মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪


হাসান মামুন দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা নিয়ে আরেক কিস্তি
ফেব্রুয়ারী ১০, ২০১৪ হাসান মামুন হাসান মামুন দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা নিয়ে কোনো কোনো চালু মিডিয়ায় এক ধরনের স্পর্শকাতরতা লক্ষ করছি। অতিউৎসাহ দেখিয়ে মিইয়ে যাওয়ার প্রবণতাও দৃষ্টি এড়ায়নি। সেটি কি রায় ‘বেশি কঠোর’ মনে হয়েছে বলে? উচ্চ আদালতের রায় নিয়েও কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগ রয়েছে। এটা তো নিম্ন আদালতের ব্যাপার। এর বিরুদ্ধে আপিলও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ ক্ষেত্রে তার একটি অবস্থান প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদে বক্তব্য রাখার সময়। রায়ে যে পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সে অনুযায়ী ওই ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আলোচিত ‘হাওয়া ভবনের’ সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখার পক্ষপাতী তিনি। একই দিন সরকারপক্ষের এক এমপি সংসদে বলেছেন, কেউ এদেশের ‘সুপার সিটিজেন’ নন। অপরাধে জড়িত হলে সবাইকেই আইনগত পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে। তা তো বটেই। অপরাধে সংশ্লিষ্ট না হয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ যদি অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেন বা তাদের কৃতকর্ম ঢাকতে উদ্যোগী হন, সে ক্ষেত্রেও তাকে এর দায় নিতে হবে। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা তো বটেই, তারপর ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলাকেও বিপথে পরিচালনার চেষ্টা আমরা লক্ষ করি বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে। রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি এর দায় এড়াতে পারেন কিনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উঠতে পারে আরও এ কারণে যে, আমাদের দেশে বর্তমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বড় কোনো ঘটনা তাঁর অজান্তে ঘটার কথা ভাবাও দুষ্কর। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের যেসব ব্যক্তি অভিযুক্ত হয়েছেন আদালতে, তাতে অনেকের চোখ কপালে উঠেছে। তবে একটু মাথা খাটালেই বোঝা যাবে, এটা স্বাভাবিক। নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়ার মতো যুদ্ধাস্ত্র অন্য একটি দেশের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয় সে দেশের সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়কে অন্ধকারে রেখে। এখন প্রশ্ন হল, যারা মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদেরও উপরের কেউ এতে জড়িত ছিলেন কিনা।
অন্য একটি দেশের ভেতর দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয় সে দেশের সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়কে অন্ধকারে রেখে অন্য একটি দেশের ভেতর দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয় সে দেশের সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়কে অন্ধকারে রেখে যদি কোনো সরকারের ‘অঘোষিত নীতির’ আওতায় ওই অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু এর সর্বোচ্চ পর্যায় সেটি জানার কথা। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ওই ধরনের নীতি অনুসৃত হচ্ছিল বলেই কিন্তু অভিযোগ করছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনাচক্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এটি জানা না থাকলেও তার উচিত ছিল দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে প্রমাণ দেওয়া যে, সরকার এর সঙ্গে নেই।
ওই আমলে তদন্তের ধারা, চার্জশিট কিন্তু তা বলছে না। এ মামলায় শুধু নিম্ন পর্যায়ের অপরাধীদের ফাঁসিয়ে উচ্চ পর্যায়ের লোকদের বাঁচিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই বরং ছিল লক্ষণীয়। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বা ঘটনাচক্রে যে দুই পুলিশ সদস্য ওই চালান আটকিয়েছিলেন, তাদের কেমন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তখন– সেটাও এর মধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে। এসব কারণে সংশয়টাই কিন্তু দানা বেঁধে ওঠে। হতে পারে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আসলেই ভয়ঙ্কর ওই অস্ত্র চালানে জড়িত ছিলেন না। এর বদলে হয়তো শুধু অনুমোদন করেছিলেন যে, তার সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের যারা এতে জড়িত, তাদের রক্ষা করা হোক। মারাত্মক ওই ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর ‘সরকারের ভাবমূর্তি’ রক্ষাও তিনি হয়তো জরুরি মনে করেছিলেন। কথা হল, সেটিও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। এমনতরো কাজ করে অনেক ক্ষমতামদমত্ত ব্যক্তিই পার পেয়ে যান বটে কিন্তু ফেঁসে গেলে মুশকিল। তখন রেহাই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা নতুন করে তদন্তের যে কথা উঠেছে, তাতে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে কী জানা যাবে বা আদৌ কিছু জানা যাবে কিনা কে জানে। খোদ প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ উত্থাপনের পর এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হবে কিনা, সে প্রশ্নও তুলতে পারেন যে কেউ। সরকারের ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’ জড়িত বলে এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত কীভাবে করা যেতে পারে, সে বিষয়ে এখন মত দিতে পারেন আইন বিশেষজ্ঞরা। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় এদেশে যে রায় হয়েছে, তার অনুসরণে ভারতও নাকি ঘটনাটি খতিয়ে দেখবে। তাদের নাগরিক, ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সামরিক নেতা পরেশ বড়ুয়ার ফাঁসি হয়েছে রায়ে। উনি কোথায় লুকিয়ে আছেন বা থাকতে পারেন, সে বিষয়ে খবর রয়েছে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ঘটনায় তাকে পলাতক অবস্থায় রেখেই বিচার করবে বলে জানা গেছে। ভারত যা করার করুক, যা বোঝার বুঝুক। কিন্তু আমরা কী করব আর বুঝব? এর আগে বিডিনিউজে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যা লিখেছিলাম, তার উপর পরোক্ষে দেখছি কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, ব্যাপারটি চেপে যাওয়াই উচিত ছিল! এমন মন্তব্য দেখেছি একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধের লেজেও। এটিও বলা হয়েছে, ভারতের স্বার্থেই দেওয়া হয়েছে এ রায়! দেশটিকে খুশি করার চেষ্টা নাকি চলছে।
আরেকজন মন্তব্য করেছেন– ওই অস্ত্রপাতি তো ভারতে ব্যবহৃত হত! অন্যজন এমনটিও বলেছেন, ভারতীয় বিদ্রোহীদের কাছে ওই চালান পৌঁছে দিয়ে দেশটির সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখাটাই দরকারি ছিল। তাহলে তারা বাংলাদেশে কম নাক গলাতেন! এসব মন্তব্য দেখে অবাক হইনি। দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী তো এমন ধ্যান-ধারণা নিয়েই আছে, এভাবেই ঘটনাবলি বিচার করছে। এ প্রসঙ্গে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করা প্রয়োজন মনে করছি। একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে কাজ করার সময় একবার সাবেক বামপন্থী এক তাত্ত্বিকের লেখা নিয়ে কিঞ্চিত ঝামেলায় পড়েছিলাম আমরা। ওই নিবন্ধে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে যা চলছে, তাকে লেখক অভিহিত করেন ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে। কিন্তু পত্রিকাটি সরাসরি এটা বলতে নারাজ। ওই লেখকের মতও পাল্টানো যাবে না। এ অবস্থায় সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের বদলে করে দেওয়া হলো ‘লড়াই’। তাতে সাপ মরল, লাঠিও ভাঙল না। নতুন তদন্তের যে কথা উঠেছে, তাতে খালেদা জিয়া, তারেক ও হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে আদৌ কী জানা যাবে কে জানে নতুন তদন্তের যে কথা উঠেছে, তাতে খালেদা জিয়া, তারেক ও হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে আদৌ কী জানা যাবে কে জানে প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, বেগম জিয়াও উলফা প্রভৃতির কর্মকাণ্ড ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বা ‘যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছিলেন সংসদে। বিএনপির প্রথম সারির কয়েকজন নেতাও নাকি এমনটি বলেছিলেন। শেখ হাসিনা অবশ্য মনে করেন, তারা সন্ত্রাসবাদী। এদেরকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেবেন না, এটা হাসিনার সব সময়ের নীতি। এটি কিন্তু বাংলাদেশের ঘোষিত পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সহকর্মীরা যদি বিপরীত কিছু বলে থাকেন, সেটি এর সঙ্গে বিরোধাত্মক। ২০০৪ সালের এপ্রিলে দেশের ভেতর দিয়ে ভারতে বিপুল অস্ত্র পাচারের যে কাণ্ড হতে যাচ্ছিল, সেটি অবশ্য দ্বিতীয়টির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এও ঠিক, উলফার কর্মকাণ্ডকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ মনে করেও বিএনপি-জামায়াত সরকার পারে তাতে সম্পৃক্ত না হতে। এ ক্ষেত্রে শুধু নৈতিক সমর্থন জোগাতে পারেন তারা। অস্ত্র মামলার ঘটনা কিন্তু বলছে, তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের অন্তত একাংশ ওই কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিল। চাকরিবিধির লঙ্ঘন তো বটেই, সেটি একই সঙ্গে ছিল গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। উচ্চ আদালতেও অবশ্য তা প্রমাণ হতে হবে। তাই বলে যেটুকু প্রমাণ হয়েছে, সেটি উপেক্ষা করা যায় না। বলে দেওয়া যায় না, ‘আজ্ঞাবহ আদালত’ সরকারের পছন্দমতো রায় দিয়েছেন। অনেকেই অবশ্য তা বলে দিচ্ছেন ফটাফট। তার আমির দণ্ডিত হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী এর প্রতিবাদে একটি পূর্ণদিবস হরতালও আহ্বান করেছিল। কিন্তু তা কার্যকর করতে পারেনি আগের মতো। তাদের লাইনটি অদ্ভূত। মামলায় লড়বে, রায়ের ঢালাও নিন্দা করবে; হরতাল ডাকবে, আপিলও করবে! বিএনপি অবশ্য দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা কার্যত এড়িয়েই যেতে চাইছে। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে নতুনভাবে সম্পৃক্ত করা না হলে তারা বোধহয় এ নিয়ে কিছু আর বলবেন না। সরকারও এটা বার কয়েক ভেবে দেখবে– মুখে যা বলা হচ্ছে, সে অনুযায়ী তদন্তে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। দেশে বিএনপি ও বেগম জিয়া, তারেক রহমান প্রমুখের কম জনসমর্থন নেই। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তাদের সম্পৃক্ত করা হলে জনগণের ওই অংশটি তাদের পক্ষে দাঁড়াবে। নেটে যারা উপরোল্লিখিত মন্তব্য করেছেন, করছেন, তারা তখন হয়তো বলে বসবেন– ওই অস্ত্র পাচারে এঁরা জড়িত হয়ে থাকলে ঠিক কাজই করেছিলেন! ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামীদের’ সাহায্য করাই তো উচিত! বৃহৎ প্রতিবেশি, ‘আধিপত্যবাদী’ ভারতকে ব্যতিব্যস্ত বা তার একাংশকে অস্থিতিশীল রাখা কিংবা তাদের যতটা সম্ভব ক্ষতি সাধনই আমাদের কর্তব্য! পাকিস্তানিদের মতো ভারতকে যারা ‘শত্রুরাষ্ট্র’ মনে করেন, তারা মনেই করবেন– ওই অস্ত্র মামলা পরিচালনা করা হয়েছে ভারতকে খুশি করতে। তাদের মতে, ভারতকে বেজার করাই হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য। কেননা ভারতও বাংলাদেশকে বেজার করে চলেছে। তারা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন– পার্বত্য চট্টগ্রামে জনসংহতি সমিতির যে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড চলছিল, তাতে অস্ত্রসহ সব রকম সহায়তা জোগাচ্ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। মুশকিল হল, তারা খেয়াল করছেন না– ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনা ঘটেছিল। সেটি সম্ভব হত না ভারত ওই অঞ্চলে সক্রিয় বিদ্রোহীদের পেছন থেকে সরে না দাঁড়ালে। এর ছয়-সাত বছর পর কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে ধরা পড়ে উলফার কাছে পাচার হতে থাকা দশ ট্রাক অস্ত্র। কাছাকাছি সময়ে বগুড়ার কাহালুতে বস্তায় করে আনা বিপুল পরিমাণ গুলি উদ্ধার হয়, যা যুদ্ধাস্ত্রে ব্যবহার্য। একই সময়ে রাজধানীর উত্তরায় আটক হয়েছিল বেশ কয়েকটি আধুনিক রাইফেল ও রকেট লঞ্চার। প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, বগুড়ার ঘটনারও তদন্ত হবে। অনেকেই বলবেন, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাটির দরকার নেই। তাতে ‘দেশের ভাবমূর্তি’ বিনষ্ট হবে (আর খুশি হবে ভারত)। কী আশ্চর্য, প্রতিবেশি দেশের বিদ্রোহীদের জন্য দেশের মাটি ব্যবহৃত হলে ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না; নষ্ট হয় এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে। আরেকটি মুশকিল হল, এসব ভদ্রলোক তাকাচ্ছেন না পাকিস্তানের পরিণতির দিকে। দেখতে পাচ্ছেন না, আফগানিস্তানে তালেবানের কাছে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোর কারবার করতে করতে খোদ পাকিস্তানে কীভাবে সুলভ হয়ে উঠেছে ওইসব অস্ত্র। তার চাহিদাও সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। সেখানে প্রায় প্রতিদিন যা ঘটছে– বাংলাদেশেও কি আমরা তেমনটি দেখতে চাই? প্রশ্ন তাই শুধু ভারতকে খুশি করা নয়; নিজেকে নিরাপদে রাখারও। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টিই প্রধান উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হবে। শুল্ক-অশুল্ক বাধা টপকে এখানে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী আমরা ভারতে পাঠাব যত বেশি সম্ভব; কিন্তু তাদের বিদ্রোহীদের কাছে অন্য দেশ থেকে কেনা যুদ্ধাস্ত্র মাথায় করে দিয়ে আসব না। এটা তো সৎ প্রতিবেশিসুলভ আচরণও নয়। ভারত তেমন আচরণ না করলে এর কঠোর প্রতিবাদ করব আমরা। ফেলানিকে মেরে সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার প্রতিবাদ কে না করেছে? সে ঘটনায় বিচারের নামে যে প্রহসন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), কে নিন্দা করেনি তার? কিন্তু এর বিপরীতে ট্রলার বা ট্রাক ভরে যুদ্ধাস্ত্র সীমান্তের ওপারে দিয়ে আসা তো সমর্থন করা যায় না। দশ ট্রাক অস্ত্র উলফার কাছে পৌঁছে দেওয়ার যে কর্মকাণ্ডে শামিল হয়েছিল তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের একাংশ, তা বিপজ্জনকও ছিল। বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে অত অস্ত্র কি আদৌ পৌঁছে দেওয়া যেত প্রাপকের কাছে? ওটা ঘিরে যদি একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হত সীমান্তে? চট্টগ্রামে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানার জেটিতে ওই চালান ধরা পড়ে যাওয়াটা ছিল সে তুলনায় ভালো। বেপরোয়া ওই প্রচেষ্টা দেখে মনে হয়, এর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যারা জড়িয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ পরিচালিত হন ‘কনভিকশন’ বা বিশ্বাস দ্বারা। খেয়ে-না-খেয়ে ভারতের ক্ষতি করতে চেয়ে থাকতে পারেন তারা। ইন্টারনেটে যারা দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ঘটনা আটকানোয় বা তার বিচার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তারাও কনভিকশন থেকে সেটি করছেন নিশ্চয়ই। ভারত কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশি, এ পারস্পরিক অবস্থান আমরা বদলাতে পারব না ভারত কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশি, এ পারস্পরিক অবস্থান আমরা বদলাতে পারব না তাদের খুব চিন্তা করে দেখতে বলব, ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহ বা অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে আমরা না হয় সব কিছু করলাম; কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় তা ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারব তো? অন্তত এ অঞ্চলে ভারত ইতোমধ্যে কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ সে রেখেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তার অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ভারত কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রতিবেশি। এ পারস্পরিক অবস্থান আমরা বদলাতে পারব না। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য মিলিয়ে ভারতই আমাদের সবচেয়ে বড় অংশীদার। চোরাপথে আসা তাদের গরু-মহিষে আমাদের কোরবানির হাটও স্থিতিশীল থাকছে। বিচিত্র প্রয়োজনে ভারতেই যাতায়াত সবচেয়ে বেশি। দেশটির সঙ্গে আমরা শেয়ার করছি সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আন্তর্জাতিক নদী। এগুলোর ব্যবহারে ‘ন্যায্য হিস্যা’ নিয়ে বিরোধ অবশ্য রয়েই গেছে। দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারে তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে নিবিড় সহায়তা নিশ্চয়ই এর জবাব নয়। শেখ হাসিনা সরকারের কাজকর্মের হাজারটা সমালোচনা থাকতে পারে; সেটা করতেও হবে। কিন্তু সংসদে উচ্চারিত তার এ উক্তি খুব সঠিক যে, পাকিস্তানের হয়ে ভারতের সঙ্গে কেন ‘খোঁচাখুঁচি’ করব? অবস্থার ফেরে পড়ে কিংবা হীন রাজনৈতিক স্বার্থে অথবা অভ্যাসবশত এক সময় করলেও কেন অব্যাহত রাখব এটি? আমরা কিন্তু এ খোঁচাখুঁচি সামলাতেও পারব না। ভারতীয় ওই অংশে আমাদের বরং চাওয়া উচিত জোর শান্তিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে টেকসই স্থিতিশীলতা। তাতে উত্তর-পূর্ব ভারতে অবকাঠামোসহ জীবনমানের উন্নয়ন হবে। বাড়বে তাদের কার্যকর চাহিদা। বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়িয়ে আমরা বরং এর ফায়দা নিতে চাইব। সস্তায় পর্যটনসেবাও গ্রহণ করতে চাইব ভারতীয় সাত রাজ্যে। হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট। Tags: দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন