রবিবার, ৪ মে, ২০১৪


অপহৃতদের হত্যা করে নৌপথে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শীতলক্ষ্যায়
05 May, 2014 ডেথজোন বলে পরিচিত নারায়ণগঞ্জে ৭ অপহরণের পর তাদের লাশ উদ্ধার হলেও আলামত নিয়ে শুরু হয়েছে নানা গুঞ্জন। তবে পুলিশ বলছে, অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন, অপরাধের কোনো না কোনো ক্লু সে রাখেই। ৭ খুনের সঙ্গে জড়িতরাও বিভিন্ন ধরনের ক্লু রেখে গেছে বলে দাবি করেছেন পুলিশের সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট ১৪ ধরনের আলামত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রহস্যময় ‘এমবিবি’ ব্র্যান্ডের ইট। যেগুলো লাশ ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নিহতদের শরীরে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এসব আলামতের সূত্র ধরেই শুরু হয়েছে তদন্ত কাজ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘যারা হত্যা করেছে তারা পেশাদার এবং প্রশিক্ষিত। আর এ কারণেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে খুনিরা চেলেছেন বেশকিছু সুকৌশলী চাল। এতে অনেকগুলো বিষয় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে এখনও খোলাসা নয়। এছাড়া প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম মারা গেলে অথবা নুর হোসেন আসামি হলে কার লাভ বা ক্ষতি কিংবা নজরুলের সঙ্গে পুরনো দ্বন্দ্বের জের ধরে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুযোগ নেয়ার পাঁয়তারা করছে কিনা- এসব বিষয়েও পাওয়া গেছে সুস্পষ্ট কিছু ধারণা। বন্দর থানা পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি লাশের সঙ্গে ২৪টি করে ইট বাঁধা ছিল। ইটগুলোতে লেখা আছে- ‘এমবিবি’। এই এমবিবি ইটভাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সরেজমিন নারায়ণগঞ্জ শহরের আশপাশে বিভিন্ন ইটভাটায় গিয়ে এমবিবি ইটের ভাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে কয়েকজন ইটভাটার মালিক জানান, এটি পার্শ্ববর্তী থানা এলাকার ভুলতা বা আশপাশের কোনো এলাকার ইটভাটা হতে পারে। বক্তাবলী এনায়েতনগর ইউনিয়ন আঞ্চলিক ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি শওকত আলী জানান, তাদের ইটভাটা মালিক সদস্য তালিকার মধ্যে এমবিবি কোম্পানির ইট উৎপাদিত হয় না। রূপগঞ্জের ভুলতা ও রূপসী এলাকায় এ ধরনের ইটের ভাটা থাকতে পারে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, ইটগুলো মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। ইটগুলো কোথাকার তা জানতে পারলে হত্যাকাণ্ডটি কোথায় ঘটেছে এ বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে, যা হত্যারহস্যের জট খুলতে সহায়তা করবে। লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাস্থল ও লাশ থেকে ১৪টি আলামত সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এসব আলামতের মধ্যে রয়েছে- ইট, দড়ি, পলিথিন ব্যাগ, ব্যাগ সেলাইয়ের সুতা, পরিধেয় জামাকাপড়, হাতঘড়ি, আংটি, মানিব্যাগ ইত্যাদি। পুলিশ জানিয়েছে, উদ্ধার করা ৭টি লাশের হাত-পা শক্ত পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। লাশগুলো যাতে কোনোভাবেই ভেসে উঠতে না পারে সে জন্য ১২টি করে ইটভর্তি সিলিকনের ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাগগুলোতে ইট ভরে অত্যন্ত মজবুত করে সেলাই করা ছিল। এসব দড়ি ও সিলিকনের ব্যাগ থেকে ঘটনার সূত্র খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। দড়ি ও ব্যাগের নমুনা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া উদ্ধারকৃত জামাকাপড় থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ধারণা, অপহরণের আগে-পরে অপহরণকারীদের সঙ্গে নিহতদের ধস্তাধস্তি হয়ে থাকতে পারে। ওই সময় অপহরণকারীদের মাথার চুল যদি ছিঁড়ে গিয়ে থাকে অথবা তাদের দেহের চামড়ার কোনো অংশ যদি খসে যায়, তাহলে সেগুলোর কোনো নমুনা সংগ্রহের জোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে, ৭টি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বন্দর থানার ৪ জন এসআই। তারা হলেন- এসআই বেলায়েত, এসআই মিজান, এসআই হানিফ ও এসআই আবু তালেব। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রতিটি লাশের নাভির নিচে পেটের একটি নির্দিষ্ট জায়গা কাটা ছিল। এর বাইরে শরীরের আর কোথাও কোনো কাটা বা জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। লাশগুলো ছিল অর্ধগলিত। একটি লাশের চোখ পুরোপুরি গলে গিয়েছিল। মুখমণ্ডল ছিল কালচে। প্রতিটি লাশই পলিথিন ব্যাগ দিয়ে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পঁ্যাচানো ছিল। বন্দর থানার ওসি আক্তার মোর্শেদ বলেন, চেহারা বিকৃত করতে হয়তো এসিড জাতীয় কোনো রাসায়নিক পদার্থ লাশের মুখমণ্ডলে ঢেলে দেয়া হয়েছে। এ কারণে মুখমণ্ডল কালচে হয়ে যেতে পারে। তবে কি কারণে লাশের মাথা থেকে গলা পর্যন্ত পলিথিন বেঁধে দেয়া হয়েছে তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছে পুলিশ। পুলিশ বলেছে, উদ্ধার হওয়া ৭টি লাশই ছিল এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। প্রতিটি লাশই ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার পরপর ফেলা হয়েছিল। লাশগুলোর পেট ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে যাতে পেটে গ্যাস জমা হয়ে ফুলে উঠতে না পারে। লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আফাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ৭টি লাশ পরীক্ষা করে তিনি দেখেছেন তাদের সবাইকে একইভাবে হত্যা করা হয়েছে। সবার মাথার পেছনে একটি স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে, অপহরণের দিনই অপহৃত সবাইকে হত্যা করে নৌপথে লাশ নিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলা হয়েছে। লাশ বহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স বা বিশেষ কোনো গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আজীম উল আহসান বলেন, লাশ ফেলে দেয়া বা অপহৃতদের ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে শহর এবং শহরতলিতে চেকপোস্ট বসিয়ে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়েছিল। ফলে এতগুলো লাশ বাইরে থেকে এনে ফেলে যাওয়া অপরাধীদের পক্ষে সম্্‌ভব ছিল না। বন্দর থানার ওসি আক্তার মোর্শেদ বলেন, উদ্ধারকৃত লাশ দেখে তাদের মনে হয়েছে একদিন বা দুদিন আগে লাশগুলো পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। লাশ পরীক্ষা করে মৃতুøর সময় নির্ধারণ করা যায় কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, হয়তো সময় একেবারেই সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্্‌ভব নয়। তবে লাশের বাহ্যিক অবস্থা এবং কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাছাকাছি সময় বলা যেতে পারে। তবে পানিতে ডুবে থাকা লাশের ক্ষেত্রে মৃতুøর সময়সীমা বলা অনেকটাই কঠিন। কারণ এক্ষেত্রে লাশের বাহ্যিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেন ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুর এখন প্রধান সন্দেহভাজন। তিনি এখন পলাতক। নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার রাজনৈতিক বিরোধ দীর্ঘদিনের। নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বলেন, প্রায়ই নজরুল তাকে বলতেন কেউ তাকে ফোন করে মেরে ফেলার হুমকি দিত। এমনকী নুর হোসেনের নামও বেশ কয়েকবার বলেছেন তিনি। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা নানা দিক পর্যালোচনা করে তদন্ত করছি। এর মধ্যে নজরুলের সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে নজরুলের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় নুর হোসেনের। নেপথ্যে ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার। দেড় যুগ ধরে সেই বৈরিতা চলছিল। যদি নজরুলকে মারা হয় তা হলে গিয়াসের জন্য সুবিধা। কারণ নুর হোসেনের সঙ্গে গিয়াসের রাজনৈতিক বিরোধ আছে। বিগত সময়ে বিএনপির আমলে নানাভাবে গিয়াস উদ্দিন হয়রানি করে নুর হোসেনকে। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে গিয়াস উদ্দিন এই খুনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, এর আগেও গিয়াসের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ছিল। বিকেএমইর প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি সাব্বির আলম খন্দকারের হত্যামামলার অন্যতম আসামি গিয়াস। ২০০৩ সালে চাঞ্চল্যকর ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, আমরা কয়েকটি দিক তুলে আনছি তদন্তে। এসব পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পুলিশের ধারণা অপরাধীরা অপহৃতদের হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলতে এমন কোনো রাস্তা ব্যবহার করেছে যেখানে পুলিশের নজর এড়িয়ে যাওয়া সম্্‌ভব। নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র এএসপি আজীম উল আহসান বলেন, ঘটনার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল। এসব চেকপোস্ট দিয়ে যাওয়া-আসা করা প্রতিটি গাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। তাই মূল রাস্তা ব্যবহার করে লাশ বহন করা প্রায় অসম্্‌ভব ছিল। খুনিরা এমন কোনো রাস্তা ব্যবহার করেছে যেখানে পুলিশের চেকপোস্ট ছিল না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের মধ্যে শুধু ইপিজেড এলাকার অভ্যন্তরে পুলিশের কোনো চেকপোস্ট ছিল না। লাশ ফেলে দেয়ার জন্য হয়তো ইপিজেডের আশপাশ এলাকা কৌশলে ব্যবহার করতে পারে অপরাধীরা। এদিকে, ৭ জনকে অপহরণ করে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত ৬ সদস্যের এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সিনিয়র এএসপি আজীম উল আহসান, জেলা ডিবির ওসি ইন্সপেক্টর মাহবুবুর রহমান, ফতুল্লা থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত সাইফুল ইসলাম, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আনিসুর রহমান এবং অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফজলুল হক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন