রবিবার, ৪ মে, ২০১৪


অপহৃত নজরুলসহ ছয় জনের লাশ শীতলক্ষ্যায়: অচল নারায়নগঞ্জ তারুণ্য প্রতিদিন ডেস্ক । ১ মে, ২০১৪ ৫:৩১ 0 Email Email ৫৪৪৩৫৫ 23454 নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার অপর তিন সঙ্গী এবং অ্যাডভোকেট চন্দন ও তার গাড়ির ড্রাইভারের লাশ পাওয়া গেছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। অপহরণের চার দিন পর গতকাল বুধবার বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশগুলো ভেসে ওঠে। নিখোঁজ হওয়া আইনজীবী অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। হাত-পা, মুখ বেঁধে নির্মমভাবে হত্যার পর গায়ে ইট বেঁধে লাশগুলো পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিল খুনিরা। এ দিকে এই নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে পুরো নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা-চিটাগাং রোডে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এই হত্যার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অচল হয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী এই ঘটনার জন্য নারায়ণগঞ্জের গডফাদারদের দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, গডফাদাররা নারায়ণগঞ্জের সব প্রতিবাদী মানুষকে হত্যা করে তাদের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। এ দিকে অপহরণের পর যাদের নামে নজরুল ইসলামের পরিবার মামলা দায়ের করেছে তাদের কেউ গ্রেফতার হয়নি। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও হাত রয়েছে। তাদেরকে দিয়েই গডফাদাররা এই অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। উল্লেখ্য, এই শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এর আগেও অনেক মানুষের লাশ উদ্ধার হয়েছে। গত রোববার আদালতে মামলার হাজিরা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং তার সঙ্গী তাজুল, স্বপন, লিটন এবং গাড়িচালক জাহাঙ্গীর। বেলা আড়াইটার দিকে একটি মামলায় হাজিরা শেষে নজরুল তার প্রাইভেটকার এক্স করোলা (ঢাকা মেট্রো০ব-১৪-৯১৩৬) দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। শিবু মার্কেট এলাকায় তাদের গাড়ির গতিরোধ করে তাদের অপহরণ করা হয়। জানা গেছে প্যানেল মেয়রের পেছনের গাড়িতেই ছিলেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার। তাকেও ওই সময়ই অপহরণ করা হয়। বেলা ৩টার দিকে পরিবারের সদস্যরা নজরুলের সাথে যোগাযোগ করে তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পেলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে পড়ে। তখন থেকেই তারা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। কিন্তু না পেয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হন। ঘটনার দিনই ওই এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয় এবং নিখোঁজ প্যানেল মেয়র এবং আইনজীবীসহ সবাইকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেয়ার দাবি করা হয়। ঘটনার রাতেই গাজীপুরের শালবন থেকে উদ্ধার করা হয় নজরুলের গাড়িটি। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর নিকেতন এলাকা থেকে উদ্ধার হয় চন্দন সরকারের গাড়ি। যেভাবে উদ্ধার হয় লাশগুলো : স্থানটি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার অন্তর্ভুক্ত। স্থানের নাম মদনগঞ্জের শান্তিনগর এবং চর ধলেশ্বরী। শীতলক্ষ্যা নদীর শেষ প্রান্ত মেঘনার মোহনা। যেখানে জোয়ার-ভাটা দেখে স্থানীয়রা অভ্যস্ত। শীতলক্ষ্যার পানি গিয়ে মিলিত হয় মেঘনায়। পানির একটি ঘূর্ণি থাকে দিনভর। এই স্থানেই গতকাল দুপুরের পর একটি লাশ পানিতে ভাসতে দেখেন স্থানীয় লোকজন। ওই লাশটি দেখে তারা পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধারের সময় সেখানে কচুরিপানার মধ্যে আরো কয়েকটি লাশ ভাসতে দেখেন স্থানীয়রা। পুলিশকে ওই খবর জানানো হলে পুলিশ সেই লাশগুলোও উদ্ধার করে। লাশগুলোর হাত-পা বাঁধা, মুখের পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে ঢাকা। পেছনে মোড়ানো অবস্থায় বাঁধা ছিল হাত। লাশগুলো বস্তাবন্দী করে নদীর পানিতে ফেলে দেয়া হয়। প্রতিটি বস্তায় লাশের সাথে বাঁধা ছিল ১৬ থেকে ২৪টি ইট। প্রথম লাশটি উদ্ধারের পর ওই এলাকা থেকেই কচুরিপানার ভেতরে পাওয়া যায় বাকি পাঁচটি লাশ। এক কিলোমিটারের মধ্যে থেকে লাশ ছয়টি উদ্ধার করা হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে লাশগুলো পেটকাটা ছিল। পাঁচ লাশ শনাক্ত : উদ্ধার করা লাশগুলো ছিল ক্ষত-বিক্ষত। লাশের শরীরের ঘড়ি, আংটি, পরনের প্যান্ট সবই ছিল অক্ষত। তার পরও লাশগুলো শনাক্ত করা ছিল কঠিন। লাশগুলো ফুলে-ফেঁপে পচে গেছে। লাশ উদ্ধারের খবর শুনে নিখোঁজ নজরুলসহ সবার আত্মীয়স্বজন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। মুখের দাড়ি এবং পরিধেয় বস্ত্র দেখে নজরুলের স্ত্রী এবং ভাই আব্দুস সালাম নিহত নজরুলের লাশটি শনাক্ত করেন। এ ছাড়া স্বপন, তাজুল ও নিখোঁজ চন্দন সরকারের ড্রাইভার ইব্রাহিমের লাশ শনাক্ত করেন তাদের আত্মীয়স্বজন। নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপনের লাশ শনাক্ত করেন তার ভাই রিপন। তাজুলের লাশ শনাক্ত করেন তার ভাই আনিস। ইব্রাহিমের লাশ শনাক্ত করেন তার দুই ভাগ্নে আবু বকর ও সাঈদ। সন্ধ্যার পর নারায়ণগঞ্জ হাসপাতাল মর্গে চন্দন সরকারের লাশ শনাক্ত করেন তার ভাগ্নে প্রিয়তম এবং নারায়ণগঞ্জ বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। বাকি একটি লাশ শনাক্তের চেষ্টা চলছে। স্থানীয়রা বলেছেন, বাকি একজনের মধ্যে নজরুলের সঙ্গী লিটন এবং তার গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের লাশ রয়েছে। বন্দর থানার ওসি বলেছেন, উদ্ধারকৃত ছয়টি লাশের মধ্যে চারটি তার আত্মীয়স্বজন শনাক্ত করেছেন। নজরুল এবং তাজুলের পরিধেয় পোশাক ঠিকঠাক ছিল। আর স্বপনের গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা ছিল। তার হাত-পায়ের সব আঙুল কাটা। অন্যগুলোর পরনে প্যান্ট থাকলেও গায়ে ছিল গেঞ্জি। শীতলক্ষ্যা পাড়ে কান্নার রোল : লাশ উদ্ধারের খবর শুনে নিখোঁজ মানুষের আত্মীয়-স্বজনের সাথে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যান শীতলক্ষ্যা পাড়ে। তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন লাশগুলো দেখে। এমনভাবে কেউ কাউকে খুন করতে পারে তা যেন মানুষের চিন্তারও বাইরে। এভাবে এতগুলো প্রাণ একসাথে হত্যা করার দৃশ্যে অনেকেই হতবাক হয়ে যান। নিহতের আত্মীয়স্বজন বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তাদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে শীতলক্ষ্যা তীরের বাতাস। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। সবার চোখ দিয়েই গড়িয়ে পড়ছিল পানি। নজরুলের ছেলে বলেন, এভাবে আর কাউকে যেন না মরতে হয়। নজরুলের স্ত্রী বলছিলেন, এখন আমি বাঁচবো কিভাবে। কী ছিল তার অপরাধ। কেন তাকে এভাবে হত্যা করা হলো। তাদের গগনবিদারী কান্না যেন মিশে যাচ্ছিল শীতলক্ষ্যার বাতাসে। লাশগুলো মর্গে : উদ্ধারকৃত লাশগুলো সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে লাশগুলো তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হবে। যে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফিরছিলেন : নিহত নজরুল নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে একটি মারামারির মামলায় হাজিরা শেষে বাড়িতে ফিরছিলেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই মামলাটির বাদি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের খালাতো ভাই মোবারক হোসেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, চন্দন সরকারের গাড়িটি নজরুলের গাড়ির পেছনেই ছিল। আদালত চত্বর থেকে দু’টি গাড়ি একত্রে বের হয়। হয়তো ওই গাড়ির ড্রাইভার এবং চন্দন সরকার এই অপহরণের দৃশ্য দেখে ফেলেছেন, আর এ কারণেই তাদেরকেও অপহরণ করা হয়েছে। চন্দন সরকারকে অপহরণের আর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। কে এই নজরুল : নিহত নজরুল ছিলেন নারায়গঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র-২। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। ২০০১ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আত্মগোপন করেন। তখন তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তার স্থান হয়নি দলে। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। এরপর তিনি স্থানীয় গডফাদারদের বিরুদ্ধে অপকর্মের প্রতিবাদ করেন। এতে গডফাদারেরা তার ওপর ক্ষেপে যায়। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নুর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন, নিজের চাচা শ্বশুর হাসমত আলী হাসু তার বিরুদ্ধে ছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা : নজরুল ও সঙ্গীরা নিখোঁজ হওয়ার পরে তার স্ত্রী বাদি হয়ে নুর হোসেন, ইয়াসিন, হাসু, ইকবাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ জানায়, ওই অপহরণ মামলাটিই হত্যা মামলায় রূপান্তর হবে। এ দিকে এই ঘটনার পর গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের ডিসি, এসপি, র‌্যাব ১১-এর সিও এবং ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই লাশ উদ্ধার হলো নিখোঁজ ছয়জনের। উত্তাল নারায়ণগঞ্জ : এ দিকে লাশ উদ্ধারের পর উত্তাল হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। যেকোনো সময় এই ক্ষোভ বিস্ফোরণ হতে পারে। আমাদের সিদ্ধিরগঞ্জ সংবাদদাতা মো: এমরান হোসেন বলেন, ঘটনার পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। গত কয়েক দিন ধরেই তারা এই মহাসড়ক অবরোধ করে আসছেন। তবে কয়েক ঘণ্টা পরে তা তুলে নেয়া হ //www.tarunnopratidin.com/national/article-6758#sthash.o2B1z8w4.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন