মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪


কোত্থেকে এলো এত ভোট? 08 Jan, 2014 বিএনপিসহ নিবন্ধিত ২৮ দলের বর্জন করা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর এবার প্রশ্ন উঠেছে ভোট নিয়ে। মিলছে না ২০০৮ সালের প্রদত্ত ভোটের হারের সাথে। যেখানে দিনের ১টা পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটার খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে স্থগিত কেন্দ্রগুলো বাদ দিয়ে দু’দিন পরে সাড়ে ৪০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অথচ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যেখানে ৪১টি দল অংশ নেয়ার পরও ভোটের হার ছিল ২৬.৫৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের যে হার ছিল এবার একদলীয় ও ভোটারহীন নির্বাচনেও একই হার দেখানো হয়েছে কেন্দ্রগুলোতে। দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রথম পাঁচ ঘণ্টায় ভোট পড়ে মাত্র ৬-১০টি, সেখানে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার দেখানো হয়েছে আটটি আসনে। আর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট প্রদানের হার দেখানো হয়েছে ৩৪টি কেন্দ্রে। ভোট গ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, উপরের নির্দেশে আমাদের ভোটের হার বাড়াতে হয়েছে। এলাকাভেদে এই হার ৬০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত করতে বলা হয়। কিন্তু তাতেও গড় ভোট সাড়ে ৪০ শতাংশের বেশি করা সম্ভব হয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে গতকাল ইসি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে ১৩৯টি আসনে প্রদত্ত ভোটের হার শতকরা ৩৯.৮৩ শতাংশ। এই আসনগুলোতে স্থগিত ২০৫টি কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা হিসাবে ধরলে ৪০.৫৬ শতাংশ দাঁড়ায়। অথচ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে যেখানে ৪১টি দল অংশ নেয়ার পরও ভোটের হার ছিল ২৬.৫৪ শতাংশ। আগের নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন চলাকালে ইসি সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে প্রাক্কলিত ভোটের হার উল্লেখ করত। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেই তথ্য তারা বলতে সাহস পাননি। দু’দিন হিসাব মিলিয়ে গতকাল তথ্য প্রকাশ করে ইসি। ভোটের দিন সরেজমিন ঘুরে এবং ২০০৮ সালের কেন্দ্রভিত্তিক ভোট বিশ্লেষণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হচ্ছে। সে সময় ঢাকা-৬ আসনের একরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার ছিল ৮৭.৬১ শতাংশ। এক হাজার ১৭৬ জনের মধ্যে ভোট প্রদান করেছিলেন এক হাজার ২৫ জন ভোটার। আর এবার একই কেন্দ্রে চারটি বুথে ভোটার ছিল এক হাজার ২৩৬ জন। বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোট প্রদান হয় ২১০টি। ভোটার আর আসে না। পরে উপরের নির্দেশে ভোটের হার বাড়ানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীকে জয়ী করতে ভোটের সংখ্যা ৫০৬-এ উন্নীত করা হয়। তারা বলেন, বুথ-১ এ একজন মহিলা ভোটার ভোট দেয়ার জন্য আসেন। তার ভোটার নম্বর ছিল ২৯৬। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ওই মহিলা ভোটারকে বলেন তার ভোট অন্য কেন্দ্রে, এখানে তিনি ভোট দিতে পারবেন না। বাস্তবে তিনি ওই কেন্দ্রের ওই বুথেরই ভোটার। তাকে ভোট দিতে না দেয়ার কারণ হলো বুথে জাল ভোট প্রদানের কাজ চলছিল। তাই তাকে প্রবেশ করতে না দিয়ে ভুল তথ্য দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়। একই কেন্দ্রের ৪ নম্বর বুথে একজন পুরুষ ভোটার আসেন। তাকে একইভাবে বলা হয় অন্য কেন্দ্রে ভোট দেয়ার জন্য। তখন জাল ভোটের মহোৎসব চলছিল। একজন পোলিং এজেন্ট জানান, তাকে বের করে দিয়ে সাড়ে ৩টায় কলাপসিবল গেট আটকে দেয়া হয়। ঢাকার বাইরের চিত্র একই চিত্র। মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের পিংরাইলের একটি কেন্দ্রে ভোটার ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুই হাজার ১৮৩টি। ওই সময় ভোট প্রদানের হার ছিল ৮৮.৭৪ শতাংশ। মোট এক হাজার ৯৩৮টি ভোট পড়েছিল নবম সংসদ নির্বাচনে। আর এবার একদলীয় নির্বাচনেও ভোট প্রদানের হার দেখানো হয়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। সরেজমিন দেখা যায়, সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় ৬১টি ভোট পড়ে। এরপর আর ভোটার পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৬৪টি। এরপরে চলে ভোটের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। দলীয় নেতাদের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত ভোট প্রদান দেখানো হয় দুই হাজার ৯১টি। শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হন। তখন ওই আসনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৮৭.৫৪ শতাংশ। ওই নির্বাচনে তিনি মোট এক লাখ ৫৮ হাজার ৯৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর এবার বিরোধী দলহীন নির্বাচনে এই আসনে প্রদত্ত ভোটের হার হলো ৮৯.৯৫ শতাংশ। দুই লাখ ১১ হাজার ৯৫১ জন ভোটারের মধ্যে শেখ হাসিনা মোট এক লাখ ৮৭ হাজার ১৮৫টি ভোট পান। গোপালগঞ্জ-২ আসনে এবার প্রদত্ত ভোটের হার হলো ৯০.৩৬ শতাংশ। দুই লাখ ৬৯ হাজার ৩৭০ ভোটের মধ্যে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৫৯১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। নবম সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৮২.৬৯ শতাংশ। শেখ সেলিম পেয়েছিলেন এক লাখ ৮৭ হাজার ৪৪২টি ভোট। গোপালগঞ্জ-১ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার ছিল ৮৪.২৪ শতাংশ। আর এবার সেই হার হলো ৮৯.৭৪ শতাংশ। এখানে মুহাম্মদ ফারুক খান দুই লাখ ৪০ হাজার ৩০৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আগের নবম সংসদ নির্বাচনে তিনি এক লাখ ৮৩ হাজার ২৩৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর লালমনিরহাট-১ আসনে নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৯১.৭৩ শতাংশ। আর মোতাহার হোসেন এক লাখ ৩৯ হাজার ৫৮৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। এবার ভোট পড়ে ৭০.৪৮ শতাংশ। আর তিনি নির্বাচিত হন এক লাখ ৭৯ হাজার ৮১৪ ভোট পেয়েছে। ইসির চূড়্ান্ত তথ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ ভোট প্রদান হয়েছে যেসব আসনে সেগুলো হলো, লালমনিরহাট-১ আসনে ৭০.৪৮%, পটুয়াখালী-৩ আসনে ৬৩.৭৯%, ভোলা-২ আসনে ৬৫.৬০%, ভোলা-৩ আসনে ৭১.৫২%, ঝালকাঠি-১ আসনে ৬২.২৫%, জামালপুর-১ আসনে ৬১.৭৩%, জামালপুর-৫ আসনে ৬১.৬৫%, শেরপুর-১ আসনে ৬৮.৩২%, ময়মনসিংহ-১০ আসনে ৬৫.৭৩%, নেত্রকোনা-৩ আসনে ৬১.০৩%, চট্টগ্রাম-১৩ আসনে ৬৮.৯৩%, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে ৬৩.৯৭%, কুমিল্লা-৫ আসনে ৬৭.৫১%, চট্টগ্রাম-৩ আসনে ৬৫.৯৪%, গোপালগঞ্জ-১ আসনে ৮৯.৭৪%, গোপালগঞ্জ-২ আসনে ৯০.৩৬%, গোপালগঞ্জ-৩ আসনে ৮৯.৯৫%। ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, এ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থা যে হার ঘোষণা করেছে অর্থাৎ ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকার চেষ্টা করবে ইসি। হয়তো বাস্তবতার কাছে থাকবে না। কিন্তু প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা ইসির জন্য কঠিন হবে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা ভোটের ব্যাপারে যে চিত্র দেখেছি তাতে প্রদত্ত ভোটের সাথে অসঙ্গিতপূর্ণ। বিশ্বাসযোগ্যও নয়। ইসি যে নির্বাচন করেছে তা প্রকৃতপক্ষে অংশগ্রহণমূলক হয়নি। নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, এখন ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে অগ্রসর হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, যত বেশি হার দেখানো হবে তত বেশি প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াবে। গ্রহণযোগ্যতা কম হবে। আর এটার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে এটাতে সরকারের কিছুই আসে যায় না। তিনি বলেন, লুকোচুরি করতে গিয়ে অনেক কিছুই বের হয়ে আসছে। বিদেশীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। বিরোধী দল ভোটারের উপস্থিতি কম চেয়েছিল তা হয়েছে। তবে ১০০ শতাংশ ভোট হলেই বা কী? উৎসঃ নয়া দিগন্ত Share on facebook Share on email Share on print 2

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন