দশ ট্রাক: সেই রাতের কথা
মিন্টু চৌধুরী ও মিঠুন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 2014-01-30 10:17:01.0 BdST Updated: 2014-01-30 16:38:11.0 BdST
Previous Next
দশ বছর আগে চট্টগ্রামের সিইউএফএল জেটিঘাটে বিপুল পরিমাণ আধুনিক মারণাস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আটকে দেয়ার যে ঘটনাটি ঘটে, তার শুরুটা হয়েছিল অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির ফোনে।
Print Friendly and PDF
2
1
902
Related Stories
গুলি থেকে রকেট লঞ্চার, সবই ছিল ট্রাকে
2014-01-29 22:16:07.0
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি যারা
2014-01-29 21:55:34.0
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা: আসামি ঘাটশ্রমিক থেকে মন্ত্রী
2014-01-29 21:53:44.0
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল, মধ্যরাত। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সিইউএফএলের সংরক্ষিত জেটিঘাটে অতি গোপনে ট্রলার থেকে নামিয়ে ট্রাকে তোলা হচ্ছিল বাক্সভর্তি অস্ত্র।
ঠিক তখন প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নদীর উত্তর পাড়ে বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির ফোন বেজে ওঠে।
সেই রাতে ঘটনাস্থলে ছিলেন কর্ণফুলী থানার বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির সেসময়ের হাবিলদার গোলাম রসুল, ফাঁড়ির ইনচার্জ সার্জেন্ট মো. আলাউদ্দিন ও পতেঙ্গা থানার কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন।
তিনজনই পরে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দেন।
২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে হাবিলদার গোলাম রসুল বলেন, রাত আনুমানিক পৌনে ১১টায় ফাঁড়িতে একটি টেলিফোন এলে তিনি নিজের পরিচয় দেন।
“তখন ওই প্রান্ত থেকে বলে- হাবিলদার সাহেব, সিইউএফএল জেটিঘাটে গিয়ে দেখেন ক্রেনের সাহায্যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ট্রাকে লোড করা হচ্ছে। কে কথা বলছে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে সে কিছু না বলে ফোন রেখে দেয়।”
সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি টেলিফোনে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে জানান হাবিলদার রসুল। ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হওয়ার পর পথেই সার্জেন্ট আলাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। এরপর আলাউদ্দিনের মোটর সাইকেলে চড়েই দুজন রওনা হন ঘাটের দিকে।
গোলাম রসুল আদালতে বলেন, জেটিঘাটে পৌঁছে অনেক লোকজন, বাক্স ভর্তি দুটি ট্রলার, সাতটি ট্রাক ও একটি ক্রেন দেখতে পান। ক্রেন দিয়ে ট্রলার থেকে নামিয়ে বাক্সগুলো তোলা হচ্ছিল ট্রাকে।
“শ্রমিকদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলে- এগুলো মেশিনারি পার্টস। মালিক আশেপাশেই আছে।”
কিন্তু রসুল আর আলাউদ্দিন অনেক খুঁজেও জেটিঘাটে মালামালের মালিককে পাননি বলে আদালতকে জানান।
২০১২ সালের ২৯ আগস্ট আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে সার্জেন্ট আলাউদ্দিন বলেন, মালিককে খুঁজে না পেয়ে তিনি ফোন করেন পুলিশের তৎকালীন উপ-কমিশনার (ডিসি, বন্দর) আবদুল্লাহ হেল বাকীকে।
“ডিসি বলেন, কোনো ট্রাক যেন মালামালসহ ঘাট থেকে বের হতে না পারে। কয়লার ডিপো ফাঁড়ির সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন ও কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমানকে ঘটনাস্থলে পাঠাচ্ছি।”
রাত ১২টা ১০মিনিটে বেতার যন্ত্রে আবদুল্লাহ হেল বাকীর নির্দেশ পেয়ে ঘটনাস্থলে যান সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন, যোগ দেন রসুল আর আলাউদ্দিনের সঙ্গে।
ঘাটের কাছেই এক চায়ের দোকানের সামনে সাত-আট জনের জটলা দেখতে পেয়ে এগিয়ে যান তিন পুলিশ সদস্য। সে সময় ওই জটলার মধ্য থেকে দুই ব্যক্তি এগিয়ে এসে সার্জেন্ট আলাউদ্দিনের সাথে কথা বলেন।
আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে আলাউদ্দিন বলেন, ওই দুইজনের মধ্যে একজন নিজেকে হাফিজুর রহমান ও অন্যজন উলফা নেতা আবুল হোসেন বলে পরিচয় দেয়।
“হাফিজুর রহমান আমাকে রেগে গিয়ে বলেন- এগুলো অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সরকারের সকল এজেন্সি এ বিষয়ে অবগত আছে। তোরা এখান থেকে চলে না গেলে তোদের ক্ষতি হবে।”
এরপর হাফিজুর মোবাইলে কোনো এক ব্যক্তিকে ফোন করেন এবং স্যার সম্বোধন করে বলেন- “এখানে কিছু পুলিশ আছে, তাদের চলে যেতে বলেন।”
সার্জেন্ট আলাউদ্দিন বলেন, “এরপর আমার দিকে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে হাফিজুর বলে- ‘কথা বল, তোর বাবা এনএসআইয়ের ডিজির সাথে’।”
আলাউদ্দিন কথা বলতে রাজি না হলে আবুল হোসেন বলেন, “তোরা এখান থেকে চলে যা। পরে জানতে পারবি আমি কে?”
হাফিজুর ও আবুল হোসেনের হুমকিতে ‘বিচলিত’ হয়ে একটু দূরে গিয়ে আবার উপ-কমিশনার আবদুল্লাহ হেল বাকীকে ফোন করেন সার্জেন্ট আলাউদ্দিন। বাকী তাকে বলেন, জেটিঘাট থেকে যাতে কোনো ট্রাক বের হতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এর কিছুক্ষণ পর আরো পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমান। হাফিজুর ও আবুল হোসেন ওসির সঙ্গে কথা বলে নিজেদেরই অস্ত্রের মালিক বলে দাবি করেন।
ওসিসহ পুলিশ সদস্যের দেখে ঘাটের শ্রমিকরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে।
এরপর আবদুল্লাহ হেল বাকীর নেতৃত্বে পুলিশের আরো একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
তবে এর ফাঁকে সরে পড়েন হাফিজুর।
সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন আদালতে বলেন, “আবুল হোসনকে নিয়ে আমি ও সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ডিসি মহোদয়ের কাছে যাই। একটু দূরে গিয়ে ডিসি আবুল হোসেনের সঙ্গে আলাপ করতে থাকেন। তখন আবুল হোসেন মালামাল ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ দেয়।”
আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা শেষ করে ডিসি আবদুল্লাহ হেল বাকী আবার পুলিশ সদস্যদের কাছে এসে কথা বলতে থাকেন। এর কিছুক্ষণ পর আবুল হোসেনও সরে পড়েন।
ভোরের দিকে আটক দশ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনে নিয়ে আসা হয়।
এনএসআইয়ের সাবেক উপ-পরিচালক (টেকনিক্যাল) মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেনই ঘটনার রাতে নিজেকে আবুল হোসেন পরিচয় দেন বলে আদালতে দাবি করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কামাল উদ্দিন আহাম্মদ।
গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রাম কারাগারে করা টিআই প্যারেডে মেজর (অব.) লিয়াকতকে ওই রাতের আবুল হোসেন বলে শনাক্ত করেন দুই পুলিশ সদস্য।
তদন্তে দেখা যায়, চীনে তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য আনা হয়েছিল; বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল এই চালান।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের ওই ঘটনায় অস্ত্র এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা দুটি মামলায় তখনকার শিল্পমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপি নেতা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র সাবেক দুই প্রধানসহ মোট ৫২ জনকে আসামি করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন