বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪


মেধাবিরা দেশ ছেড়ে বিদেশে
20 Feb, 2014 ২০০৭ সালে বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ‘গ্লোবাল হিরো অব দি এনভায়রনমেন্ট’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আবুল হুসসাম। বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ কম, এই বাস্তবতায় প্রায় চার দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। বর্তমানে সে দেশের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তিনি। খাবার পানি থেকে আর্সেনিক মুক্ত করার ফিল্টার উদ্ভাবনের জন্য সাত বছর আগে সম্মানজনক এই পুরস্কার পেয়েছেন আবুল হুসসাম। ‘সনো ফিল্টার’ উদ্ভাবকও বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী। ড. হুসসামের মতো কৃতী বাংলাদেশিরা প্রায়ই তাদের নানা সাফল্যের জন্য সম্মানিত হচ্ছেন নানা দেশে। নানা উদ্ভাবন আর গবেষণায় কৃতিত্ব দেখিয়ে বাংলাদেশকেও পরিচিত করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু গুণী এসব মানুষের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ কেন কিছু করতে পারছে না, সে প্রশ্নও উঠছে। একে মেধা পাচারও বলছেন কেউ কেউ। প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। কারণ বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষায় বাংলাদেশে অবকাঠামো এবং উপযুক্ত শিক্ষকের সংকট আছে। আবার শিক্ষা জীবন শেষে কাক্সিক্ষত চাকরির অনিশ্চয়তাও শিক্ষার্থীদের এই বিদেশমুখী প্রবণতা তৈরি করছে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। ড. হুসসামও তাদেরই একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে রসায়নে স্নাতক এবং পরের বছর ১৯৭৬ সালে স্নাতকোত্তর করার পরেই বাংলাদেশ ছাড়েন হুসসাম। ১৯৮৬ সালে পেনসিলভানিয়ার ইউনিভার্সিটি অব পিটার্সবার্গ থেকে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। পরে ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার রসায়ন বিভাগ থেকে পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনিং করেন তিনি। ১৯৮৫ সাল থেকে কাজ করছেন জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও প্রাণরসায়ন বিভাগে। ইংল্যান্ডে সৌরচালিত হেলিকপ্টার তৈরির গবেষণা যারা করছেন তাদের মধ্যে আছেন দুই বাংলাদেশি বিজ্ঞানী হাসান শহীদ ও সাকির আহমেদ। হাসান শহীদ পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। ১৯৯৬ সালে শিক্ষা জীবন শেষ করে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন একই বিভাগে। পরের বছর উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটিতে। ২০০১ সালে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটিতে সৌর শক্তিচালিত হেলিকপ্টার তৈরির গবেষণায় যোগ দেন তিনি। উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়াকে উৎসাহ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে বিশেষ করে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের দেশে না ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিজ্ঞান চর্চায় বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা নিয়ে শিক্ষাবিদরা উদ্বেগের কথা বলছেন প্রকাশ্যেই। কিন্তু কেউ এই উদ্বেগকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। একে দেশের জন্য অশনিসংকেত হিসেবেই দেখছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান একে আজাদ চৌধুরী। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘চাকরি ও উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা না থাকায় এসব মেধাবী দেশ ছাড়ছেন। তাদের বেশির ভাগই দেশে ফিরছেন না। এতে গবেষণার পাশাপাশি বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষকের সংকট তৈরি হচ্ছে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের যাওয়াকে উৎসাহ দিতে হবে। তবে তারা যেন পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরে আসে সেই পরিবেশটা তৈরি করতে হবে। অর্থনৈতিক সুবিধাকেই মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিদেশে থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি আমাদের রাষ্ট্রের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হচ্ছে।’ তবে প্রতি বছর কী পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যায় এবং তাদের মধ্যে কতজন ফিরে আসে না, সে বিষয়ে ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো হিসাব নেই। এক যুগ ধরে এই হিসাব রাখা বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আগে হিসাব রাখা হলেও এ নিয়ে অবৈধ ব্যবসা গড়ে তোলে একটি সিন্ডিকেট। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। ওই চক্রের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তাও জড়িয়ে পড়েন। এরপর থেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানো ছাত্রছাত্রীদের হিসাব রাখে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে এনে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ইউজিসি। এ জন্য দেশেই স্নাতকোত্তর শিক্ষা গ্রহণে আকৃষ্ট করতে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় বৃত্তির প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে তারা। ইউজিসি বলছে, বাংলাদেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান, জার্মানি, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স যাচ্ছে। সেসব দেশের জীবনমান হয়তো বাংলাদেশে দেয়া কঠিন। কিন্তু ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কথা চিন্তা করে অনেকে ফিরতে পারেন, এমন বিশ্বাসও আছে ইউজিসি চেয়ারম্যানের। ইউজিসি চেয়ারম্যানের এই বিশ্বাস করার মতো উদাহরণ বাংলাদেশেই আছে। খ্যাতিমান কম্পিউটার বিজ্ঞানী মুহম্মদ জাফর ইকবাল যুক্তরাষ্ট্রে বড় চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরেছেন দেশের টানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেন পিএইচডি। ১৯৮৮ সালে বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশন্স রিসার্চ (বেলকো)-এ গবেষক হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি বহুদূর এগিয়েছে। কিন্তু সবাই তো আর জাফর ইকবালের মতো হবেন না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে স্নাতক শেষে ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানে পড়ালেখা শেষ করে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা তার। বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে জার্মানিতে গিয়েছেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। তারও আর ফিরে আসার ইচ্ছা নেই। বিজ্ঞান শিক্ষা বিভাগেই বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। কারণ বাংলাদেশে এখনও সেই অর্থে বিজ্ঞান শিক্ষার ভালো ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। শুধু ইঞ্জিনিয়ারি বা মেডিকেল তথা বিজ্ঞান বিভাগই নয় এর বাইরে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইদানীং বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। স্নাতক শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০০৯ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। ঢাকাটাইমসকে মোস্তাফিজ বলেন, ‘বাংলাদেশে নানা অনিশ্চয়তা আছে। তাই পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ডেই থাকবেন।’ জানতে চাইলে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষার জন্য যারা বিদেশে যান তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চাকরির বাজার সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে অনেকেই তাদের উচ্চ শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে আসবেন।’ উৎসঃ ঢাকাটাইমস Share on facebook Share on email Share on print 1

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন