শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৪


রায় নিয়েই জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে চায় সরকার।
এজন্য আটঘাঁট বেধে নামা হচ্ছে। যাতে করে ভবিষ্যতে আইনি বা অন্য কোনো জটিলতার সুযোগ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ও সহিংস বিরোধিতাকারী এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী যাবতীয় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টির মূল অপশক্তি দলটি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বুধবার বাংলানিউজকে বলেন, সরকার জামায়াতকে এখন আর রাজনৈতিক দল বলে গণ্য করছে না। একে এখন সন্ত্রাসী সংগঠন বা জঙ্গিবাদী সংগঠন বলেই ধরা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং হাইকোর্টের রায়েও জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠনই বলা হয়েছে। তবে জামায়াত নিষিদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আদালতের রায়ের মাধ্যমে আসাই ভালো।
তৃতীয়বারের মতো সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরদিন রোববার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জামায়াত নিষিদ্ধ করা হবে কি না সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালত একে জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে রায় দিয়েছেন। তাদের নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একটি রিটও আছে। এই নিটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারি না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তাও বলেছেন, সরকার আশা করছে, যে রিটের রায়ে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন, সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আবার ট্রাইব্যুনালের দেওয়া গোলাম আযমের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদনেও জামায়াত নিষিদ্ধ করার আরজি জানিয়েছে সরকারপক্ষ।

ট্রাইব্যুনালের অন্য মামলাগুলোর রায়েও দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলায় এসব রিট-মামলার চূড়ান্ত রায়ের দিকে তাকিয়ে আছে সরকার। আদালত নিষিদ্ধ করতে বললে সরকারও আর দেরি করবে না।  

তবে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা আগে থেকেই বলে আসছেন, বর্তমান সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ীই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা যায়। এজন্য সংবিধান সংশোধন বা নতুন আইন করার প্রয়োজন নেই। তাদের মতে, জামায়াত নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ অবস্থায়ও সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার কোনো ঝুঁকি নেবে না। নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হলে পরে জামায়াতবান্ধব কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে অন্য একটি নির্বাহী আদেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে। যেমনটি হয়েছিল, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকার যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে সংবিধান সংশোধন করে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছিলেন।

সেক্ষেত্রে আদালতের রায় ও আদেশ থাকলে তার আলোকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে ভবিষ্যতে সেটি কেউ রদ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের উদাহরণও তুলে ধরছে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র।

এসব কারণ দেখিয়ে সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জামায়াত নিষিদ্ধ করা সময়ের ব্যাপার। সরকারের সে প্রস্তুতিও রয়েছে। তবে আদালতের রায় নিয়ে শক্ত অবস্থান থেকেই এ উদ্যোগ নেবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার।  

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করায় আইনগত বাধা নেই। তবে আদালতের রায়ের আলোকে বিষয়টির সমাধান করা হলে তা স্থায়ী রূপ পাবে।

তিনি জানান, গোলাম আযমকে ৯০ বছরের সাজা দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছিলেন, সেই রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছে সরকারপক্ষ। ওই আপিলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আরজি করা হয়েছে। আপিল আবেদনটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে আপিল বিভাগে।

আইনজীবীরা বলেন, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের (গ) ও (ঘ) উপ-অনুচ্ছেদ, রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২ ও দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮-এর বিধিবিধান অনুসরণ করে যেকোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা যায়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে’।

‘তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি(ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়’।

এখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে এই চারটির যেকোনো একটি অথবা সবগুলো অভিযোগই আনতে পারে। কেননা, সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, জামায়াত কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নয়, বরং এটা একটা জঙ্গি সংগঠন।

রিপ্রেজেন্টেশন অব পিপলস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭২-এর ৯০ (এইচ) ধারায়ও রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সরকারকে। দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮-এর ৩ ও ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ববিরোধী কার্যকলাপ করতে পারবে না।একই সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দল সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে গোপন তৎপরতা চালাতে পারবে না’।

জামায়াত ও শিবির দেশের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয় বৈষম্য সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক এসব তৎপরতা সংবিধানপরিপন্থী কাজ বলে সর্বস্তর থেকে দাবি উঠেছে এ দলটি নিষিদ্ধ করার।

আইনজীবীরা মনে করেন, জামায়াতের বর্তমান তৎপরতা সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তের পরিপন্থী বিধায় তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হতে পারে।

তারা মনে করেন, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে যেসব শর্ত আছে, যেমন কোনো দল যদি ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ভাষাগত কিংবা লৈঙ্গিক বৈষম্য তৈরি করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, তাহলেও কমিশন তার নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। তবে কমিশন যদি কোনো দলের নিবন্ধন বাতিল করে, সেক্ষেত্রে ওই দল উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবে।

এছাড়া একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাম্প্রতিক প্রায় সব কটি রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল থেকে এ পর্যন্ত ৯টি মামলায় ১০ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

একাত্তরে জামায়াত স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করে। এসব দল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন এবং ওই সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নিয়ে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক হারে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ চালায়। তাদের এসব অত্যাচারে এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশান্তর হয়। এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের অধীন ২০১০ সালের ২৫ মার্চ একটি ও ২০১২ সালের ২২ মার্চ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ দু’টি ট্রাইব্যুনালে বিভিন্ন ব্যক্তির বিচার শুরু হয়।

২০০৯ সালে সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইনে ব্যক্তির বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি হলেও কোনো সংগঠনের বিচারের সুযোগ ছিল না। এ জন্য ২০১১ সালে সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা হয়। এরপর গত ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে। তদন্ত শেষে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করা হবে। এরপর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে।

আইনজীবীরা মনে করেন, ১৯৭৪ সালে প্রণীত বিশেষ ক্ষমতা আইনেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। এই আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ধর্মের নামে বা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গড়া কোনো সংগঠন, ইউনিয়ন বা গোষ্ঠীর সঙ্গে কেউ যুক্ত হতে পারবে না। এ ধরনের সংগঠনকে সরকার গেজেটের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে পারবে। সরকার ওই সংগঠনেরসমূহ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ ধরনের কার্যক্রমে আবার কেউ যুক্ত হলে তাকে ৩ বছরের জেল অথবা জরিমানা বা দুটিতেই দণ্ডিত করা যাবে’।

এর বাইরে আছে সন্ত্রাসবিরোধী আইন’২০০৯(২০০৯ সালের ১৬ নাম্বার আইন)। এই আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকার কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত আছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, আদেশ দ্বারা, তফসিলে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করতে পারবে’।

অন্যদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চেয়ে তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল করিম চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তির করা রিট আবেদনের রায়ে গত বছরের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বেআইনি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আপিলও শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

আবার নির্বাচন কমিশন আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাবেন। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলে যে কোনো সংগঠনের ক্ষেত্রেও এ ধারা প্রযোজ্য হবে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও’র ৯০ (জ) ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো দল বিলুপ্ত হয়ে যায় অথবা যদি কোনো দলকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কিংবা কোনো দল যদি নির্বাচন কমিশনের কাছে পরপর তিন বছর তাদের তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হয় অথবা যদি কোনো দল পরপর দুটি সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে তাহলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হবে’।

২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশকে (জেএমবি) নিষিদ্ধ করেছিল। বর্তমান সরকারের সময়ে নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহরীরকে। গত দশ বছরের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত থাকার কারণে এ দু’টিসহ মোট ৫টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। কাজেই একই অপরাধে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে বাধা থাকার কথা নয় বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হলে দেখাতে হবে যে, সংগঠনটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সিদ্ধান্তের ওপর নিষিদ্ধের বিষয়টি নির্ভর করছে। তবে, যেহেতু জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে একটি মামলা (নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন, সেহেতু ওই আপিলের নিষ্পত্তি পর্যন্ত সরকার অপেক্ষা করতে পারে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলে আপনা-আপনি জামায়াতের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেন, ট্রাইব্যুনাল একাধিক রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন বলে অভিমত দিয়েছেন। বিশেষ করে গোলাম আযমের মামলার রায়ে দেওয়া অভিমতে বলা হয়েছে, দলটি গত ৪২ বছরেও তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি বা অনুশোচনা করেনি। একই সঙ্গে এ দলটির কোনো সদস্য যাতে কোনো প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে না পারে সে জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন। এ অবস্থায় দলটি নিষিদ্ধ করার জন্য আপিল বিভাগে সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের আওতায় এ আবেদন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায় দেবেন। আদালতে জামায়াত নিষিদ্ধ করার পক্ষে রায় পাওয়া গেলেও দলটি নিষিদ্ধ করে সরকারকে গেজেট প্রকাশ করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, সংবিধান, বিভিন্ন অর্ডিন্যান্স তো আছেই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক দু’টি রায়ও বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায়ের মাধ্যমেও জামায়াত নিষিদ্ধ হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায়ের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হলে দেশের কোনো আদালতে এ রায়ের চ্যালেঞ্জ হবে না।
শ ম রেজাউল করিম মনে করেন, জামায়াত এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যখন-তখন নাগরিকদের ওপর হামলা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত করা, ধর্মীয় উস্কানি, নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির সব তথ্য-প্রমাণই জামায়াতের বিরুদ্ধে রয়েছে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ প্রয়োগেও বাধা নেই।

তার মতে, বিশেষ ক্ষমতা আইনও ১৯৭৪ সাল থেকে চলে আসছে। তবে এতোদিন ওই আইনে কোনো সরকারই জামায়াতকে অভিযুক্ত করে নি। এরকম আরও কিছু সংগঠনের ক্ষেত্রে এই আইনের প্রয়োগ দেখা গেলেও জামায়াত থেকে গেছে আওতার বাইরে। জেএমবি এবং হিজবুত তাহরীরকে এই আইনে নিষিদ্ধ করা হয়। এতোদিন প্রয়োগ করা না হলেও যেকোনো সময় এ আইনের আলোকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ এবং তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে সরকার। আবার হিজবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন’২০০৯ কাজে লেগেছিল। জামায়াতের ক্ষেত্রেও এ আইন প্রযোজ্য।
 
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ অনুযায়ী একাত্তরে গণহত্যায় জড়িত থাকার প্রমাণ করতে পারলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যাবে। ট্রাইব্যুনাল দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করে তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যে কোনো রায় দিতে পারেন। এমনকি এ সংগঠনের সদস্যদের আর কখনো কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ মনে করেন, যা করার এখনই করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন দিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। দলের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। সরকার চাইলে নির্বাহী সিদ্ধান্তে এ দু’টি আইনের বলে যেকোনো সময় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে, নিষিদ্ধ করার পরে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে যেন আরো বেশি সহিংসতা ছড়াতে না পারে তার ব্যবস্থাও নিয়ে রাখতে হবে।

ট্রাইব্যুনালের রায়গুলোর পর্যবেক্ষণ নিয়েও সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তুরিন আফরোজ বলেন, মামলার পর ট্রাইব্যুনালে তাদের অপরাধী সংগঠন প্রমাণ করে আদালতের কাছে দাবি করতে হবে, যেন কোনো জামায়াত-শিবির সদস্য এদেশে আর রাজনৈতিক তৎপরতার নামে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হতে না পারে।

তিনি বলেন, অপরাধ প্রমাণিত হলে জামায়াত ক্রিমিনাল দল হিসেবে সাব্যস্ত হবে। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হলে স্বাভাবিক নিয়মেই এই দলের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।

তুরিনও মনে করেন, আদালতের রায়ের ভিত্তিতে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে সেটি হবে স্থায়ী একটি বিষয়। আদালতের রায়ের ভিত্তিতে তারা অপরাধী দল হিসেবে সাব্যস্ত হলে তাদের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ আর থাকবে না। জামায়াত যদি ট্রাইব্যুনালে ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হয়, তাহলে এই দলের সব সদস্য ক্রিমিনাল অ্যাক্টের মধ্যে পড়বে। এবং এরা যেই দলই করতে যাক চিহ্নিত হলে এদের গ্রেফতার করা যাবে। ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এদের দ্বারা সংঘটিত যে কোনো প্রক্রিয়াকে নিষিদ্ধ করা যাবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, অন্যান্য দেশে নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে জামায়াতের মিল রয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। এ ছাড়া ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬ ও ১৮ ধারা অনুযায়ীও নিষিদ্ধ করা যায়। এ কাজে কিছুটা ঝুঁকি বা অস্থিরতা হতেই পারে। এসব অস্থিরতার কথা না ভেবে এগোলে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।
আর নির্বাচন কমিশন আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাবেন। এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলে যেকোনো সংগঠনের ক্ষেত্রেও এই ধারা প্রযোজ্য হবে।

তাই সরকার উদ্যোগী হলে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
১৯৪০ সালের ৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পর জামায়াতে ইসলামী তিন দফায় নিষিদ্ধ হয়েছিল। আর দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল জামায়াত। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের শাসনামলে রাজনৈতিক দলের অধ্যাদেশের মাধ্যমে দলটি আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। বর্তমানে রাজপথে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির অন্যতম প্রধান শরিক জামায়াত।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৩
জেডএম/ জেএম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন