সাতজনের সঙ্গে ফেলা হয় আরো চার লাশ তাদের অপরাধ ছিল 'দেখে ফেলা'
08 May, 2014
নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত জনের লাশের সঙ্গে সেদিন আরো চারটি লাশও ফেলা হয় শীতলক্ষ্যায়। এই শেষের চার জনের 'অপরাধ', তারা সাত জনের লাশ নদীতে ফেলার দৃশ্য দেখে ফেলেছেন। তাই এই চারজনকে হত্যা করে লাশ একই স্থানে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
নূর হোসেনেরই এক ঘনিষ্ট ক্যাডার কিলিং মিশনে অংশ নিয়ে তার আরেক বন্ধুর কাছে এসব তথ্য ফাঁস করে। পুলিশও তথ্যটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে শীতলক্ষ্যার যে যে স্থান থেকে সাত লাশ উদ্ধার হয়েছে সেখানে আরো অনুসন্ধানের পরিকল্পনা নিয়েছে।
মিশনে অংশ নেয়া কিলারের বন্ধুটির তথ্যমতে, লাশ সাতটি খুনিরা দুটি নৌকাযোগে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর সংযোগস্থলে নেয়। পরে লাশের সঙ্গে ইট বেঁধে নদীতে ছেড়ে দেয়া হয়। আর এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই দুই নৌকার মাঝির কপালেও জোটে একই পরিণতি। তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করে লাশ ফেলা দেয়া হয় একই স্থানে। পাশেই মাছ ধরছিল এমন দুই ব্যক্তি এই ঘটনা দেখে ফেলায় তাদেরও ধরে খুন করে লাশ নদীতে ডুবিয়ে দেয় খুনিরা।
এদিকে সাত হত্যাকাণ্ড তদন্তে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। নিহতদের স্বজনরা দাবি করেছেন, নূর হোসেনের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া পুলিশ সদস্যরা এখন এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে তদন্ত করছেন।
শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর সংযোগস্থলে আগেও ফেলা হয়েছে লাশ : শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর সংযোগস্থলটি লাশ ফেলার ডাম্পিং পয়েন্ট হিসেবে পুলিশ ও আশেপাশে জেলার বাসিন্দাদের কাছে পরিচিত। একমাস আগেও সেখান থেকে পুলিশ হাদিস আলী নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে। তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। হাদিস আলী পেশাদার সন্ত্রাসী ও কিলার ছিলেন বলে জানিয়েছেন মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি। এরও দুই মাস আগে অজ্ঞাত ৪ ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় সেখানে, যাদের পরিচয় আজও মেলেনি।
গতকালও দুই লাশ উদ্ধার নারায়ণগঞ্জে :এদিকে গতকাল বুধবার কাঁচপুর ব্রিজের কাছে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ও ফতুল্লার কাছে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে আরেক জনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এদের একজনের পরনে ছিল প্যান্ট, অপরজনের লুঙ্গি। এদের বয়স ৩০-৩৫ এর মধ্যে। পুলিশের ধারণা, ৯-১০ দিন আগে তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
নিহতদের স্বজনরা ক্ষুব্ধ :ঘটনার সঙ্গে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ করে আসছিল নিহতেরা স্বজনরা তারা এখনও নারায়ণগঞ্জ পুলিশ প্রশাসনে কাজ করছেন। কাউন্সিলর নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার ওসিসহ একডজন কর্মকর্তা নূর হোসেনের কাছে প্রতিদিন ঘুষ নিত। সাত হত্যা মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ জেলার ডিবির ইন্সপেক্টর আব্দুল আউয়াল এলাকায় পরিচিত নূর হোসেনের টোল কালেক্টর হিসেবে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই থাকাকালে তিনি নূর হোসেনর পক্ষে চাঁদা তুলতেন।
নিহতদের স্বজনেরা অভিযোগ করেন, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানা থেকে ঢাকা রেঞ্জসহ পুলিশের শীর্ষ প্রশাসন নির্ধারিত উেকাচ পেয়ে থাকেন। নারায়ণগঞ্জের দুই গ্রুপের নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ঐ সকল ঘুষখোর পুলিশ কর্মকর্তারা। হত্যা মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটির অভিযোগ এ ঘুষখোর পুলিশ সদস্যরা প্রধান আসামি নূর হোসেনের সোর্স হিসেবে এখন দায়িত্ব পালন করছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পালিয়ে যেতে এই পুলিশ সদস্যরা সহযোগিতা করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন খন্দকার বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ঐ সকল পুলিশ কর্মকর্তাদের নারায়ণগঞ্জে ঠাঁই নেই। তাদেরকে পরিবর্তন করার পাশাপাশি আরও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এখনো গ্রেফতার নেই
হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে কার্যক্রম চলছে বলে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার দাবি করলেও এখন পর্যন্ত মামলার কোন আসামিই গ্রেফতার হয়নি। আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার ছেলে ও র্যাব-১১-এর এক কর্মকর্তার মধ্যে টাকা লেনদেন হয়েছে বলে স্বজনরা গতকাল অভিযোগ করেছেন। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, অভিযুক্ত কোন পুলিশ সদস্যকেই রেহাই দেয়া হবে না। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
দল থেকেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি
হত্যা মামলার সাত আসামি আওয়ামী ও যুবলীগের স্থানীয় নেতা। অথচ তাদের বিরুদ্ধে গতকাল পর্যন্ত দল থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আসামি ইয়াছিন ও রাজু সিঙ্গাপুরে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা
হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়া ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম রাজু বর্তমানে সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন বলে অভিযোগ করেছেন নজরুলের শ্বশুর। তিনি অভিযোগ করেন, সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা ২ আসামি তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জের এক কাউন্সিলর সিঙ্গাপুরে বিয়ে করেছেন। তার শ্বশুর বাড়িতে এই ২ আসামি আশ্রয় নিয়েছে। সিঙ্গাপুরে তাদের সহায়তায় ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
নূর হোসেন বাহিনীর আরো ৩ অস্ত্র উদ্ধার
নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের নামে নেয়া ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স সোমবার বাতিল ঘোষণার পর গতকাল আরো ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে গত দুই দিনে নূর হোসেন বাহিনীর মোট ৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা হলো।
উৎসঃ ইত্তেফাক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন