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে হৃদপিণ্ড, যকৃৎ ও ফুসফুসও আক্রান্ত হতে পারে। কারণ ভোজ্যতেলে এসিটিক এসিডের মাত্রা বেশি হলে টক্সিসিটি বেড়ে যায়। তাই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ার আগেই ভেজাল রোধে নজরদারি বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি দোষীদের শাস্তির বিধানও আরো কঠোর করতে হবে।
উৎসঃ মানবকন্ঠ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন