বন্দুকযুদ্ধ’ নয়, ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা
27 Jan, 2014
বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বেছে বেছে হত্যা (Selected Killing ) মিশন শুরু হয়েছে। বেশ কয়েক মাস আগেই এটা শুরু হলেও একতরফা নির্বাচনের পর এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বাড়তে পারে বলে আগেই হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। সেই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকার বুঝছে পারছে যে তারা এখন আক্ষরিক অর্থেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। ৫ জানুয়ারি জনগণ নীরবে যেভাবে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা কারও ধারণার মধ্যেই ছিল না। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও যে দলটিকে প্রত্যাখ্যান করবে তা সম্ভবত উপরওয়ালা ছাড়া কেউই বুঝতে পারেননি।
জনগণের নীরব বিপ্লবের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের ঘুম যে হারাম হয়ে গিয়েছে তা তাদের কথাবার্তা এবং অঙ্গভঙ্গী দেখলে বিলক্ষণ বোঝা যায়। সত্যি কথা বলতে কী, মুখে যত লম্বা বুলি আওড়াক না কেন আওয়ামী লীগ নেতারা এখন হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন। দেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদেরকে ধিক্কার দিচ্ছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা সরকারের কর্তব্যক্তিদের তাড়া করে ফিরছে।
হতাশার মহাসমুদ্রে আওয়ামী লীগের একমাত্র ভরসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যাদের কিলার বা ঘাতক উপাধি দিয়েছে।
দেশের এই মুহূর্তে সরকার-বিরোধী কোনো আন্দোলন না থাকায় যৌথবাহিনী এখন তার পুরো শক্তিকে নিয়োজিত করেছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নিধনযজ্ঞে। সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, নীলফামারীতে সম্প্রতি গ্রেফতারের পর বহু নেতাকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতদের পরিবারের অভিযোগ।
বর্তমানে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বরতা সম্ভবত রক্ষীবাহিনীকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এর আগে রাজপথে নামলেই বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে তারা পুরো দেশকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। এখন তারা আরও একধাপ এগিয়ে গেছে। এখন আর রাজপথে নামতে হয় না। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনেও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে, যেমনটা ঘটেছে লক্ষ্মীপুরে এক জামায়াত নেতার ক্ষেত্রে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, মধ্যম বা নিচু পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীকে নয়, জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করে হত্যা করা হচ্ছে। গতকালও জামায়াত-শিবিরের ৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের পর ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগ। অনেক প্রবীণ নেতা, আলেম, শিক্ষকও নাকি অস্ত্রবাজ!
এসব হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ ও যৌথবাহিনী কথিত বন্দুকযুদ্ধের অতি পুরনো হাস্যকর গল্প প্রচার করেছে।
বাংলাদেশের মানুষকে এতটা বোকা ভাবা নিরাপত্তা বাহিনীর উর্বর মস্তিষ্কের পক্ষেই শুধু সম্ভব।
দিনদুপুরে গ্রেফতারের পর মধ্যরাতে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক করা হয়। এতে শুধু নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক ব্যক্তিই মারা যায়। কথিত যেসব অস্ত্রধারী নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করে তাদেরও কেউ মারা যায় না। অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর কারও গায়ে আঘাত লাগে না ভুলেও। মারা যায় শুধু পুলিশ বা যৌথবাহিনীর হাতে আগেই আটক সেই হতভাগ্য আদম সন্তান!
প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে প্রায় একই কাহিনী, অনেকটা বাংলা সিনেমার মতোই।
নিরাপত্তা বাহিনীর এই অসাড় দাবির পর যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ৫ জানুয়ারির পর হঠাত্ করে বিএনপি-জামায়াতের হাতে এত অস্ত্র এলো কোত্থেকে?
গত ৫ বছর তো আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করেছে। তার আগেও দুবছর ক্ষমতা ছিল কট্টর বিএনপি-জামায়াত বিরোধী ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকার। এই ৭ বছরে বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে নিরাপত্তা বাহিনী কয়টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে, তার একটি পরিসংখ্যান দিলে মানুষ বুঝতে পারে তাদের দাবির সত্যাসত্য। নিরাপত্তা বাহিনী আরও একটি পরিসংখ্যান দিয়ে জাতিকে কৃতজ্ঞ করতে পারে যে গত ৫ বছরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ফ্রেন্ডলি ফায়ারে কতজন নিহত হয়েছে।
মনে হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির পরপরই জামায়াত-শিবিরের ‘অস্ত্র ভাণ্ডারের’ সন্ধান পেয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী।
অথচ সাম্প্রতিক দুটি ঘটনার বিশ্লেষণ করলে মানুষ বুঝতে পারবে প্রকৃত সত্যটা কী।
বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বহু সন্ত্রাসী গুলিতে মারা যায়। তখন জামায়াত-শিবিরের কেউ কী মারা গিয়েছিল? উত্তর-না।
ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সময় একই ধরনের অভিযানে জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল কী? উত্তর-না।
গত ৫ বছরে জামায়াত—শিবিরের বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে চিরুনি অভিযান চললেও কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে কী? এর উত্তরও একই।
নিকট অতীতের এসব তথ্য জানার পর নিরাপত্তা বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধারের কাহিনী নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
তাহলে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের পর এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার কারণ কী?
কারণ, আওয়ামী লীগ নেতারা জানেন যে তারা তাসের ঘরে আছেন। ধাক্কা লাগলেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তাই যাতে কোনোভাবেই ধাক্কা না লাগে তাই বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করতেই এই ব্যবস্থা।
তাছাড়া আগামী মাসেই শুরু হচ্ছে উপজেলা নির্বাচন। স্থানীয় নির্বাচন হলেও এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে অকল্পনীয় ভরাডুবি হবে তা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। এ অবস্থায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয় তাড়া করে ফিরলে আওয়ামী লীগ সরকার তো ভোটের মাঠ ফাঁকা পাবেই।
উৎসঃ আমার দেশ
Share on facebook Share on email Share on print 3
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন