বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০১৪


খুনিদের রক্ষায় মরিয়া প্রভাবশালীরা
ইনকিলাব রিপোর্ট : প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী নূর হোসেন আড়ালের চেষ্টা চলছে। সেই সাথে খুনিদের রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী একটি মহল। নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, নজরুল ইসলামকে হত্যার পরিকল্পনা দু’মাস আগেই নেয়া হয়েছিল। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে দিপু চৌধুরী এবং তার মেয়ের জামাই লে. কর্নেল তারেককে যুক্ত করা হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে লে. কর্নেল তারেকসহ তিন সামরিক কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। এর ফলে এই হত্যাকান্ড নিয়ে গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এসব সামরিক কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হলেও সামরিক আইনে তাদের বিচার আর হচ্ছে না। অন্যদিকে, নজরুলের শ্বশুর...আরো কেউ থাকতে পারেন বলে দাবি করেছেন। তার জামাতা হত্যাকান্ডের সাথে অবসরে পাঠানো তিন সামরিক কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে এবং তারা যে টাকার মাধ্যমে এই বর্বরোচিত হত্যাকা- ঘটিয়েছে এটি তাদের ব্যাংক একাউন্ট দেখলেই পাওয়া যাবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে ব্যর্থ করে দিতে একটি চক্র উঠে পড়ে লেগেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও দীর্ঘ ১১ দিনে নূর হোসেন গ্রেফতার না হওয়া এবং অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা লেঃ কর্নেল তারেক সাঈদসহ ৩জনের বিচার সামরিক আইনে না হওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থের যোগানদাতা নূর হোসেনসহ র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা না হলে সঠিক তদন্ত বা বিচার হবে না বলে মনে করছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ৭জন অপহরণ ও খুনের ঘটনার পর জেলার ডিসি মনোজকান্তি বড়ালকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলামকে প্্রাইজ পোস্টিং দিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) বদলি করা হয়েছে। এমনকি নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি, ফতুল্লার ওসি ও নারায়ণগঞ্জ ডিবির ওসির মাধ্যমে তার সব অপকর্ম বৈধ করতে তারা এখনও বহাল তবিয়তে। র‌্যাব ও পুলিশ প্রশাসনের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের স্বপদে বহাল বা প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে তদন্ত করলে তদন্ত নিরপেক্ষ হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে সরকার যাদের বেতন দিয়ে পোষে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠায় তদন্ত আরো স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। ৭ জনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় র‌্যাব-১১ এর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগসহ সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করতে হাইকোর্টের আদেশে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া গত রাতে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমার ছেলে দিপু চৌধুৃরী গত ৫ বছরেও নারায়ণগঞ্জ গেছে কিনা সন্দেহ আছে। এটি আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে ও আমার পরিবারকে হেয় করার জন্য এসব বলা হচ্ছে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সত্য ঘটনা বেরিয়ে আসবে। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সরকার যা করবে ত্ াআমি সমর্থন করি। এ ষড়যন্ত্র একদিন প্রকাশ হবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, র‌্যাবের ভেতরে যে সকল অসাধু ব্যক্তি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা নারায়ণগঞ্জ জেলায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় আনা হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্তে তাদের অবহেলা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত যে বাহিনী তারাই আজ জীবন রক্ষার বদলে জীবন হরণ করছে। এই অবস্থায় এলিট ফোর্স নামে এ বাহিনী রাখার প্রয়োজন আছে কি-না তা ভাবার সময় এসেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলের দিপু চৌধুরীর হাত রয়েছে। এই হত্যাকা-ে র‌্যাবের সঙ্গে টাকা লেনদেন দীপু চৌধুরীই করেছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার খোকন চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনায় দীপু চৌধুরীসহ চাকরিচ্যুত র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের দাবি জানান। বেশ কয়েকজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এত বড় ব্যর্থতার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল পুলিশ সদর দফতরের। খতিয়ে দেখা উচিত ছিল তাদের ভূমিকা। কিন্তু তা না করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তা ছাড়া অপহরণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন এই ডিসি ও এসপির মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত বহু ‘রাজনৈতিক অপরাধী’ লাইসেন্স পেয়েছেন। যাচাই-বাছাই না করে যাকে তাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। তারা বলছেন, সম্প্রতি সময়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে ওই জেলার পুলিশ সুপারদের ব্যর্থতার দায়ে পুলিশ সদরদফতরে সংযুক্ত করা হয়। নারায়ণগঞ্জের ৭খুনের ঘটনায় র‌্যাবের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীরও সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে মারাত্মকভাবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলামকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করা হয়েছে বলে তারা মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য, গতকাল একাধিকবার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও তার ছেলে দিপু চৌধুৃরীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। র‌্যাবের সেই তিন কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডার ঘটনায় র‌্যাব-১১’র অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদসহ তিন কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। গতকাল সেনা সদর দপ্তর ও নৌ-বাহিনী সদর দপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয় বলেও দুই বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে। অবসরে যাওয়া অপর দুই কর্মকর্তা হলেন মেজর আরিফ হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক প্রধান নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এমএম রানা। অবসরের পর তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলেও জানা গেছে। চাকরিচ্যুত তারেক সাঈদকে ঘটনার পর র‌্যাব-১১ অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হয়। তিন কর্মকর্তার মধ্যে সেনাবাহিনীর দুজনকে অকালীন এবং নৌবাহিনীর একজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। কর্মকর্তারা আপাতত নিজ বাসায়ই থাকতে পারবেন। তবে দোষী প্রমাণিত হলে সব অভিযুক্তকে ফৌজদারি আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। একইভাবে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পাশাপাশি ওই ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দিয়ে মামলা তদন্ত করতেও নির্দেশ দেন আদালত। র‌্যাবের সাবেক বা বর্তমান কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত করতে র‌্যাবের মহাপরিচালককেও (ডিজি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ছয় কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে সাতজনকে অপহরণ ও খুনের ঘটনায় র‌্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্ত করতে র‌্যাবের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্তে সন্তুষ্ট নন নজরুলের শ্বশুর নারায়ণগঞ্জের লোমহর্ষক ৭ হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও যারা এঘটনা তদন্ত করছেন তাদের কাজে তিনি সন্তুষ্ট নন। ঘটনার তদন্তসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গতকাল বুধবার সকালে তার নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের কাছে তিনি ৫ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, আমি র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেফতার দাবি করেছিলাম। কিন্তু পত্রিকায় দেখলাম ৩ কর্মকর্তাকে সরকার চাকরি থেকে অবসরে পাঠিয়েছে। তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় কেন আনা হচ্ছে না। কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও এডভোকেট চন্দন সরকারসহ ৭ হত্যাকা- নিয়ে সরকারের ভূমিকায় সন্দেহ প্রকাশ করে শহীদুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, এই মামলার প্রধান আসামী থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিনকে এখনও কেন দল থেকে বহিষ্কার করা হল না। শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালে নুর হোসেনের অফিসে সিসি ক্যামেরা ছিল। সেই ক্যামেরায় পুরো ট্রাক টার্মিনাল পর্যবেক্ষণ করত সে। সেখানে প্রতিনিয়ত কারা আসা যাওয়া করতেন এবং কি ঘটনা সেখানে হত তার সবই রেকর্ড থাকত। সেগুলো কেন জব্দ করা হল না । সেগুলো জব্দ করা হলে অনেক তথ্য পাওয়া যেত বলে তিনি দাবি করেন। নুর হোসেনের পক্ষের লোক সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার ওসি। তাদেরকে এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি কেন। নুর হোসেন ও তার সহযোগীদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা নিয়ে শহীদুল ইসলাম বলেন, নুর হোসেন ও তার সহযোগীদের ১২টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি ১১টি অস্ত্রের তালিকা পাঠিয়েছেন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু অপর অস্ত্রটির মালিক চুন কারখানার মালিক ফারুকের নামটি পাঠায়নি কেন। ফারুককে নুর হোসেনের সহযোগী ও সন্ত্রাসী উল্লেখ করে ওই লাইসেন্সটিও বাতিলের দাবি জানান তিনি। শহীদুল ইসলাম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, নজরুলের একাউন্টে এক টাকাও নেই। তার সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়েছে। ভয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে নজরুলের ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। এরপর সে আমার (নজরুলের শ্বশুর), তার বড় ভাই নুর মোহাম্মদ ও অন্য একজনের লাইসেন্স দিয়ে সড়ক ও জনপথে কাজ করতো। সেখানে বিল বকেয়া রয়েছে অনেক। যোগাযোগ মন্ত্রী যদি বকেয়া বিলগুলো দিত তাহলে নজরুলের সন্তানদের লেখাপড়া ও পরিবার চলতে পারত। তিনি নজরুলের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য সরকারের কাছেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। নারকীয় এই ৭ হত্যাকা-ের বিচারের দাবীতে আন্দোলনে অর্থ যোগান নিয়ে নিজ থেকেই তিনি বলেন, এলাকাবাসী যার যার সাধ্যমত সাহায্য করছে। কেউ পোষ্টার ছাপিয়ে দিয়েছে, কেউ মঞ্চ তৈরির টাকা দিয়েছে- এমন করেই আন্দোলন চলছে। র‌্যাবের তদন্ত কমিটি তার কাছে গতকাল পর্যন্ত র‌্যাবের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ বিষয়ে কিছু জানতে চায়নি বলে তিনি জানান। শহীদুল ইসলাম তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নজরুল অপহরণের আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেছিলেন নজরুলকে হত্যা করা হবে। নজরুল সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে। কিন্তু নজরুল তো বাঁচতে পারলো না। বাঁচানোর মালিক আল্লাহ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কোন গাফিলতি ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিকই ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন কিন্তু নিচের কর্মকর্তারা সেই দায়িত্ব পালন করেননি। যাদের এই দায়িত্ব পালনের কথা ছিল তারা সকলেই নুর হোসেনের পক্ষে কাজ করত বলেও তিনি দাবি করেন। এদিকে নিহত নজরুলের স্ত্রী ও দুই সন্তান শহীদুল ইসলামের বাড়িতেই থাকেন। শোকে পাথর তারা। দুচোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ধারা ঝরে। সাংবাদিকদের সাথেও খুব একটা বলেন না। ওই বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য একজন উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের পুলিশ দল সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। দিনভর সংবাদকর্মী, এলাকার সর্বস্তরের মানুষ আসা যাওয়া করছে ওই বাড়িতে। সাধারণ মানুষের একটাই দাবি ঘটনার সঠিক তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। নুর হোসেনের সাম্রাজ্য বেদখল আলোচিত ৭ খুনের প্রধান আসামী হয়ে যাওয়ার পর বেদখল হয়ে গেছে নুর হোসেনের সাম্রাজ্য। আওয়ামীলীগ ও বিএনপির দুটি অংশ মিলে গত ৬ মে থেকে দখলে নিয়ে গেছে ওই সাম্রাজ্য। দুই দশকের রাজত্ব ছিল নুর হোসেনের। আশির দশকের শেষ দিকে পরিবহন শ্রমিক থেকে তার উত্থান। নুর হোসেন কখনও স্কুলে না গেলেও তার বুদ্ধি ও সাহসিকতায় সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের রাজা বনে যান তিনি রাজনৈতিক সেল্টারে। প্রতিদিন কিংবা মাসে নুর হোসেনের অবৈধ আয় কত ছিল তার সঠিক হিসেব কেউ বলতে পারে না। তবে গত ৫ বছরে তার নয়াআটি রসুলবাগ এলাকায় ৭ কাঠা জায়গার উপর একটি ৭ তলা বাড়ি নির্মাণাধীন, চলাচলের জন্য ৪টি বিলাসবহুল গাড়ি, নারায়ণগঞ্জ-শিমরাইল সড়কে চলাচলকারী এবিএস পরিবহনের ২৪টি যাত্রীবাহি বাস, নুর হোসেন ও তার সহযোগীদের নামে ১২টি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও বিভিন্ন ঠিকাদারী কাজে কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ, নুর হোসেনের ছোট ভাই নুরুজ্জামান জজের ৭ তলা বাড়ি ও ২টি গাড়ী, দৃশ্যমান রয়েছে। আরো ৩ অস্ত্র উদ্ধার ৭ হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজন আসামী কাউন্সিলর নূর হোসেনের আরো ৩ সহযোগীর লাইসেন্স বাতিল করা ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। বুধবার দুপুরে এ ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে নুর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শাহজাহান, আলী আহাম্মেদ ও সানাউল্লাহ সানার শর্টগান। তাদের বাড়িতে পৃথক অভিযান চালিয়ে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার উদ্ধার করা হয় নুর উদ্দিন ও জামালের নামের দুটি শর্টগান। আর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আরিফুল হক হাসানের শর্টগান ও পিস্তল থানায় গিয়ে জমা দেন তার বাবা শ্রমিকলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল মতিন মাষ্টার। গত সোমবার বাতিল করা ১১টি লাইসেন্স এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৭টি অস্ত্র উদ্ধার ও জমা দেয়া হয়েছে। প্রাইজ পোস্টিং নারায়ণগঞ্জের সেই আলোচিত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মনোজকান্তি বড়াল ও পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নূরুল ইসলাম প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছেন। চাঞ্চল্যকর সাত অপহরণ ও হত্যাকা-ের ক্ষত শুকানোর আগেই তারা পদায়ন পেয়েছেন যথাক্রমে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি)। ব্যর্থতার অভিযোগে প্রত্যাহারের দিনই একই আদেশে তাদের নতুন কর্মস্থলে পদায়ন করা হয়। বিভাগীয় ব্যবস্থা বা অনুসন্ধান না করেই এ দুই কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন করায় প্রশাসনে চলছে কানাঘুষা। অনেকেই বলছেন, এত বড় ব্যর্থতার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। খতিয়ে দেখা উচিত ছিল তাদের ভূমিকা। কিন্তু তা না করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। তা ছাড়া অপহরণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন এই ডিসি ও এসপির মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত বহু \রাজনৈতিক অপরাধী\ লাইসেন্স পেয়েছেন। যাচাই-বাছাই না করে যাকেতাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিসি মনোজকান্তি বড়ালকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে সঙ্গে সঙ্গেই পদায়ন করা হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব হিসেবে। প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই এ ঘটনায় হতবাক। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, এত বড় ব্যর্থতার পর কীভাবে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তিনি পোস্টিং পেলেন! জানা গেছে, ৮৬ ব্যাচের এই কর্মকর্তা উপ-সচিব থেকে যুগ্ম-সচিব হওয়ার পরও নারায়ণগঞ্জে ডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার সঙ্গে একই ব্যাচের আরও যেসব কর্মকর্তা যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনের নিয়মিত পোস্টিং মিলেছে। অধিকাংশই এখনো পুরনো কর্মস্থল অর্থাৎ উপ-সচিবের ডেস্কে কাজ করছেন। মন্ত্রিপরষিদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাতজন মানুষকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনা অবশ্যই ওই জেলার ডিসি ও এসপির চরম ব্যর্থতা। এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা উচিত ছিল। কেন তারা ব্যর্থ হয়েছেন, পিছনের কারণ কী, তা খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত করা উচিত। সৈয়দ নূরুল ইসলাম এখন এসবিতে এসপির দায়িত্বে। তার বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ডিসির চেয়ে এসপির ব্যর্থতাই বেশি। তিনিই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাধিক ভূমিকা রাখেন। অথচ সাতজন মানুষ দিনদুপুরে অপহরণ হলেন। তিন দিন পর নদীতে লাশ পাওয়া গেল। এর দায় এসপি কিছুতেই এড়াতে পারেন না। এ ঘটনায় এসপির ভূমিকা কী ছিল? কেন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন? তা খতিয়ে দেখা উচিত। খুনের চুক্তি গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের নিচতলার নামাজঘরে বসে নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, সরকারি দলের এক মন্ত্রীর ছেলের মধ্যস্থতায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আলোচিত এ হত্যাকা-ের নেপথ্য হোতা নূর হোসেনের সঙ্গে ওই মন্ত্রীপুত্রের ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। সে সূত্রেই মন্ত্রীর জামাতা র‌্যাব ১১-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদের সঙ্গে নূর হোসেনের যোগাযোগ হয়। টাকা লেনদেন হয় সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ও রাজধানীর রায়েরবাগের দু’টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে। হাতে হাতেও পৌঁছানো হয়েছে মোট টাকার একটি অংশ। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক গোলাম ফারুক বলেন, মামলার এজাহারে যে অভিযোগ রয়েছে এর পাশাপাশি বাদী ও তাদের স্বজনরা যেসব অভিযোগ করছেন সবই গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র‌্যাবের সম্পৃক্ততা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, র‌্যাবের বিষয়টি র‌্যাব ও হাইকোর্টের নির্দেশে পৃথক তদন্ত হচ্ছে। একাধিক মোটিভ সামনে রেখে তদন্ত কাজ চলছে। অপহরণের দিন আদালতেই আটক হয়েছিলেন র‌্যাব সদস্য সূত্র জানায়, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইদ্রিস আলী পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানান, গত ২৭শে এপ্রিল নজরুলের সঙ্গে তিনিও আদালতে হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন। তিনিও একই মামলার আসামি ছিলেন। তারা আদালতে গিয়ে মামলার শুনানির ডাকের অপেক্ষা করছিলেন। নজরুল ইসলাম তখন আদালতের একটি কক্ষে বসে ছিলেন। এসময় সবুজ কাবুলি পাঞ্জাবি ও মাথায় পাগড়ি পরা আনুমানিক ৩০-৩২ বছরের এক যুবক বারবার নজরুলকে অনুসরণ করছিল। কিছুক্ষণ পরপর সে দূরে গিয়ে কার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিল। নজরুলকে খুন করা হতে পারে আগে থেকেই তারা আশঙ্কা করছিলেন। এ কারণে বিষয়টি টের পেয়ে সবাই ওই যুবককে ধরে ফেলেন। পরে তার কোমরে একটি পিস্তল পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক তাকে কোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের কানে কানে সেই যুবক কি যেন একটা বলে। পরে পুলিশ তাদের জানায় সে আইনের লোক, র‌্যাব সদস্য। এর কিছুক্ষণ পর র‌্যাবের জ্যাকেট পরা দাড়িওয়ালা চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি এসে যুবককে নিয়ে যায়। ইদ্রিস আলী বলেন, তাদের ধারণা ওই র‌্যাব সদস্য আদালত থেকে কখন নজরুলসহ অন্যরা কোনদিকে যাবে বা যাচ্ছে সেই তথ্য সহযোগীদের দিচ্ছিল। ওই ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল বাতেন জানান, তিনি নজরুলের সঙ্গে ওই মামলার আসামি ছিলেন না। আগের দিন সন্ধ্যায় নজরুল তাকে ফোন করে সঙ্গে আদালতে যেতে বলেন। এজন্য তিনি আদালত প্রাঙ্গণে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে যে যুবককে আটক করা হয়েছিল সে পাঁচ ফুট ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি লম্বা হবে। মুখটা গোলাকার। তাদের সহযোগী তাজুল ও শহীদুল তার কোমর তল্লাশি করে একটি পিস্তল পায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। নিজেকে র‌্যাব পরিচয় দেয়ার পর পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। তিনি বলেন, তারা র‌্যাব সদস্য হওয়ায় আর কিছু বলেননি। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে, র‌্যাবের লোকই নজরুলকে তুলে নেয়ার জন্য এভাবে পিছু নিয়েছে। আব্দুল বাতেন বলেন, আদালত থেকে নজরুলসহ অন্যরা বের হয়ে যাওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় দেখেন নজরুলের মোবাইল বন্ধ। তারা খবর পান শিবু মার্কেটের কাছে র‌্যাব সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। পরপরই অটোরিকশা দিয়ে সেখানে গেলেও কোন গাড়ি দেখতে পাননি। তবে স্থানীয় লোকজন র‌্যাব লেখা গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল বলে সে সময় জানিয়েছিল। উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে লিংক রোড ধরে ঢাকায় যাওয়ার পথে অপহৃত হন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম এবং তাঁর চার সহযোগী। প্রায় একই সময়ে একই সড়ক থেকে গাড়িচালকসহ অপহৃত হন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিন দিন পর গত ৩০ এপ্রিল একে একে ছয়জনের এবং পরদিন ১ মে আরেকজনের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম গত রোববার র‌্যাবের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, নজরুলকে র‌্যাব তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। এর জন্য আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ কয়েকজনের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকা নিয়েছেন র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা। র‌্যাব-১১-এর সিও তারেক সাঈদের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। অপহরণের ঘটনার পরদিন আমি র‌্যাব-১১-এর সিও, মেজর জাহাঙ্গীর, মেজর রানা এবং নূর হোসেন, ইয়াসিনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলামের কাছে যাই। কিন্তু পুলিশ সুপার আমাকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিলে মামলা হালকা হয়ে যাবে। এরপর তাঁরা ছয়জন আসামির নাম বাদ দিতে বললে আমরা সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দিই। - See more at: http://www.dailyinqilab.com/2014/05/08/177466.php#sthash.pVQT6Bl3.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন