যেভাবে ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান
বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম | আপডেট: ১১:১৯, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪
১
চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার ঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আটকের পর পুলিশ লাইন মাঠে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ছবিটি ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল তোলা। ছবি: প্রথম আলোচট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার ঘাটে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে অস্ত্র আটকের ঘটনা ছিল অনেকটা আকস্মিক। পুলিশের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ে অস্ত্র পাচারকারীরা এবং আটক হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র।
অস্ত্র খালাসের সময় ঘটনাস্থলে প্রথম উপস্থিত সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ও সার্জেন্ট হেলালউদ্দীন ভূঁইয়াসহ পুলিশের একাধিক সদস্য এবং একাধিক ঘাটশ্রমিকের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় এ তথ্য জানিয়েছেন তাঁরা। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার সময় তাঁরা বিস্তারিত জানান ১ এপ্রিলের রাতে অস্ত্র আটকের ঘটনা।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রামের বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির হাবিলদার গোলাম রসুলের টেলিফোন পেয়ে সর্বপ্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ও কয়লার ডিপো ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সার্জেন্ট হেলাল উদ্দীন ভূঁইয়া। এই টেলিফোন পাওয়ার আধঘণ্টা আগে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ঘটনাস্থলের পাশের খেয়াঘাট থেকে নৌকা নিয়ে পার হয়ে ওপারের কয়লা ডিপো হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। ঘটনার মাত্র চার দিন আগে হেলালকে বন্দর ফাঁড়ি থেকে কয়লার ডিপোতে এবং আলাউদ্দীনকে কয়লার ডিপো থেকে বন্দর ফাঁড়িতে বদলি করা হয়। এ কারণে তাঁদের বাসা পাল্টানো সম্ভব হয়নি। সিইউএফএল এবং কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ির অবস্থান কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ পারের বিপরীতে। পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা চাকরিতে একই ব্যাচের হওয়ায় তাঁদের মধ্যে আগে থেকেই বাড়তি সখ্য ছিল।
ঘটনাস্থলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্দর ফাঁড়ির দায়িত্ব শেষ হওয়ার আগেই সাদা পোশাকে সিইউএফএল ঘাটের পাশের খেয়াঘাট দিয়ে একটি নৌকায় নদী পার হন সার্জেন্ট আলাউদ্দীন। তখন ঘাটে কোনো ট্রলার ছিল না। তবে অস্ত্র আটক মামলার আসামি দীন মোহাম্মদ, আবুল কাশেম মধু, আরজু পাগলাসহ অন্যরা ঘাটে ছিলেন। সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকে ঘাটে দেখে দীন মোহাম্মদ নদী পারাপারের জন্য একটি নৌকা ঠিক করে দেন।
এই নৌকায় ওপারে পৌঁছে ঘাটের পাশে সার্জেন্ট হেলালের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরপরই বন্দর ফাঁড়ি থেকে হাবিলদার গোলাম রসুল মুঠোফোনে সার্জেন্ট আলাউদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গোলাম রসুল জানান, সিইউএফএল ঘাটে অস্ত্র নামছে বলে এক ব্যক্তি টেলিফোনে জানিয়েছে। পরপর দুবার ফোন পেয়ে হেলালকে সঙ্গে নিয়ে আলাউদ্দীন একই নৌকায় কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিয়ে ছুটে যান সিইউএফএল ঘাটে। সার্জেন্ট হেলাল আগে এখানে দায়িত্ব পালনের কারণে ঘাটের অনেকেই তাঁর পরিচিত ছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই হেলালকে সঙ্গে আনার এটাও অন্যতম কারণ ছিল বলে আলাউদ্দীন জানান।
দুই সার্জেন্ট এ পারে আসার পর দেখেন, দুটি ট্রলার ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় আছে। বড়টি ঘাটের পাশে এবং অন্যটি সেটার গায়ে লাগানো।
এরপর দুই সার্জেন্ট ট্রলার দুটিতে কী হচ্ছে, তা দেখতে যান। তাঁরা দেখেন, কিছু শ্রমিক বড় ট্রলার থেকে কাঠের বাক্সগুলো ক্রেনের সাহায্যে ঘাটে রাখা ট্রাকে তুলে দিচ্ছেন।
সার্জেন্ট হেলাল কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর পূর্বপরিচিত শ্রমিকসর্দার আরজু পাগলাকে দেখতে পেয়ে এসব মালামাল কার, তা জানতে চান। আরজু পাগলা জানান, মালের মালিক ঘাটে আছে। এরপর দুই সার্জেন্ট ঘাটে গিয়ে মালিককে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে হাফিজ ও আবুল হোসেন (একজন শীর্ষস্থানীয় উলফা নেতা) জানান, তাঁরাই মালের মালিক। কোনো ভণিতা না করেই তাঁরা স্পষ্ট জানান, ‘ট্রলার দুটিতে অস্ত্রশস্ত্র আছে। প্রশাসনের সবাই বিষয়টি জানে।’
একপর্যায়ে পুলিশের দুই সার্জেন্টের সঙ্গে আবুল হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাফিজ বলেন, ‘উনি উলফার নেতা, অস্ত্র তাঁদেরই।’ এসব অস্ত্রের কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না, তা পুলিশের দুই কর্মকর্তা জানতে চাইলে খেপে যান হাফিজ। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘কিসের কাগজ, এই অস্ত্র আসার খবর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবার জানা আছে, এগুলো নামাতে বাধা দিলে আপনার ক্ষতি হবে।’
জানা গেছে, পুলিশ ও অস্ত্র খালাসকারীদের মধ্যে এভাবে তর্ক শুরু হলে ঘাটের শ্রমিকেরা একে একে সরে পড়তে থাকেন। ঘাটশ্রমিকদের বলা হয়েছিল, পুলিশের বাধা তো দূরের কথা প্রয়োজনে কোস্টগার্ড এসে এগুলো খালাসে সাহায্য করবে। একপর্যায়ে অস্ত্র খালাসের কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে খবর পেয়ে হাবিলদার গোলাম রসুলের নেতৃত্বে বন্দর ফাঁড়ির সব সদস্য, কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান, ঘাটের আনসারসহ আরও অনেকে ঘাটে এসে জড়ো হন। নিজেদের শক্তি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে তখন দুই সার্জেন্ট অস্ত্র খালাসকারীদের সঙ্গে দরকষাকষির চেষ্টা চালান। কিন্তু হাফিজ টাকা দিয়ে সমঝোতার চেষ্টার পরিবর্তে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা বলে পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ সময় তিনি মুঠোফোনে ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন।
একপর্যায়ে হাফিজ তাঁর মুঠোফোনটি সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকে দিয়ে বলেন, ‘তোর বাপের সঙ্গে কথা বল, ডিজিএফআইয়ের বড় অফিসার লাইনে আছে।’ কিন্তু সার্জেন্ট আলাউদ্দীন ভয় পেয়ে ওই ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পাল্টা বলেন, ‘আমি এবার তোমার বাপকে খবর দিচ্ছি। দেখি তোমাকে কে বাঁচায়?’
এরপর হেলালের সঙ্গে পরামর্শ করে আলাউদ্দীন ডিসি-পোর্টকে মুঠোফোনে অস্ত্র খালাসের বিষয়টি জানান। একই সঙ্গে তিনি কয়লার ডিপোর সার্জেন্ট হেলালসহ আশপাশের সব ফাঁড়ি থেকে পুলিশ পাঠানোর আবেদন জানান। ডিসি-পোর্ট আবদুল্লাহ হেল বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তাঁকে আশ্বস্ত করেন। এরপর ডিসি-পোর্ট আশপাশের সবাইকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার বার্তা দিয়ে নিজেও আসছেন বলে জানান।
ইতিমধ্যে হাফিজের সঙ্গে থাকা উলফা নেতা আবুল হোসেন নিজের মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথা বলে সার্জেন্ট আলাউদ্দীনকেও কথা বলার অনুরোধ করেন। আলাউদ্দীন ফোন ধরলে অপর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে বলেন, ‘দেখুন, আমরা ১৯৭১ সালে আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক সহায়তা করেছি। এসব অস্ত্রশস্ত্রও আপনাদের মতো আমাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সৃষ্টির কাজে লাগবে, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না।’ এসব অস্ত্র নামানোর কাজে বাধা না দেওয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশের সদস্যরা তাঁদের পরিচিত অন্যান্য পুলিশ, বিডিআর, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের মুঠোফোনে খবর দেন। খালাসকারীরা যাতে কোনোভাবেই পার পেয়ে যেতে না পারে, সে জন্য এটা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না বলে সার্জেন্ট আলাউদ্দীন জানান।
উপস্থিত পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, হাফিজ ও তাঁর সঙ্গী বাদানুবাদের একপর্যায়ে পুলিশের দলকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব করেন। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ টাকা নিতে রাজি হয়নি।
জানা গেছে, এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে শুরু করেন। রাতেই বিষয়টি এমনভাবে জানাজানি হয়ে যায় যে, তখন আর কোনোভাবেই তা চেপে যাওয়ার কিংবা অস্ত্রবোঝাই ট্রাকগুলো ও ট্রলার দুটি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসন অনেকটা বাধ্য হয় বলে জানা যায়।
(অনুসন্ধানী এই প্রতিবেদনটি ২০০৯ সালের ৫ মার্চ ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে কিছু পরিমার্জন করে প্রতিবেদনটি আবার প্রকাশ করা হলো)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন