শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪


ভয়ঙ্কর অপরাধে ইয়াবাসেবীরা
22 Feb, 2014 রাজধানীর চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত নিহত দম্পতির বড় মেয়ে ঐশী রহমান স্বীকার করেছে, ইয়াবার টাকা না পেয়ে সে তার বাবা-মাকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের 'ও' লেভেলের ছাত্রী ঐশী এখন কারাগারে বন্দী।রাজধানীর উত্তরায় আমেনা বেগম ও খাদিজা বেগম নামে দুই তরুণীর খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেফতার হন পাঁচ যুবক। পুলিশের কাছে এরা শিকার করেন, দুজনকে শ্লীলতাহানি করার পর তাদের হত্যা করা হয়। এরপর লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে ফেলে রাখেন রাস্তার ধারে। এ খুনিরা ইয়াবাসেবী। পূর্ব জুরাইনের মেডিকেল রোডের একটি বাড়িতে ইয়াবার টাকা না পেয়ে ঘুমন্ত লাবণীর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন স্বামী চান বেপারি। লাবণীর শরীরের ৫৩ থেকে ৫৫ ভাগ পুড়ে গেছে। এ ধরনের রোগী খুব ঝুঁকির মধ্যে থাকে। যে কোনো সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে।নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর এমন সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন ইয়াবাসেবীরা। মরণনেশা ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে এখন শুধু ছিনতাই বা চুরিতেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ নেই; খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবই নয়, প্রিয় বাবা-মা বা পরিবারের প্রিয় মানুষকে খুন করতেও দ্বিধা করছেন না তারা। রাজধানীসহ সারা দেশে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি এই নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ সামাজিক নানা অপরাধের মাত্রাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। ইয়াবাসেবীদের নিষ্ঠুর আচরণে উদ্বিগ্ন অভিভাবক মহল। তেমনি ইয়াবাসেবীদের হাতে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটায় ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেশার জগতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ইয়াবা সেবনকারীদের হাতেই এখন অপরাধ বেশি হচ্ছে। তাদের হাতে যারাই খুন হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনাই নৃশংসতায় ভরা। নিষ্ঠুর আচরণের মধ্য দিয়ে তারা খুনের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন। খুন সংঘটিত করতে ধারাল অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এটি সেবনে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ বৃদ্ধি, হজমশক্তি নষ্ট, শরীর দুর্বল হয়ে পড়া, পিঠে ব্যথা, ফুসফুস ও কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মনে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তার উদ্ভব হতে পারে। এ ছাড়া এটি আচরণগতভাবে সহিংস করে তুলতে পারে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে একসময় দামি গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে ধনীর দুলালেরা রাস্তায় নেমে পড়ত। তারা পথচারীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিত। এমন অনেক ছেলেমেয়েই ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু এখন ইয়াবাসেবীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও তারা জড়িয়ে পড়ছেন। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে একাই খুন করেছে তাদের মেয়ে ঐশী রহমান। নিহত পুলিশ কর্মকর্তার দেহে ছুরিকাঘাতের দুটি এবং তার স্ত্রীর দেহে ১১টি চিহ্ন ছিল। ঐশী এতটাই নৃশংস হয়ে পড়েছিল যে হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখেই তার প্রমাণ মেলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ নিহত এ দম্পতির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। তিনি বলেন, পুলিশ পরিদর্শককে ছুরি মারা হয় গলায়; এতে শ্বাসনালি কেটে মৃত্যু হয় তার। স্বপ্না বেগমের গলায় দুটি, ডান পাঁজরে তিনটি, বুকে একটি এবং পেটে ও পিঠেও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এতে তার লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শ্বাসনালি কেটে যায়। আরও নৃশংসতা : উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ ৩১ জানুয়ারি উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর বাড়ির পেছনের নির্জন স্থান থেকে বস্তাবন্দী (দ্বিখণ্ডিত) খাদিজার লাশ উদ্ধার করে। তার শরীরের ওপরের ও নিচের অংশ কেটে আলাদা করা ছিল। অন্যদিকে, ১২ জানুয়ারি উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের একটি বাড়ির পেছনের ময়লা-আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় আমেনার বস্তাবন্দী লাশ। পরে স্বজনরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। এ দুটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশকে খুব বেগ পেতে হয়। উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার রেজাউল হাসান জানান, ১৮ দিনের মাথায় দুই মহিলার বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার নিয়ে থানা পুলিশ পড়েছিল মহাবিপাকে। কারণ দুটি হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু ছিল না। তবে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় উত্তরার ২০ নম্বর সড়কের নির্মাণাধীন ছয় তলা ভবনের কেয়ারটেকার আল মামুনকে। ৯ ফেব্রুয়ারি মামুন খাদিজা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। আর তার দেওয়া তথ্যমতে ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় রকিব আহমেদ ওহাবকে। রকিব পেশায় জমির দালাল। বাসা উত্তরায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনিও ঘটনার কথা স্বীকার করে একই ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য তিনজনকেও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার সাব-ইন্সপেক্টর জাফর ইকবাল জানান, গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তারা পাঁচজনই ইয়াবা আসক্ত। প্রায়ই তারা গভীর রাতে মহিলাদের কৌশলে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা আমেনা ও খাদিজাকে বেশি টাকা বেতনের লোভ দেখিয়ে বশ করেন। ২৬ জানুয়ারি রাতে খাদিজাকে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দী করে নির্মাণাধীন বাড়ির নিচ তলার একটি বাথরুমে রেখে দেন। বস্তায় ভরার আগে তারা লাশ ধারাল অস্ত্র দিয়ে কয়েক টুকরো করেন; যাতে কেউ তাকে না চিনতে পারে। এরপর বস্তাবন্দী খাজিদার লাশ ফেলে দেওয়া হয় ৩০ জানুয়ারি রাতে; যা পর দিন পুলিশ উদ্ধার করে। অন্যদিকে আমেনাকে হত্যা করা হয় ৬ জানুয়ারি। লাশ ফেলতে বের হলে মহল্লার কয়েকটি কুকুর তাদের পিছু নেয়। এ অবস্থায় তারা ওই দিন লাশ ফেলতে পারেনি। ঘটনার পাঁচ দিন পর বস্তাবন্দী লাশ রাস্তার পাশের ড্রেনে ফেলে রাখেন। পুলিশ ১২ জানুয়ারি আমেনার লাশ উদ্ধার করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সালমা আকতার নেশার আসক্তিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার পেছনে বর্তমান সামাজিক অবস্থাকেই দায়ী করলেন। তিনি বলেন, সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে কি না এ বিষয়ে খোঁজখবর বাড়াতে হবে বাবা-মায়েদের। শিক্ষকদেরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। আগে শিক্ষকরা শ্রেণীর বাইরে গিয়েও অনেক দায়িত্ব পালন করতেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীকে ভালো শিক্ষাটাই দিতেন। এখন আর তা লক্ষ্য করা যায় না। তিনি বলেন, পারিবারিক বন্ধন আরও জোরদার করতে হবে। সন্তানরা যদি বাবা-মায়ের কাছে কোনো কিছু শেয়ার করতে না পারে, তাহলে তারা বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকে তখন তারা মাদকে আসক্ত হয়। তিনি বলেন, মাদক ব্যবসাও এ দেশে এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে থাকলে মাদকের ব্যবহারও অনেক কমে যাবে। এ বিষয়টি অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের দেখা উচিত। উৎসঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন Share on facebook Share on email Share on print 1

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন