শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪


বাংলাদেশে যৌন সংস্কৃতি ও ফুকো দর্শনের পুনঃপাঠ ১৫ ফেব্রুয়ারি,২০১৪
খন্দকার রাক্বীব পৃথিবীর জ্ঞানতাত্ত্বিক রাজ্যের সমস্ত ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’কে তছনছ করে দেওয়া হাল আমলের সবচাইতে আলোচিত-সমালোচিত উত্তরাধুনিকতাবাদী দার্শনিক মিশেল ফুকো ব্যক্তিজীবনে ছিলেন একজন সমকামী। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বিকৃত যৌনাচারী এই ব্যক্তি নিজ সমাজের যৌন সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নিতে বাধার সম্মুখীন হয়ে যৌনদর্শনের উপর তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’ লিখেন। তিন খণ্ডে রচিত এই বইয়ে মূলত তিনি ‘রিপ্রেসিভ হাইপোথসিস’র মাধ্যমে যৌনতাকে ‘ডিসকোর্স’ আকারে হাজির করে ক্ষমতা প্রশ্নে এর ঐতিহাসিক আর দার্শনিক প্রেক্ষাপট হাজির করেছেন। ডিসকোর্সকে ডিসকাশন থেকে আলাদা করে সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে ফুকো বলেন, ‘ডিসকাশন’ হচ্ছে কোন একটা বিষয়ের আগ-পর নিয়ে যা বলা হয়েছে তার আলোচনা করা। আর ‘ডিসকোর্স’ হচ্ছে এই বিষয়টা নিয়ে কে কথা বলছেন, কেন বলছেন, কিভাবে বলছেন, কার জন্য বলছেন, ইত্যাদি সব বিষয়ে বয়ান হাজির করা। সেই হিসেবে তিনি যৌনতাকে একটা ডিসকোর্স আকারে ব্যাখ্যা করে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পশ্চিমা সমাজের মানুষের যৌনচর্চার বিভিন্ন ধরণ নিয়ে আলোচনা করেন। শেষতক তিনি এই সারমর্মে উপনীত হন যে, ‘যৌনতা’ বিষয়টি মূলত চাপিয়ে দেওয়া এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পায়নের শুরুতে বুর্জোয়া তথা হেজেমনিক শ্রেণি নিজেদের ক্ষমতাবলেই এই ডিসকোর্সকে ‘বিয়ে এবং পরিবার’ এর মধ্যে আবদ্ধ করে চাপিয়ে দেয়। পরিবার আর বিয়ের মোড়কে যৌনতার বিষয়টি হয়ে পড়ে একান্তই ব্যক্তিগত, আর ‘প্রাইভেট’। ফলে ‘বিয়ে এবং পরিবার’ নামক ইন্সটিটিউশনটি যৌনতার ডিসকোর্সে ‘এক্সক্লুসিভ অথরিটি’ হিসেবে হাজির হয়। ক্ষমতা প্রশ্নে বিবাহবহির্ভূত যৌনচর্চাকারী দলিত গোষ্ঠী (সমকামী, বেশ্যা) হয়ে পড়ে প্রান্তিক। এই দলিত গোষ্ঠীর অনেকেই জড়িয়ে পড়ে পতিতাবৃত্তিতে আর অধিকাংশ-ই আক্রান্ত হয় মানসিক রোগে। তাই যৌনতার প্রশ্নে হেজেমনিক গোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া ‘বিয়ে’ নির্ভর যৌনচর্চার দর্শনের বিরুদ্ধে হাজির হন ফুকো, আর কথা বলেন সমকামী আর বেশ্যাদের ক্ষমতার্জনের মাধ্যমে নিজেদের যৌনচর্চার অধিকার আদায়ের পক্ষে। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মারা গেছেন ফুকো। যৌনদর্শনের ক্ষমতার প্রশ্নে ‘বিয়ে আর পরিবার’ ইন্সটিটিউশনকে ফুকো আর তার উত্তরসূরিরা আমাদের সমাজে ভাঙতে অনেক সচেষ্ট হয়েছেন। আসলে ফুকোর আবির্ভাবের অনেক আগ থেকেই বহু বৎসর যাবৎ ‘পরিবার’ আর ‘বিয়ে’বহির্ভূত যৌন সংস্কৃতি চালুর সংগ্রাম চলছে। ফুকো এর দার্শনিক মাত্রা যোগ করেছেন মাত্র। ফুকোরা নিজেদের সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। পশ্চিমা সমাজে বিয়ে আর পরিবার এখন বলতে গেলে প্রায় ভঙ্গুর। এখনকার ভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা পশ্চিমা পরিবার প্রথা হয়তো নিজের-ই প্রয়োজনে টিকে রয়েছে, টিকেও থাকবে। আমাদের বাংলাদেশের পরিবার প্রথা অনেক শক্তিশালী। পরিবার কেন্দ্রিক গড়ে উঠা উন্নত কালচারের কারণেই পৃথিবীর পশ্চিমা অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় আমরা মানসিক দিক থেকে অনেক সুখী। অমর্ত্য সেন আমাদের সুখী হওয়ার এই দিকটা নিয়ে লিখেছেনও। যৌনতার ডিসকোর্সকে যতভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়, যৌনতা প্রশ্নে বিয়ে এবং পরিবার প্রথার বাইরে এখন পর্যন্ত কোনো শ্রেষ্ঠ বিকল্প ইন্সটিটিউশন পৃথিবীতে তৈয়ার হয় নাই। যৌনতা প্রশ্নে আমাদের বিয়ে আর পরিবার প্রথা এখন গুঁড়িয়ে ফেলার পাঁয়তারা চলছে। বিয়ের বয়স বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। সমকামীদের অধিকারের জন্য আলোচনা করা হচ্ছে। হেজেমনিক মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে যৌন সংস্কৃতি। বিয়ের বয়স প্রশ্নে বঙ্কিমের ইন্দিরা উপন্যাসের মাধ্যমে শুরু হওয়া সোশ্যাল ডিসকোর্স নানাবিধ উপন্যাস, চলচ্চিত্র আর মিডিয়ার মাধ্যমে এখন প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। হেজেমনিক মিডিয়ার কল্যাণে বিয়ে প্রথাকে আড়াল করে প্রেম করতেই হবে, এ রকম চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে একটা বিশাল প্রজন্মের। গার্লফ্রেন্ড না থাকলে অনেক ছেলেই আজ ‘বোকা’। আবার ‘বয়ফ্রেন্ড’ না থাকলে অনেক মেয়েই ‘আনস্মার্ট’ হয়ে যায় একটা প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে। নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল আর প্রেমের গল্পে ডুবে থাকলে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করতে পারলে ওরা কীভাবে বুঝবে এইসব ছ্যাবলাইমোশনের আউটকাম সবচাইতে ভালো ক্ষেত্রে পারস্পরের উপরে বোর হয়ে যাওয়া, পরকীয়া করা। আর না হয় হারিয়ে ফেলা চরিত্র ও শরীরের অমূল্য কিছু জিনিস, ইউটিউবে ভিডিও হয়ে যাওয়া। তাই বলে আমি মানুষের প্রেমকেন্দ্রিক এই জৈবিক চাহিদাকে খাটো করছি না; আসলে এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে একে খাটো করার প্রশ্ন-ই আসে না। আমরা চাই যৌনতা প্রশ্নে বিয়ে নামক প্রথার মাধ্যমে এই প্রেমের সিস্টেমকে পরিবার কেন্দ্রিক ইন্সটিটিউশনালাইজড করা হোক। আমাদের বাবা বা তাদের পূর্ব প্রজন্মরা ঠিক-ই অল্প বয়সে বিয়ে করেছেন, যদদরুণ যৌনতা কেন্দ্রিক সমস্যায় তারা খুব কম-ই সম্মুখীন হয়েছেন। যৌনতা কেন্দ্রিক সামাজিক সমস্যাও ছিল তখন খুব কম। এখনকার সময়ে হেজেমনিক মিডিয়ার মাধ্যমে একটা শ্রেণি বিয়ে প্রথাকে করে ফেলছে কঠিন। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম যৌনতার প্রশ্নে স্বাভাবিক-ই ছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মও হয়ে উঠবে স্বাভাবিক। মাঝখানে হেজেমনিক মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের এখনকার প্রজন্মটা যৌন সংস্কৃতির কঠিন নিয়মরীতির ভিতর হয়ে পড়ছে অবরুদ্ধ। ফলত মানসিক সমস্যা বাড়ছে বহুগুণ, কমে যাচ্ছে এই প্রজন্মের প্রোডাক্টিভিটি। হাল আমলে পশ্চিমা সমাজের তৈয়ার করা যৌনতার ডিসকোর্স আমাদের দেশে হেজেমনিক মিডিয়ার কল্যাণে একদিকে যেমন বিয়ে কেন্দ্রিক যৌনচর্চা কঠিন করে দিচ্ছে, অন্যদিকে সহজ করে দিচ্ছে বিয়েবহির্ভূত যৌনচর্চার সকল দ্বার। পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, পরকীয়া কেন্দ্রিক ডিভোর্স বাড়ছে আর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের মানসিক প্রশান্তি আর সামাজিক মূল্যবোধ তৈরির জায়গাগুলো। সেদিন বাংলাদেশের যুবসমাজের ওপর আচরণগত বেইজলাইন সার্ভে শীর্ষক এক গবেষণায় দেখলাম, বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ষাটের দশকের তুলনায় বর্তমানে বিবাহবহির্ভূত ও বিবাহপূর্ব অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পরিমাণ তিনগুণ বেশি। বর্তমানে প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনকেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। আমি গত ৬-৭ বছরে আমার নিজ বৃহৎ আত্মীয়বর্গের মাঝে পরকীয়া কেন্দ্রিক ১৫টির উপর বিয়ে ভেঙে যেতে দেখেছি। সুতরাং বলা চলে, যৌনতা প্রশ্নে আমাদের একটা সুষ্ঠু সমাধানে আসা উচিত। এক্ষেত্রে হেজেমনিক মিডিয়া কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া যৌনসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা জরুরি। ফুকো যে গ্রাউন্ডে পরিবারকেন্দ্রিক যৌনসংস্কৃতির সমালোচনা করেছে, আজ এক-ই গ্রাউন্ডে পরিবারকেন্দ্রিক বয়ানে ফুকোরা হেজেমনিক, আমরা দলিত। আমরা চাই পরিবার আর বিয়ে কেন্দ্রিক যৌন সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশ। পাদটিকা: ছোট্ট সিয়াম (১০) আর সিনান (৭)- এর কষ্ট দেখে লেখাটি লিখতে বসলাম, যাদের মা তিন বছর আগে পরকীয়া করে অন্যত্র চলে গেছে। আল্লাহ এই অবুঝ বাচ্চাদের সহায় হোন। লেখক: খন্দকার রাক্বীব, গবেষক raquib_bdf@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন