শনিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৪


কৌশল রোধে কৌশলী সরকার
26 Jan, 2014 প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী ও বিরোধী দলের নানামুখী কৌশল ঠেকাতে সরকারও কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে। নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকরা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। তেমনি জামায়াতে ইসলামীর বিষয়েও বিএনপিও অবস্থান পরিষ্কার না করার কৌশল বেছে নিয়েছে। একইভাবে সরকারও আদালতের রায় সাপেক্ষে জামায়াতের রাজনীতির ভবিষ্যত্ নির্ধারণ কথা বলছে। বিএনপি আন্দোলনের ইস্যু বানাতে পারে এমন বিষয়গুলো সরকার হাতে রেখে বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশল নিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যের পর পাকিস্তানে অবস্থানরত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরুর তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কৌশল নেয়া হয়েছে। স্বস্তি ফেরাতে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, ব্যবসা খাতের সমস্যা নিরসনে পরামর্শক কমিটি গঠন নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা বৈধতা দেয়ার জন্য সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বর্তমানকে টেলিফোনে বলেন, এখন পর্যন্ত বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। তবে আলোচনায় এলেই সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী নিজে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন জামায়াতের বিষয়ে আদালতে মামলা আছে। সেই মামলার রায় হওয়ার আগে আমি কিছুই বলতে চাই না। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত মানবতাবিরোধী দুই আসামির ফাঁসির রায়ের পর পাকিস্তানে অবস্থানরত যুদ্ধপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সক্রিয় আলোচনায় এসেছে। সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ভারত, রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান মিশনসহ বেশ কিছু দেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিন্দন জানিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরাসরি কোনো চিঠিতে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানায়নি। এমনকি সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার বিষয়টিও তারা চিঠির মাধ্যমে সরকারকে অবহিত করেনি বলে জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অফিসিয়াল ব্রিফিংয়ে সরকারের কাজ করার বিষয়টি সাংবাদিকদের অবহিত করেন। যুক্তরাজ্য এবং ইইউ প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাজ করে যাওয়ার কথা বলেন। প্রভাবশালী দেশগুলো সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার মতো কৌশলী ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে গত ১৬ জানুয়ারি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবে বিএনপিকে জামায়াত থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। কৌশলী অবস্থান নয় জমায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে বিএনপিকে স্পষ্ট অবস্থান নেয়ার পরামর্শও দেয়া হয়। সরকারের চেয়ে বিএনপির প্রতি তারা যে বেশি সহানুভূতিশীল এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এরপরও বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য এখন পর্যন্ত দেয়নি। দলের চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতারা জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিষয়ে যে কৌশলী বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে কিছুই পরিষ্কার হয় না। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অপর একটি সূত্র জানায়, প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিক দাতা সংস্থা এবং বিএনপি যত কৌশলী অবস্থানই গ্রহণ করুক তা রোধ করার সামর্থ্য সরকারের আছে। তার মতে বিএনপি যে বিষয়গুলোকে পুঁজি করে আন্দোলনে যেতে পারে ওই বিষয়গুলোকেই সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা। বিএনপি এই ইস্যুগুলোকে কাজে লাগিয়ে মাঠ গরম করতে পারলে দাতারা মধ্যর্বর্তী নির্বাচন সেই সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে চাপ সৃষ্টি সুযোগ পাবে। বিএনপি এর একটি বিষয়ও যাতে ইস্যু বানাতে না পারে সেজন্য নতুন সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই কয়েকটি জেলায় সফর করেছেন। বিশেষ করে ভোট দেয়ার অপরাধে যেসব জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারের ওপর হামলা চালানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ওইসব জেলায় সফর করছেন। নির্যাতিত পরিবারের সদস্যদের পাশে সরকার আছে বলে তাদের আশ্বাস দিচ্ছেন। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সব ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নিয়ে পরামর্শক কমিটি গঠনে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া তৈরি পোশাক খাতের শিল্প মালিকদের বেশ কিছু প্রস্তাব সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। যার সুফল এ খাতে বইতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ব্যবসায়ীরাই দেশের উন্নয়নের চালিকা শক্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বেশ ভাটা পড়েছে। আর এই ক্ষতি ব্যবসায়ী সম্প্র্রদায় ও বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করলেই দ্রুত পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। ব্যবাসায়ীরা কোনো রাজনৈতিক দল করেন তা মুখ্য নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে তাদের অধিক মনোযোগী হওয়া উচিত্। আর এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সবাইকেই সহায়তা করবে বলে তিনি জানান। রাজনৈতিক অস্থিরতা কেটে যাওয়ার পর তৈরি পোশাক খাতে স্বস্তি ফিরে আসছে, বিদেশি ক্রেতারা ফিরতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। নতুন বছরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতাদের অনেকেই পুরো বছরের অর্ডার দেয়ার জন্য আলোচনা শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন পোশাক রফতানিকারকরা। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের নেতা আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাজার হাতছাড়া হওয়ার যে ভয় ছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে। নতুনভাবে ভরসা পাচ্ছি আমরা। আশা করছি, এই স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সব পক্ষই উদ্যোগী হবে। এখন যে অবস্থা চলছে তা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব বাজারে আমাদের তৈরি পোশাকের কদর আরও বাড়বে। বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে। রফতানি খাতকে উত্সাহিত করতে সরকার এরইমধ্যে বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে বলেও জানান ব্যবসায়ী নেতারা। এসব সুবিধার মধ্যে টিটির মাধ্যমে রফতানিতে ৫ পাঁচ শতাংশ নগদ সহায়তা, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুদহার কমানো, ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই অথবা ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ এবং শিল্প পণ্য আমদানিতে আগাম মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা অন্যতম। দেশের সব খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে এর বাইরেও অনেক বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর সব পদক্ষেপকেই ইতিবাচক কৌশল হিসেবেই বর্ণনা করেন সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপি যাতে আন্দোলনের কোনো ইস্যু হাতে তুলে নিতে না পারে। বিএনপি আন্দোলন করতে না পারলে বিদেশিরা তাদের হয়ে সরকারের ওপর সংলাপ বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করবে না। বিদেশিরা যদি কোনো কারণেও চাপ দেয়ার চিন্তাভাবনা করে তখন সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশর পুনর্গঠন এবং সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়টি উপস্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এ দুটি বিষয়টি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রথম প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। এটা মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হবে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করা হবে। সেখান থেকে বিল আকারে উপস্থাপন করা হবে জাতীয় সংসদে। সেখান থেকে যাবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। সংসদীয় কমিটি এ লক্ষ্যে আলাদাভাবে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি গঠন করে দিতে পারে। মোট কথা নানা কায়দায় সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে সময় ক্ষেপণের সুযোগ সরকারের হাতে আছে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে এটা বিদেশিদের বোঝানো সহজ হবে। এই ফাঁকে লম্বা সময় হাতে পাওয়া যাবে। এর আগে কিছু দিন চলবে সংলাপ। সংবিধান সংশোধনের পর আসবে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রসঙ্গ। সেখানে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনের যে নজির চালু হয়েছে এবারও সে বিষয়টি সামনে আসবে। তখন কমিটির মাধ্যমে যোগ্য লোক খুঁজে কমিশনে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টিও সময় সাপেক্ষ। এত সবের পরও চাপ থাকলে তা সামলানো খুব বেশি কঠিন হবে বলে মনে করেন না সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। উৎসঃ বর্তমান Share on facebook Share on email Share on print 4

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন