এবার ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার বিচার
01 Feb, 2014
এবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারকাজ শেষ করতে চায় সরকার। এ জন্য স্বাভাবিক গতিতে মামলার কাজ এগিয়ে নিতে যেসব বাধা ছিল, তা দূর করার চেষ্টা চলছে। পাবলিক প্রসিকিউটররা নারকীয় এ হামলা মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণগুলো সুনির্দিষ্ট করে তা সমাধানের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার বিচারের রায় হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নারকীয় ২১ আগস্টে হত্যাযজ্ঞের বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে সব সংকট দূর করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অভিযোগপত্রের সব সাক্ষীর সাক্ষ্য নাও নেওয়া হতে পারে। মামলার অভিযোগ প্রমাণে যতজন প্রয়োজন, ততজনের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। আর এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ জন হতে পারে। এ ছাড়া এ মামলার আসামির বিরুদ্ধে অন্য জেলায় ভিন্ন কোনো মামলা থাকলে ওই জেলার সঙ্গে সমন্বয় করে মামলার তারিখ নির্ধারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যাতে ২১ আগস্টের মামলার নির্ধারিত দিনে অন্য কোনো মামলার তারিখ না থাকে। তাহলে আসামিকে অন্য জেলায় যেতে হবে না। এমন পরিস্থিতিতে মামলার বিচার প্রক্রিয়া খুব শীঘ্রই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে আশা মামলা সংশ্লিষ্টদের। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান। আহত হন পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি। চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও একটি কানের শ্রবণশক্তি হারান তিনি। জানা গেছে, জঘন্যতম ঘটনার ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই গ্রেনেড হামলার বিচার গত বছর শেষ করার ইচ্ছা থাকলেও নানামুখী সংকটের কারণে তা করতে পারেনি তৎকালীন মহাজোট সরকার। ধীরগতিতে মামলার প্রক্রিয়া এগোতে থাকায় বিচারকাজের অগ্রগতি হয় সামান্যই। এতে বিচারের প্রতীক্ষায় থাকা আহত ও নিহতদের পরিবারের স্বজনদের মাঝে এ নিয়ে ছিল শুধু হতাশা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চার্জশিটে অতিরিক্ত সাক্ষীর নাম উল্লেখ থাকায় মামলার বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলে। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রসিকিউশন আইনজীবী কোনো সাক্ষীকে গুরুত্বহীন মনে করলে তার সাক্ষ্য নাও নিতে পারেন। এ ক্ষমতা তার রয়েছে। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিশেষ এজলাসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার চলছে। অতিরিক্ত সাক্ষী এবং আসামিদের অন্য মামলায় বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাওয়ার কারণে ২১ আগস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়া চলছিল ধীরগতিতে। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বলেন, এ মামলায় যারা আসামি তারা সারা দেশে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি। কাজেই দেশের অন্যান্য আদালতেও আসামিদের নেওয়া হয়। ফলে ২১ আগস্ট হামলার বিচারিক ট্রাইব্যুনালের পক্ষে টানা বিচারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি। জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ তার সহযোগীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত। সেখানকার মামলায়ও তাদের হাজির করা হয়। আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। আবদুস সালাম পিন্টু নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলা মামলার আসামি। চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার কারণে এতদিন লুৎফুজ্জামান বাবরকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো। তবে এখন এ মামলায় তাকে আপাতত যেতে হবে না চট্টগ্রামে। বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট আবু আবদুল্লাহ ভুঁইয়া আরও বলেন, এ ছাড়া আসামি পক্ষেরও মামলার বিচার বিলম্বিত করার একটা প্রবণতা রয়েছে। মামলার দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে সরকারপক্ষের প্রধান কেঁৗসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, কেবলমাত্র মাজেদ বাটের স্ত্রী কাকনের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আসামি পক্ষের আইনজীবীদের বিরোধিতার জন্য ৯৯ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬৮, আবদুর রউফের জন্য ১০ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। এ জন্যই মামলার বিচারিক কার্যে সময় লাগছে। তবে মামলা-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাকি সাক্ষীদের মধ্যে মামলা প্রমাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীসহ আরও ২৫ থেকে ৩০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হতে পারে। আসামিপক্ষের আইনজীবী এম নজরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত নেওয়া সাক্ষীদের জবানবন্দী অনুযায়ী মামলা প্রমাণিত হয়নি। এখনো মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। আবার বর্তমানে একজন সাক্ষীর একই সঙ্গে দুটি মামলায় সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে, যা কোনোভাবেই বৈধ নয়। তবে সরকারপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, ইতোমধ্যে মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, আবু তাহের, তাজউদ্দিন, মাজেদ বাটসহ জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। মামলার আসামি পক্ষের এক আইনজীবী অভিযোগ করে বলেন, সরকার তড়িঘড়ি করে বিচারকাজ শেষ করতে চায়। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, আগে সপ্তাহে এক দিন আদালতে এ মামলার বিচারকাজ হতো, তা এখন সপ্তাহে তিন দিন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, নারকীয় ২১ আগস্টের এ হামলার তদন্ত করতে গিয়ে সাত বছর ধরে ঘুরপাক খেতে হয়েছে পুলিশকে। এ সময়ে তদন্ত হয়েছে তিনবার। আর তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয় ছয়বার। মহাজোট সরকার আমলে সিআইডির সম্পূরক অভিযোগপত্রে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট স্মরণকালের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অভিযোগপত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ নতুন করে ৩০ জনকে আসামি করা হয়। নতুন করে ৩০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২। ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া প্রথম চার্জশিটে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছিল। সূত্র জানায়, আগের অভিযোগপত্রে হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের উৎস, মজুদ, সরবরাহকারী, পরিকল্পনাকারীদের নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না। অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে আসে আর্জেস গ্রেনেড পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে। তা পাকিস্তানি নাগরিক মজিদ বাটের মাধ্যমে সংগ্রহ করে সাবেক মন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন হামলাকারীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ৫২ আসামির মধ্যে সাবেক মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২৫ জন আসামি কারাগারে আটক আছেন। এ ছাড়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জন আসামি রয়েছেন পলাতক। অন্যদিকে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বঙ্ চৌধুরী এবং মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এ এস পি মুন্সী আতিকুর রহমান, এ এস পি আবদুর রশীদ ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম জামিনে রয়েছেন।
৬ জন আইও : গ্রেনেড হামলার পর মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী পৃৃথক তিনটি মামলা করেন। সূত্র জানায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মোট তিন দফা তদন্তে ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তাকে (আইও) পরিবর্তন করা হয়। প্রথম তদন্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে, কিন্তু কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। বরং মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য জমজমাট জজমিয়া নাটক সাজানো হয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এ এস পি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতাদের শনাক্ত করা হয়নি। বর্তমান সরকার আমলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর আদালত মামলার বর্ধিত তদন্তের আদেশ দেন। ২০০৯ সালের ১৩ আগস্ট তদন্ত শুরু করেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আকন্দ। ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার তদন্ত শেষ হয়। প্রথম অভিযোগপত্রে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুসহ ৪০৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। আলামত জব্দ দেখানো হয়েছিল ৬৯ ধরনের।
বিচারের অগ্রগতি : ২০১২ সালের ১৯ মার্চ তারেক রহমান, হারিছ, মুজাহিদসহ জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতা এবং বেশ কয়েকজন জঙ্গি নেতা-কর্মীসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বিচার শুরুর পর গত ২১ মাসে বাদীসহ ৭৩ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে, আরও ২৫ থেকে ৩০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ প্রয়োজন হতে পারে।
উৎসঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
Share on facebook Share on email Share on print
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন