যুক্তরাষ্ট্র মাত্রাতিরিক্ত অস্ত্র মজুতে প্রথম, অযৌক্তিক আতঙ্কেও প্রথম
14 Feb, 2014
গণমুক্তির অশুভ বিষয়গুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্করটি হচ্ছে যুদ্ধ, কারণ এর মধ্যেই অন্যগুলো নিহিত থাকে বা সৃষ্টি হয়। যুদ্ধেই সেনাবাহিনীর জন্ম; আর তা থেকে হয় ঋণ ও করের সৃষ্টি। আর সেনাবাহিনী, ঋণ ও কর গুটিকতেকের নিয়ন্ত্রণে অন্য অনেককে আনার হাতিয়ার। যুদ্ধের সময়ে, নির্বাহী বিভাগের স্বেচ্ছাচারী মতাগুলোর বিস্তার ঘটে; পদবণ্টন, খেতাব বিতরণ ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রেও তাদের প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়; আর, সেই সঙ্গে জনগণের মতা অবদমনের কৌশলগুলোর সাথে যুক্ত হয় মানুষের চৈত্তিক শ্লীলতাহানির যত অপকৌশল! জেমস ম্যাডিসন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রোপটে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে সুদূরপ্রসারী বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। যেকোনো পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে ভর্তি না করার যুক্তরাষ্ট্রের ১৭৫ বছরের ঐতিহ্যের সমাপ্তি টেনে শান্তিকালেও যুদ্ধপরিকল্পনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাপে গঠিত বিশাল আকারের গোয়েন্দা ও গোপন পুলিশ বাহিনীগুলোকে না ভেঙে আরো সম্প্রসারণ করা হয়। যুদ্ধশেষে সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করার পর সমরসজ্জা শুরু হয়, ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল ও চোখ ধাঁধানো অস্ত্রব্যবস্থার জন্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সামরিক বাজেট বাড়ানো হতে থাকে। আমেরিকার শান্তিকালীন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর স্থায়ী সদস্য সংখ্যা ২০ লাখে ওঠে এবং ‘প্রতিরা ব্যয়’-এর মাধ্যমে অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ার ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার ফলে আমেরিকা বিশ্বকে সেনাছাউনিতে পরিণত করতে সম ‘সামরিক রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ ও ট্রুম্যান মতবাদ, কমিউনিজমবিষয়ক, আমেরিকাকে বিশ্বের পুলিশ বাহিনীতে পরিণত করে (যদিও ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে এবং বিশ্বের কোথাও কমিউনিজমের অস্তিত্ব নেই, তবুও এই নীতি বহাল রাখা হয়েছে)। কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক সমালোচনা কখনোই সহনীয় মাত্রার বেশি হয় না। এসব আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নীতিমালার অর্থ হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। ফলে যুদ্ধশিল্প-ব্যবস্থার প্রতি ‘দ্বিপীয়সুলভ’ সমর্থন অব্যাহত থাকে, যা গঠনমূলক আলোচনা ও আমাদের যুদ্ধোত্তর পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্যক্রমের সমালোচনার পথ বন্ধ করে দেয়। আমেরিকাকে একটি ‘সামরিক রাষ্ট্রে’ পরিণত করার ফলে দেশটির অভ্যন্তরীণ মারাত্মক সমস্যাগুলোর দিকেও নজর দেয়ার অবকাশ থাকেনি। অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারগুলো জনগণের চাহিদা থেকে দূরে সরে গিয়ে প্রতিরা বিভাগ তথা সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সে দৃঢ়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে এখনো আমাদের তাড়া করে ফিরছে এবং প্রতিরার যৌক্তিকতা ক্রমাগত আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।
সংবিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই এই প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর ঘটে গেছে। জনগণের মধ্যে বিতর্ক ও তাদের তেমনভাবে ল করার আগেই মোটামুটিভাবে এটা হয়ে গেছে। এটা অভ্যুত্থানের মতো, যা আমেরিকান সংস্কৃতিকে সামরিকীকরণ করেছে। এসব ইস্যু নিয়ে বড় ধরনের নির্বাচনগুলোতে কোনো জয়-পরাজয় হয়নি, কংগ্রেসে ব্যাপক কোনো বিতর্ক হয়নি; অথচ স্নায়ুযুদ্ধকালে সরকারের প্রস্তুতি আমেরিকান রাজনৈতিক শক্তির ল্য বদলে ফেলেছে।
সরকারি মিশনে এই পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণের ল্েয আমেরিকান করপোরেশনের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ ঘটে। আমাদের ‘গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ’ রায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। করপোরেট স্বার্থকে বিশ্বজুড়ে সামরিক স্বার্থ সমর্থন করে। একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এখন একক বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরা চুক্তিগুলোর মাধ্যমে বেতনভোগী সিনিয়র সামরিক ব্যক্তিত্ব, প্রতিরা আমলা, প্রতিরা শিল্প-নির্বাহী, কংগ্রেসের ভেতর ও বাইরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা অস্ত্র, স্থায়ী বাহিনী, প্রকৃত বা কাল্পনিক হুমকি ও প্রলম্বিত সঙ্ঘাত প্রশ্নে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরিবেশে একত্রে কাজ করেন। তারা এখন আমেরিকান সামরিকতন্ত্রের জন্য আবদ্ধ এক পরিমণ্ডলে স্বনিয়োজিতভাবে কাজ করছেন, মতার শীর্ষভাগের ক্রমবন্ধনে তারাই একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হন। সঙ্ঘাতের ব্যাপারে তাদের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো তাদেরই স্বার্থপূরণ করে, কারণ তারা তাদের মতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি আন্তর্জাতিক ঘটনায় কলকাঠি নাড়েন। অনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র প্রতিযোগিতার জন্য যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ঠিক তেমনি আমেরিকান সমাজতত্ত্ববিদ সি. রাইট মিলস যখন বলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্য কারণ হচ্ছে এর প্রস্তুতি’ তখন তাতে সত্যের অনেক উপাদান পাওয়া যায়।
সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সে দুর্নীতি থাকলেও তা ততটা ভীতিকর নয়, যতটা ভয়াবহ হচ্ছে যুদ্ধের জন্য উকালতি, যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারের বিরুদ্ধাচরণের প্রবণতা। প্রতিরা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল খাতগুলোর সম্প্রসারণের ফলে জনগণের মনোজগতের সতেজতা ঝিমিয়ে পড়ছে এবং এতে করে সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের শক্তি ও বিকাশ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মাধ্যমটি নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। ফেডারেল সরকারের ওপর সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ, রাজ্যগুলোর অধিকার, সমালোচনাপ্রবণ নাগরিকেরা - এগুলোর সবই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে আমেরিকান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সমাবেশে এই ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে।
এটা অত্যন্ত ভাবনার ও শিণীয় বিষয় যে আমেরিকার সেরা দুই সামরিক নেতা জর্জ ওয়াশিংটন ও ডুয়াইট আইজেনহাওয়ার, উভয়েই পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, বিদেশে সামরিক ফাঁদে না পড়ার ব্যাপারে আমাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। বিদায়ী ভাষণে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার ‘বিপুল সামরিক প্রভাব-বলয় ও বিশাল অস্ত্র শিল্পের সম্মিলনের’ দিকে জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন ‘সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের অন্যায্য প্রতিপত্তি, দাবি করেই হোক বা না করেই হোক, অর্জন ঠেকাতে হবে। অপাত্রে স্থাপিত শক্তির ভয়ঙ্কর উত্থান ও তা অব্যহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।’ তারপর থেকে কোনো প্রেসিডেন্টই সমস্যাটি স্বীকার করেননি। আমরা এসব মহান নেতার হুঁশিয়ারির প্রতি কর্ণপাত করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং এখন আমাদের সামরিক রাষ্ট্র আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।
এই সমস্যার বৃহত্তর অংশ হচ্ছে প্রতিরা বাজেটের প্রাথমিক আকার। ১৯৩০-এর দশকে ফেডারেল বাজেটের ১০% থেকে ১৫% যেত জাতীয় প্রতিরায়; ১৯৬০-এর দশকে তার পরিধি দাঁড়ায় ৫৫% থেকে ৬৫%, যদিও মধ্যবর্তী সময়ে সামাজিক অগ্রগতির বিপুল সম্প্রসারণ ঘটে। এর প্রতিফলন ঘটে, ১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকের বার্ষিক ব্যয় ৭৫৯ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৯৩৯ সালে এক বিলিয়ন ডলারে এবং ১৯৭০ সালে ৭৭ বিলিয়ন ডলার ও ২০০৭ সালে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হওয়াতে।
স্নায়ুযুদ্ধের সর্বোচ্চ অবস্থায় আমরা আমেরিকার প্রতিটি শিশু, নারী ও পুরুষের জন্য প্রতিরা খাতে ৪০০ ডলার করে ব্যয় করেছি। অথচ একই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যয় করেছে মাত্র ২৩০ ডলার (জাতীয় ক্রয়মতা অনুযায়ী), গ্রেট ব্রিটেন ১০০ ডলার, ফ্রান্স ১২৩ ডলার, পশ্চিম জার্মানি ১০৩ ডলার, চীন ৯ ডলার! আমরা সত্যিই ‘বিশ্বে প্রথম’ - প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভয়াবহ সব অস্ত্র মজুতে প্রথম, অপচয়মূলক বাড়াবাড়িতে প্রথম এবং বিদেশী শত্রুর অযৌক্তিক আতঙ্কেও প্রথম।
(চলবে)
* সিনেটর মাইক গ্রাভেল ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এটি তার সিটিজেন পাওয়ার গ্রন্থের আমেরিকান ইম্পেরিলিজম থেকে নেয়া।
উৎসঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত
Share on facebook Share on email Share on print
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন