বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০১৪


যে কারণে খুন নজরুল 09 May, 2014 নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডার। দিন-দুপুরে ৭ জন মানুষকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যার ঘটনা সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। কেন এই হত্যাকা-? ঘাতকদের টার্গেট কে ছিল? কাউন্সিলর নজরুল? তাহলে বাকিদের হত্যা করা হলো কেন? নিহত আইনজীবীর কি দোষ ছিল? নিরপরাধ ওই ব্যক্তি ও তার চালককেও কেন হত্যা করা হলো? এদিকে নিজের জীবন যে কোন সময় বিপন্ন হতে পারে এই আশঙ্কা করে নজরুল অপহরণের এক সপ্তাহ আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং অপহরণের আগে তার নেতা শামীম ওসমানের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেননি। শামীম ওসমান এখন বলছেন, এই হত্যাকা-ের জন্য সরাসরি নূর হোসেন দায়ী। তাহলে তিনি কেন দুজনকে বিরোধ মিটিয়ে এক করে দিলেন না? তারা দুজনই তো তার লোক ছিলেন। নজরুল ২৪ বছর আর নুর হোসেন ১৫ বছর ধরে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে আছেন। এখন নজরুল খুন আর নূর হোসেন খুনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে লাপাত্তা। এতে কার লাভ হয়েছে? এ প্রশ্নগুলোও আলোচিত হচ্ছে এলাকায়। একই সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকা- নিয়ে। নানামুখী অদৃশ্য মহলের চাপ উপেক্ষা করে র‌্যাব-১১ ত্বকী হত্যার রহস্য উদঘাটন ও আলোচিত টর্চার সেল আবিষ্কার করে। চার্জশিট সম্পন্ন হলেও আদালতে সেই চার্জশিট দাখিল প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়ার আশঙ্কা করে র‌্যাব মিডিয়ার মাধ্যমে ওই চার্জশিট প্রকাশ করে দেয়। চার্জশিটে ত্বকী হত্যাকা-ের সঙ্গে ওসমান পরিবার (আজমিরী ওসমান) জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কিন্তু ত্বকী হত্যাকা- নিয়ে কাজ করা র‌্যাব-১১’র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে সেভেন মার্ডারের অভিযোগ উঠেছে। নজরুলকে হত্যার পেছনে অনেক বিষয় আর স্থানীয় বিরোধ কাজ করেছে। তার কিছু ছিল রাজনৈতিক এবং স্থানীয় প্রভাব প্রতিপত্তিকে ঘিরে। নজরুল-হোসেন বিরোধ নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেন দুজনই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। নজরুল ২ ও নূর হোসেন ৪নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বিরোধ। একে অপরকে মেরে ফেলার চেষ্টাও কম ছিল না। ১৯৯৮ সনে নজরুল বাহিনীর করা ৩টি গুলি বিদ্ধ হয়েও বেঁচে যায় নূর হোসেন। আবার নূর হোসেন বাহিনীর হামলা ও হত্যা চেষ্টার ভয়ে অপহরণের ২ মাস আগে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন নজরুল। মজার বিষয় হলো চরম বিরোধের মধ্যে মাঝে একবার বরফ গলে তাদের ক্ষোভের। ২০১২ সালে পহেলা বৈশাখে নজরুল তার এলাকায় আয়োজিত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেন নূর হোসেনকে। নূর হোসেন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পর সিদ্ধিরগঞ্জবাসী কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু এই স্বস্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নানা বিষয় নিয়ে আবার দুজনে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এলাকাবাসীর তথ্যমতে, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর দুজনই স্ব স্ব এলাকায় ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে। গত ২ বছরে নূর হোসেন তার নিজের নামে ২টিসহ ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়। বহু আগ থেকেই নজরুলের লাইসেন্স করা পিস্তল ছিল। গত ৪ মাস ধরে তাদের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ১লা ফেব্রুয়ারি ২নং ওয়ার্ডে একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ নিয়ে নূর হোসেনের খালাতো ভাই মোবারক আলীর সঙ্গে নজরুল ইসলামের তর্ক হয়। নূর হোসেনের কাছে খবর যায় নজরুল তার ভাইকে মারধর করেছে। নূর হোসেন বাহিনী নজরুলের এলাকায় হানা দেয়। মারামারি ভাঙচুরের এক পর্যায়ে নজরুল পিছু হটেন। ওইদিন গভীর রাতে মোবারক আলীর ছেলে বাদী হয়ে নজরুলকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করে। পুলিশি গ্রেপ্তার ও নূর হোসেন বাহিনীর হামলার ভয়ে অনেকটা আত্মগোপনে চলে যান নজরুল। অভিযোগ রয়েছে, র‌্যাব-১১ এর সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে নূর হোসেন ও নজরুল দুজনেরই সম্পর্ক তৈরি হয়। নজরুল-শামীম ওসমান দূরত্ব ৯০ দশকে শামীম ওসমানের হাত ধরে নজরুল ইসলামের ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু হয়। সেই থেকে ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যন্ত নজরুল ইসলাম শামীম ওসমানের আস্থাভাজন কর্মী হিসেবেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সিটি নির্বাচনে শামীম ওসমান আইভীর কাছে পরাজিত হলে ছাত্রলীগ নেতা জিএম আরাফাতের মাধ্যমে আইভীর কাছাকাছি চলে যান নজরুল ইসলাম। এক সময় শামীম ওসমানের শিবির থেকে বেরিয়ে পড়েন নজরুল। প্রায় ২ বছর শামীম ওসমানের কাছ থেকে দূরে থাকেন। এই দূরত্বে এককভাবে শামীম ওসমানের কাছে জায়গা করে নেয় নূর হোসেন। নূর হোসেন হয়ে উঠে শামীম ওসমানের সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন। নজরুল যাতে কখনও আর শামীম ওসমানের কাছে ভিড়তে না পারে এজন্য তৎপর থাকে নূর হোসেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কিন্তু গত ৭-৮ মাস আগে নজরুল আবার শামীম ওসমানের শিবিরে ভেড়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণে নজরুলকে সরাসরি কাছে নেননি শামীম ওসমান। র‌্যাবের হাতে একবার আটক হন নজরুল ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কয়েকদিন আগে র‌্যাব-১০ এর একটি টিম মিজিমিজি থেকে নজরুল ইসলামকে আটক করে ঢাকার ধলপুর তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরে নারায়ণগঞ্জের এক এমপি দীর্ঘসময় তদবির চালিয়ে নজরুলকে ১০ ঘণ্টা পর মুক্ত করে নিয়ে আসেন। নজরুলের শ্বশুরের অভিযোগ, নজরুলের সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপির এক নেতা র‌্যাবকে এক কোটি টাকা দিয়ে নজরুলকে ধরিয়েছে। দেড় কোটি টাকার জমির বিরোধ নিহত কাউন্সিলর নজরুলের সঙ্গে দেড় কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল নজরুলের বড় ভাই নূর মোহাম্মদ ও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াসিন মিয়ার। সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক পচা সাবান কারখানার পশ্চিম পার্শ্বের ৭০ শতাংশ জমি নিয়ে এ বিরোধ শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর থেকে। খর্দঘোষপাড়া মৌজায় সিএস ও এস এ দাগ নং ৫২৬ ও ৫২৭ এবং আর এস ৫৬৫, ৫৬৮ ও ৫৬৯ নং দাগে এই সম্পত্তি। এই জমিটির মালিকানা নিয়ে বিরোধ চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। নজরুল ইসলাম ওই জমিটি তার সহযোগীদের নামে কিনতে চেয়েছিল। অপরদিকে নজরুলের বড় ভাই নূর মোহাম্মদ ও হাজী ইয়াসিন মিয়াও জমিটি কিনতে মাঠে নামে। একপর্যায়ে নজরুল তার সহযোগীদের নামে মূল মালিককে বাদ দিয়ে বায়নাপত্র দলিল করে দখল নিয়ে নেয়। এ নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত। জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার হাজী পিয়ার আলী গত বছরের ১৬ই নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইদ্রিস আলীসহ নজরুলের ১৭ সহযোগীর বিরুদ্ধে জাল দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে সম্পত্তি আত্মসাতের একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১২। মামলার বাদী মিজমিজি পশ্চিম পাড়া এলাকার মৃত আলেক বেপারীর ছেলে পিয়ার আলী নুর মোহাম্মদ ও হাজী ইয়াসিন মিয়ার ঘনিষ্ঠজন। বাদী তার এজাহারে উল্লেখ করেন, তারা ৪ ভাইবোন পৈতৃক ওয়ারিশ সূত্রে ওই জমির মালিক হয়ে ভোগ দখল করে আসছেন। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ করে ২০০১৩ সালের ৭ই আগস্টের আগে বিভিন্ন সময়ে সম্পত্তিটির ভুয়া ও জাল খাজনার রশিদ, আর এস পর্চাসহ অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করে বায়নানামা দলিল রেজিস্ট্রি করিয়া নেয়। এই বায়নানামা দলিল সৃজন করার পর আসামিরা ওই জমিটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করে। ওই জমিটি নিয়েই নজরুলের সঙ্গে তার বড় ভাই নূর মোহাম্মদ ও হাজী ইয়াসিন মিয়ার বিরোধ চরমে উঠে। ২৭শে এপ্রিল দুপুরে নজরুল অপহরণ হলেও প্রথম ও দ্বিতীয় দিন নূর মোহাম্মদকে আন্দোলনে দেখা যায়নি বলে স্থানীয়রা জানায়। উৎসঃ মানবজমিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন