রবিবার, ৪ মে, ২০১৪


দেশপ্রেম, জিয়াউর রহমান ও শারমিনের মুজিব কাকু 05 May, 2014 মুক্তিযুদ্ধ এখন কোনো কোনো মহলের রমরমা বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে রীতিমতো হাস্যরসের উদ্রেগ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময়ে দেয়া ক্রেস্টে যে স্বর্ণ থাকার কথা ছিল তা দেয়া হয়নি। আর রূপার বদলে দেয়া হয়েছে পিতল, তামা ও দস্তা মিশ্রিত সঙ্কর ধাতু। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, স্বর্ণের ১৬ আনাই মিছে। রূপা তো দেয়াই হয়নি। খবরে বলা হয়েছে, সরবরাহকারীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে মুজিবনগর কর্মচারী হিসেবে এমন ১৯০ জনকে ২০০৯ সালে সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যাদের বয়স ’৭১ সালে দুই বছর থেকে ১৬ বছরের মধ্যে ছিল। বিচার ও সংসদ বিষয়ক তদন্ত কমিটির কাছে চাকরিপ্রাপ্তরা স্বীকার করেছেন, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি চক্রের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কাগজপত্র সংগ্রহ করেছেন। এসব কাগজপত্র সংগ্রহ থেকে চাকরি পাওয়া পর্যন্ত সব মিলে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে। তারা আরো জানিয়েছেন, মুজিবনগর কর্মচারী নিয়ে একটি চক্র সারাদেশে টাকার বিনিময়ে কাজ করছে। এদের সব কাগজপত্রই ভুয়া। অন্য খবরে বলা হয়েছে, চাকরির বয়স বাড়িয়ে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিতে মুক্তিযুদ্ধ সনদ নিয়েছেন এমন কর্মচারীদের মধ্যে অন্তত চারজন সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন সাবেক সচিব রয়েছেন। গত পাঁচ বছরে মুক্তিযুদ্ধ সনদ নিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন। যেসব আলোচনা করা হয়েছে সেগুলোই হয়তো সব নয় এবং সব ঘটনার বিবরণ হয়তো সম্ভব নয় তবে অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারকরা রাজনৈতিক বক্তব্য যাই দিন না কেন কার্যত দেশকে মারাত্মক বিপর্যয়কর বাস্তবতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে রমরমা বাণিজ্য চলছে তার রেশ এখনো কার্যকর। সঙ্গতভাবেই অনুমান করা যায়, এই বাণিজ্যের শেকড় সরকারের অনেক গভীরে। হতে পারে, সরকারকে যারা বিভিন্ন ‘অপকর্মে’ পরামর্শ দান করেছেন, করছেন তাদের কেউ কেউ হয়তো এর সাথে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমান আমলে মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্য নিয়ে যা ঘটেছে তাতে কোনো অবস্থাতেই বিএনপি-জামায়াত জোটের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং তাদের আমলে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেছে তারও কোনো প্রমাণ নেই। বোধগম্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চলমান চেতনা বাস্তবায়নের দৃষ্টিভঙ্গী সামনে রেখেই সরকার সর্বত্র তাদের মতাবলম্বীদেরই নিয়োগ দিয়েছেন। বিরোধী মতের কাছাকাছি কেউ অবস্থান করেন এমন কাউকেও ছাড় দেননি। সুতরাং এ বাণিজ্য যে সরকার ও তার মিত্ররাই সফলভাবে সম্পন্ন করেছে তা প্রমাণিত। অন্যদিকে সরকারের বামপন্থী সমর্থকরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে যে শাহবাগী মঞ্চের লালন প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেই মঞ্চের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধেও অর্থ কেলেঙ্কারিসহ নানা গর্হিত অপরাধের কথা সরকারের কোনো কোনো মহল থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। শাহবাগী মঞ্চের দুর্নীতিও সম্পাদিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে। ফলে প্রশাসনিক এবং মাঠের দুর্নীতি সমান্তরাল অবস্থান করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার সাথে সম্পর্কিত দেশপ্রেমিকরা স্বাধীনতার পর থেকেই স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকেই তাদের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিনিময়ে পদোন্নতি গ্রহণ করেননি। পদোন্নতির বিনিময়ে দেশপ্রেমিকতাকে বিক্রি করতে চাননি। দেশের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকারি কোনো স্বীকৃতি তার ভাগ্যে জোটেনি। রাজনৈতিক রোষের শিকার হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী। আর কথায় কথায় স্বাধীনতার ঘোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে ‘রাজাকার’ পর্যন্ত বলতে যারা দ্বিধান্বিত নন তাদের এই মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্যের প্রসঙ্গ কোনো বিবেচনাতেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রেক্ষিত থেকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গুম-হত্যা-অপহরণ নতুন মাত্রা নিয়েছে। আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এখন সরকারি দলের লোকরাও বেধড়ক গুম ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদের লিখিত একটি বইয়ে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ যখন সবকিছু ছাপিয়ে উঠতে শুরু করেছে ঠিক সেই সময় গুম প্রসঙ্গও যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আন্তঃ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা অথবা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ চাপা দেয়ার জন্য কোনো মহল দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন কিনা সে প্রসঙ্গ হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কোনো কোনো মহল বলছে, র‌্যাব নিষিদ্ধ হলেই গুম-ক্রসফায়ার নিষিদ্ধ হতে পারে। বাস্তবত র‌্যাব যখন ছিল না তখনও দেশে গুম-হত্যা বন্ধ ছিল না। স্বাধীনতার পর রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধেও অনুরূপ অভিযোগ উঠেছিল। যাই হোক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিকত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে নতুন যে পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হচ্ছে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সে সময়ে প্রবাসী সরকার ও পরবর্তী নানা প্রসঙ্গ এখনও নতুন করে উঠে আসতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের আগেই দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেন এটা করেছিলেন বা করতে হয়েছিল সে সম্পর্কে মাইদুল হাসানের মূলধারা একাত্তরে লিখেছেন, ‘বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী প্রাঞ্জল ভাষায় তাজউদ্দীনকে জানান, মুক্তিফৌজ ট্রেনিং বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এই ট্রেনিং সমাপ্ত হওয়ার পরই কেবল তাদের অস্ত্র সরবরাহের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এ ট্রেনিং বাংলাদেশী বিদ্রোহীদের দেয়া হবে কিনা সে সিদ্ধান্তের সংবাদ এখনো তার জানা নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবং তাজউদ্দীন চাইলে তাকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন মাত্র।... এই বাস্তবতায় তাকে স্থির করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা কালে তার নিজের ভূমিকা কি হবে? তিনি কি শুধু আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসেবে আলাপ করবেন? তাতে বিস্তর সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী প্রয়োজনীয় অস্ত্র লাভের আশা ছিল অনিশ্চিত।’ ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের আগের দিন তারই এক ঊর্ধ্বতন পরামর্শদাতা তাজউদ্দিনের সাথে আলোচনাকালে জানতে চান আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে কোনো সরকার গঠন করেছে কিনা? এই জিজ্ঞাসা ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা থেকে তাজউদ্দীন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে কি হয়নি সে সম্পর্কে কোনো প্রকৃত সংবাদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জানা নেই এবং সরকার গঠনের সংবাদে তাদের বিস্মত বা বিব্রত হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বরং সরকার গঠিত হয়েছে জানতে পারলে, ‘পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামে সাহায্য করার’ জন্য ভারতীয় পার্লামেন্টে ৩১ মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা এক নির্দিষ্ট ও কার্যকর রূপ লাভ করতে পারবে বলে তাজউদ্দীনের ধারণা জন্মায়। এই বিচার-বিবেচনা থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতেই তাজউদ্দীন জানান যে, পাকিস্তানি আক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি সরকার গঠন করা হয়। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীর (যারা পরে হাইকমান্ড বলে পরিচিত) মন্ত্রিসভার সদস্য। শেখ মুজিব গ্রেফতারের খবর ছাড়া অন্যান্য ভালোমন্দ সংবাদ যেহেতু সম্পূর্ণ অজানা সেই জন্য তাজউদ্দীন দিল্লিতে সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের পরামর্শক্রমে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থিত করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন। যে প্যান্ডোরার বাক্স তাজউদ্দীন আহম্মদ খুলতে চাননি বা চেপে গিয়েছিলেন অথবা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন রাজনৈতিক দলিলে উল্লেখ করা হয়নি সেটাই খুলে দিয়েছে তার কন্যা শারমিন আহমদ। তিনি লিখেছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাতে আব্বু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে। মুজিব কাকু আব্বুর সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন- এই ব্যাপারে আব্বু মুজিব কাকুর সাথে আলোচনা করেছিলেন। মুজিব কাকু সে ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী আত্মগোপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রেখেছিলেন। বড় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আব্বুর উপদেশ গ্রহণে মুজিব কাকু এর আগে দ্বিধা করেননি। আব্বুর সে কারণে বিশ্বাস ছিল যে, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। মুজিব কাকু আব্বুর সাথেই যাবেন অথচ শেষ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় থেকে গেলেন।’ তিনি আব্বুকে বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো। পরশু দিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি।’ মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এই উক্তিতে আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এদিকে বেগম মুজিব ঐ শোবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাজ করে রাখতে শুরু করলেন। পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার এই সব প্রস্তুতি দেখার পরও আব্বু হাল না ছেড়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।’ আমি বিজয় দেখেছি বইতে এম আর আক্তার মুকুলও এ প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, সব প্রস্তুতির পরও গভীর রাতে একটি ফোন এলো এবং তিনি আত্মগোপনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেন। ঐ ফোনটি কার ছিল তা নিয়ে নানা প্রশ্ন এখনো রয়েছে। শারমিন লিখেছেন, আব্বু বললেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলো পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণরূপে নেতৃত্ব শূন্য করে দেয়া- এই অবস্থায় মুজিব কাকুর ধরা দেয়ার অর্থ হলো আত্মহত্যার সামিল। শারমিন আরো লিখেছেন, ‘মুজিব কাকু বললেন, তোমরা যা করার করো আমি কোথাও যাবো না। আব্বু বললেন, আপনার অবর্তমানে দ্বিতীয় কে নেতৃত্ব দেবে এমন ঘোষণা তো আপনি দিয়ে যাননি।’... ফলে মুক্তিযুদ্ধকে এক অনিশ্চিত ও জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে এবং তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। শারমিনের ভাষ্য অনুযায়ী, তার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, এই ঘোষণা (স্বাধীনতার) কোনো না কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায় তাহলে সেটাই করা হবে। মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন, এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের দলিল, দেশপ্রেম এসব নিয়ে যারা আলোচনা করছেন তাদের কোনো কোনো অংশ বিশেষ করে বর্তমান সরকারের যারা পরামর্শক, চাটুকার তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন সেদিনের মেজর জিয়ার ঘোষণা কার্যত কোনো ঘোষণাই ছিল না। যারা বলার চেষ্টা করছেন ‘একজন মেজরের ঘোষণা’ তারা যে ঐতিহাসিক বিভ্রান্তিতে রয়েছেন সে আলোচনা এমন একজন করেছেন যার পরিবার পুরোটাই আওয়ামী ঘরানার। তার বোন বর্তমান সরকারের সংসদ সদস্য, তার ভাই মাত্র সেদিন সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এবং তার পিতার আলোচনা বিশদ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আর তার মা আওয়ামী লীগের দুর্দিনে হাল ধরেছেন। তিনি যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দানকে ’দেশদ্রোহিতার দলিল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তখন সঙ্গত প্রশ্ন ওঠে, সেদিনের একজন মেজর বিদ্রোহ করে নিজের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে দেশপ্রেমের যে পরিচয় দিয়েছিলেন সেটা যদি দেশপ্রেমিকতা না হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের চেতনা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন যে উঠতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শারমিন আহমদ যে আলোচনা করেছেন তা তিনি শুরু করলেও আলোচনাটি নতুন নয়। মূলত দীর্ঘদিন থেকেই নানাভাবে এই কথাগুলো ইথারে রয়েছে। সম্প্রতি লন্ডনে তারেক জিয়া মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে সংবিধানের আলোকে প্রশ্ন তোলার পর আওয়ামী লীগের অনেকেই এমনকি সংসদেও তার বিরুদ্ধে যে সমস্ত খিস্তি- খেউর করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়, শারমিনের বক্তব্যের পরে তারা মুখ খুলছেন না কেন? প্রধানমন্ত্রিত্ব প্রশ্নেই তারেক রহমান দলিল তুলে ধরেছিলেন। তারেক রহমানের আলোচনার সূত্র ধরে কেউ কেউ বলছেন, জিয়া যা বলেননি তার... বেশি বলছেন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ১৯৭২-এর সংবিধানে জাতির পিতার কোনো নাম বা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও আওয়ামী মহল এ নিয়ে নানা কথা বলছেন কেন? শারমিন আহমদ তার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তিনি সংজ্ঞা নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতার সময় এবং বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণই মূল বিষয়। হয়তো সে কারণেই স্বাধীনতার পর যেভাবে সারাদেশে গুম-খুন-রাহাজানি সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছিল এখনও বোধহয় তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ’৭৩-এর পূর্ববর্তী বাংলাদেশে ভিয়েতনাম দিবস পালন উপলক্ষে ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল। এর প্রতিবাদে বাম দলগুলো ঢাকাসহ সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়েছিল। সে সময় সোভিয়েতপন্থী বাম নেতারা রাজনৈতিক আপস করার কারণে ঐ আন্দোলনের পরিণতি ’৮৩-এর ছাত্র আন্দোলনের মতোই হারিয়ে গিয়েছিল। ভিয়েতনাম দিবসের পরে রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। তিন দলীয় ঐক্যে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। তখনও একটি সংসদ ছিল। ওই সংসদ ছিল অকার্যকর। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সে সময়ের সংসদ সদস্য জেনারেল (অব.) ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, আব্দুল্লাহ সরকারসহ যারা বাকশালে যোগ দেননি তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সে সময়ের রাজনীতিতে জাসদই ছিল প্রকাশ্য সরকারবিরোধী দল। পরের ইতিহাস ভিন্নরূপ। বাকশাল-পরবর্তী বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদবিরোধী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিকদের সংগঠিত করে প্রথমে জোট এবং পরে অনুরূপ আদর্শের অনুবর্তী দল গঠন করেছিলেন। সেটাই আজকের বিএনপি। এখনো বিএনপিতে সে ধারাই মূলত কার্যকর। বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামাবলী গায়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও নাস্তিক্যবাদীরা সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস বাতিল এবং নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য সর্বসম্মত নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, সহনশীলতা ও সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের যে মৌলিক সম্পর্ক বিদ্যমান আজকের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এর সবকিছুই প্রায় তিরোহিত। নির্বাচনের কারণে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। বাক-স্বাধীনতা শর্তসাপেক্ষ, সহনশীলতা উধাও এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। সুতরাং সে বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন উঠতে পারে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া ও তার দল না বর্তমান সরকার দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার পূরণের কৃতিত্বের দাবিদার। বাংলাদেশ কোনো হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়। শত শত বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী এ অঞ্চলের নিষ্পেষিত-নিপীড়িত সাধারণ মানুষ ইসলামী সাম্যবাদের পতাকাতলে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তারই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার আজকের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা সেখানেই। যারা একে ভিন্ন অর্থে চালিত করতে চান, তাদের সাথে জনগণ সাংঘর্ষিক বাস্তবতায় বিরাজ করছে। তাজউদ্দীন কন্যা যে প্যান্ডোরার বাক্স ওপেন করেছেন তার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মৌলিক প্রশ্নের যৌক্তিক পরিণতিতে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিভ্রান্তির ঘেরা টোপ থেকে মুক্ত হয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণ করলে এটাই বলতে হবে, বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধ-জিয়াউর রহমান এক ও অভিন্ন সত্তায় রয়েছে। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত স্বাধীনতার চেতনা বিলোপের যে অপচেষ্টা হয়েছে, আজ জনগণ তার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াচ্ছে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত সুশাসনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন