শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৪


সরকার নিপীড়নমূলক পদক্ষেপের দিকেই অগ্রসর হবে বলে আমার আশঙ্কা : ড. হোসেন জিল্লুর রহমান 10 Jan, 2014
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল - ঔপনিবেশিক শাসন ও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এছাড়া রাজনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও সুশাসন বিষয়েও তার রয়েছে গবেষণা। তিনি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান। প্রশ্ন: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে ও বিদেশে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: কয়েকভাবে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এক. নির্বাচনের বহু আগে সব রেকর্ড ভঙ্গ করে অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এ নির্বাচনটি প্রশ্নবিধ হবে। এর মাধ্যমে ওইসব এলাকার ভোটাররা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই একটি কারণেই নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কথা। দুই. পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে গাফিলতির মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দায়ও কম নয়। অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়েও শুধু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের ইস্যুটি বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হবে যে, নির্বাচন কমিশন কাজ করেছে আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তিন. ভোটের দিনের পরিস্থিতি। ওই দিন নির্বাচন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন যে তথ্য দিয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। নিজের অভিজ্ঞতা, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং প্রত্যক্ষদশীদের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার। যেসব পরিসংখ্যান এখন নির্বাচন কমিশন ও সরকার দেয়ার চেষ্টা করছে এবং সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশীয় পর্যবেক্ষকরা দিয়েছেন, তাও গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম। আমরা দেখেছি, ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো কম। এর মধ্যেও বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে কারচুপির চেষ্টা ছিল লক্ষণীয়। সব মিলিয়ে দেশের ইতিহাসে খারাপ একটি নির্বাচনের উদাহরণ হয়ে থাকল ৫ জানুয়ারি। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি, তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি তাদের দেয়া মন্তব্য থেকে। মানুষের বক্তব্য-মানোভাব এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া থেকে বিষয়টি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রশ্ন: যেসব সংসদীয় আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে ভোটারদের ভোট প্রদানের সুযোগ ছিল। তারা ভোট দিতে যাননি কেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সহিংসতা ও আতঙ্কের একটি বিষয় সেখানে ছিল। তবে সার্বিকভাবে মূল কারণ ছিল ভোটাররা এ নির্বাচনকে অর্থবহ মনে করেনি। এটাই ছিল তাদের কম উপস্থিতির মূল কারণ। সেজন্যই তারা ভোট দিতে যায়নি। এখন নির্বাচন কমিশন ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছে, এটাও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে। প্রশ্ন: নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছে, এর ফল কী দাঁড়াবে বলে আপনি মনে করেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর না হয় দেয়া গেল। কিন্তু পরিস্থিতি কী হবে, তা অনুমান করা কঠিন। সার্বিক দিক থেকে এ নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করা দরকার। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের পদক্ষেপ; যেখানে জনগণের সম্মতি বা রায়ের মুখোমুখি না হয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছেন অনেকে। এর বিপরীতে বিরোধী দল জনসম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব না দিয়ে সহিংসতার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে চাইচ্ছে। এক্ষেত্রে তারাও প্রাধান্য দিচ্ছে ক্ষমতা যাওয়াকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এতে তারা সফল হয়নি। আমি আগেও বলেছি, গত ২৩ বছর ধরে আমরা নূন্যতম যে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছিলাম, মনে হচ্ছে সে অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। ১৯৯০ সালের পর যেমন গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রা হয়েছিল, এবারে সৃষ্ট জটিলতা কখন এবং কীভাবে সমাধান হবে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমাদেরকে অনেক বন্ধুর পথ পাঁড়ি দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। প্রশ্ন: অনেকে এখনো ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের পুনরাবৃত্তির কথা বলছেন। আপনি কি মনে করেন পরিস্থিতি সে ধারাতেই এগোচ্ছে? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের সঙ্গে এ সংকটের মৌলিক তফাৎ হলো, তখন রাজনীতিকদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের এক ধরনের মানসিকতা ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সমাজ থেকেও সম্ভাব্য নানা সমাধানের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু এবারের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকার-বিরোধী দল কেউই নাগরিকদের কথা আমলে নিচ্ছে না। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে জাতীয় যে ঐকমত্য রয়েছে, তাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা নিয়েও এক ধরনের রাজনৈতিক দোলাচল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি নিয়েও রাজনীতি চলছে। পুরো বিষয়টি আরো জটিল হয়েছে, একপেশে নির্বাচন এবং তার সুবিধাভোগী সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন, যা আগে কখনো হয়নি। দেশটির সমর্থন বাংলাদেশের পুরো পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তোলার সমূহ শঙ্কা রয়েছে। এ সুযোগে বিরোধী গোষ্ঠীও নৈরাজ্যের ওপর অধিক জোর দিয়েছে। তারা যে জনসম্পৃক্ততার ওপর জোর দিতে পারেনি, সে বিষয়টিও এখন পরিষ্কার। আস্থা রাখা এবং সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার মতো অবস্থান তারা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। প্রশ্ন: নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এক ধরনের উদ্যোগ আমরা লক্ষ করেছিলাম। সেখানে ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নাগরিক সমাজের সামনেও এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। এতদিন তারা যে গণ্ডিকে নিজেদের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল - আলোচনা, সেমিনার প্রভৃতির মাধ্যমে সুপরামর্শ দেয়া, এর মধ্যে থেকে কাজ হচ্ছে না। সরকার এ ধারায় অগ্রসর হলে নাগরিক সমাজের অবস্থান আরো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। দেশকে সঠিক পথে আনা এক ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নেয়ার বিষয়। নিরাপদ জায়গা থেকে সুপরামর্শ দেয়ার গণ্ডি থেকে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জায়গায় তারা নিজেদের নিয়ে যেতে পারবেন কি না, এটা তাদের সামনে এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এ পরিস্থিতি নাগরিক সমাজের জন্যও এক ধরনের সংকট। প্রশ্ন: সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষার জন্যই এ নির্বাচন। একে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ক্ষেত্রে অন্যতম দুটি অজুহাত দেয়া হয়েছিল - এক. নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করতে হবে এবং দুই. দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এ দুই অজুহাতকে প্রবলভাবে মিথ্যা প্রমাণ করেছে এবং এক অর্থে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তা ও দাবি আরো জোরালো করেছে। আরেকটি অজুহাত ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এ নির্বাচন করতেই হচ্ছে। সে ব্যাপারেও ব্যাখ্যার অবকাশ আছে। আমরা দেখেছি, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করা হয়েছিল। তাতে কোনো সমস্যা হয়নি। এবারও হতো না। সমস্যা এখন আর সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। প্রশ্ন: এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সামনের দিনগুলো কেমন হতে পারে? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: শুধু রাজনীতি নয়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা দুটি অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে। একদিকে সরকারের নিপীড়ন এবং অন্যদিকে বিরোধী দলের নৈরাজ্য। এ দুইয়ের মাঝখানে থেকে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার আলোচনা এখন উপেক্ষিত। বলতে পারি, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত মেঘাচ্ছন্ন। এর প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রেই। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি। কারণ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ - তিন মেয়াদেই অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। প্রশ্ন: ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রাপ্তির পেছনে অন্যতম ফ্যাক্টর ছিল তরুণ সম্প্রদায়। এবার ভোট প্রদানে তাদের মধ্যেও তেমন একটা উৎসাহ লক্ষ করা যায়নি। একে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: হ্যাঁ, দিন বদলের স্বপ্ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - প্রভৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তরুণরা দলটিকে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছিল ২০০৮ সালে। পাঁচ বছরের মাথায় এসে তরুণরা দেখতে পেয়েছে এক ভিন্ন রাজনৈতিক সত্ত্বা। যেখানে এসব শ্লোগানের চেয়ে ক্ষমতার দম্ভ, গণতান্ত্রিক মূলবোধের অনুপস্থিতি ও দুর্নীতির বিষয়গুলোই প্রধান হয়ে উঠেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে তাকালে আমরা দেখব, মাঠে তরুণদের উপস্থিতি একেবারে শূন্যের কোঠায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ধরনের আলোচনা দেখি, তাতে বুঝতে পারি তাদের মোহভঙ্গ হয়েছে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার মতো দৃঢ় নেতৃত্বের পরিবর্তে সরকারের ভিন্ন চরিত্র তারা দেখতে পেয়েছে - যা দাম্ভিক ও নিপীড়নমূলক। আমার মনে হয়, এ কারণে তরুণ সমাজও ক্ষমতাসীন দল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারাও শঙ্কিত। প্রশ্ন: এমন পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের আচরণ কেমন হতে পারে? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আমার মনে হয়, সরকারের আচরণ নিয়ে কোনো মোহের মধ্যে থাকার অবকাশ নেই। সরকারের আচরণ কেমন হবে, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনেই সেটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল - এ মূল সত্যকে স্বীকার করতে সরকার বিন্দুমাত্র রাজি নয়। ম্যান্ডেট যেহেতু দুর্বল, রাষ্ট্রযন্ত্র সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং পার্শ্ববর্তী দেশের সমর্থনও রয়েছে তাদের প্রতি - এমন পরিস্থিতিতে স্বল্প মেয়াদে সরকার নিপীড়নমূলক পদক্ষেপের দিকেই অগ্রসর হবে বলে আমার আশঙ্কা। এর দৃষ্টান্ত আমরা এরই মধ্যে দেখতে শুরু করেছি। ফলে অর্থনীতি, সমাজ এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ধারাবাহিকতা নিয়ে আমাদের মনে যে শঙ্কা আছে, তা হয়তো সত্যে পরিণত হবে। প্রশ্ন: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার আরেকটি দিক হলো, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির স্পেস সংকুচিত হওয়ায়। এখানে বিরোধী দলের অফিস বন্ধ, দলীয় প্রধান গৃহবন্দী, তাদের প্রতি শুট টু কিল পলিসি নেয়া প্রভৃতি পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার ভুল বার্তা দিচ্ছে। এতে বিরোধী দলের যে অংশ নৈরাজ্যের মাধ্যমে এর সমাধান করতে চাইচ্ছে,তারা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হতে পারে। যারা গণতান্ত্রিকভাবে বিরোধী কার্যক্রম চালাতে পারত, তাদের গৌণ করে ফেলা হচ্ছে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করার পরিবেশ আর থাকছে না। তবে মনে রাখতে হবে, যে পন্থাই আমরা গ্রহণ করি না কেন, জনসম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই। কয়েক মাস ধরে আমরা দেশে রাজনৈতিক সংকট দেখতে পাচ্ছি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এতে আমাদের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশ্ন: এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: হ্যাঁ, রাজনৈতিক অঙ্গনে সংকট তো আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যেই নির্বাচনী প্রতিযোগিতার আড়ালে আরেকটি গোষ্ঠী সহিংসতা ছড়াতে সক্রিয়। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট নিয়েই এখন আলোচনা হচ্ছে বেশি। তবে লক্ষণীয়, দীর্ঘমেয়াদে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কম। আমাদের অর্থনৈতিক সংকট বৈশ্বিক বা স্থানীয় কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্টি হয়নি। রাজনৈতিক কারণে অর্থনৈতিক সংকট দানা বাঁধিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। এটি দীর্ঘ হলে অর্থনৈতিক সংকট আরো বাড়তে পারে। আমার মনে হয়, সংকটের চেহারা এখনো আমাদের সামনে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি। দিন যত যাবে, এটি ততই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। প্রশ্ন: কীভাবে এ সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এটি হতে পারে নানাভাবে। ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূচনার পর থেকে বাংলাদেশ বিদেশীদের জন্য একটি ভালো বিচরণক্ষেত্র ছিল। এটা আমাদের জন্য খুলে দিয়েছিল সুযোগের দ্বার। গত ২৩ বছরে বিশেষত উদ্যোক্তাশ্রেণী যেখানেই অর্থনৈতিক সুযোগ পেয়েছে, সেখানেই ছুটে গেছে। আমরা তার সুফলও পাচ্ছিলাম। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় সে বাস্তবতা এক ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এর বেশকিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেসের (জিএসপি) পাশাপাশি আরো অনেক সুবিধা ব্যাহত হতে পারে। কাকতালীয়ভাবে ইউরোপের বাজারে জিএসপিও রিভিউ হচ্ছে এখন। প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নয়, এমন একটি নির্বাচনকে ইউরোপিয়ানরা দেখছে গণতন্ত্রের স্খলন হিসেবে। এ সূত্র ধরেই জিএসপি সুবিধার বিষয়টি তারা পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রও বাড়তি কিছু করতে পারে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকের ক্ষেত্রেও এক ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। সামাজিক সূচকে অগ্রগতি, উন্নয়ন বিস্ময় প্রভৃতি বিশেষণের পরিবর্তে বাংলাদেশকে এখন অভিহিত করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সাময়িকী ২০১৪ সালে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে যেসব দেশকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, আমাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে, যার ফলে গত কয়েক বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের জন্য যে খোলা সীমান্ত ছিল, তাতে এক ধরনের ছন্দপতন হতে যাচ্ছে। এগুলোর অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতি সম্পৃক্ত। সেটি কিন্তু এ নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত নয়। যারা সরকার গঠন করেছেন, তারা যেকোনো ভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন। ১৯৯০-পরবর্তীতেও এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। তবে সেটি এখন পূর্ণ চেহারা পেয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রশ্ন: শাসকশ্রেণীর এ ধরনের মানসিকতা থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট এবং চলমান সংকটের মধ্যে কোনো ভিন্নতা রয়েছে কি? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনার মাত্রা কতটুকু হবে, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। সবসময়ই কিছু বিবেচনা থাকে। তবে দলীয় বিবেচনা বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুযোগ-সুবিধা করে দেয়ার জন্য এ ধরনের কুবিবেচনা প্রভাব ফেলে বৈকি। এর মাত্রা একটা পর্যায় অতিক্রম করলে তা অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। আবারো বলছি, এটা এ মুহূর্তের সংকট থেকে ভিন্ন। প্রশ্ন: সেটি কী? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: প্রথম থেকেই যে কয়টি সরকার এসেছে, তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে একনায়কতান্ত্রিক বাস্তবতা তৈরি করা এবং দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়া। সেগুলো যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে, তেমন অর্থনৈতিক খাতে ব্যবস্থাপনাগত পদগুলোয় যারা থাকবেন, তাদের নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রেও। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে দলীয় ও পক্ষপাতদুষ্ট বিবেচনার মাত্রা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির বাস্তবতায় তা অতিক্রম করে গেছে - যেটাকে বলে ক্রনি ক্যাপিটালিজম। এটা আমরা একসময় সুহার্তোর অধীনে ইন্দোনেশিয়ায় দেখেছিলাম বা অন্যান্য জায়গায় দেখি। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। সেখানেও সহায়তা জোগানো হয়। তবে সেটা অর্থনীতিকে বেগবান করার জন্য। কিন্তু আমাদের এখানে করা হচ্ছে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য। নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের হলফনামায় দেখলাম, যারা বিভিন্ন ব্যবসার লাইসেন্স পেয়েছেন, তারা যে ওই খাতের উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন তা নয়; এরা মূলত মধ্যস্বত্বভোগী। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের অবস্থান অনেক বেশি জোরালো হচ্ছে। এরা লাইসেন্স বিক্রি করছেন অথবা সাইলেন্ট পার্টনার দিয়ে ব্যবসা করছেন। এটা আগেও ছিল। তবে এর মাত্রা এখন এতটাই চরম আকার ধারণ করেছে যে, আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির বাস্তবতা অতিক্রম করে গেছে। প্রশ্ন: বর্তমান সরকারের আমলে আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা গেছে। একে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ব্যাপক ক্ষয় হয়েছে, যার অন্যতম উদাহরণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা। গত ২৩ বছরে রাজনৈতিক সরকারগুলোর মধ্যে ব্যাংকিং খাতকে অক্ষত রাখার এক ধরনের ব্যবস্থা কিন্তু ছিল। পেশাগত দক্ষতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া এবং রাজনৈতিক বিবেচনা এমনভাবে সম্পন্ন করা হতো, যাতে তা ওই খাতের সক্ষমতার ওপর প্রভাব না ফেলে। ধাপে ধাপে এর অবনতি হচ্ছিল। তবে এবার আমরা দেখতে পেলাম যে, অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। ব্যাংকিং খাতের এমন অধঃপতন এ সরকারের আমলে একটি ‘কালো দাগ’ হয়ে থাকবে। কারণ ব্যাংকিং খাত কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আর্থিক খাতে অন্য যেসব কেলেঙ্কারি হয়েছে, সেগুলোও আমরা দেখেছি। প্রশ্ন: এজন্য কি শুধু ব্যবস্থাপনা বা সুশাসনের অভাবই দায়ী, নাকি অন্য কিছু? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এ সূত্র ধরে দুর্নীতির বিষয়টাও বলা দরকার। এটাও কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব না দেয়ার একটি ফল। দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমরা আগে তলায় ছিলাম, এখন কিছু উপরে উঠেছি। উদাহরণস্বরূপ অবকাঠামো খাতের কথা বলা যেতে পারে। এ খাতে দুর্নীতি আরো গেড়ে বসেছে। শুধু তা-ই নয়, এর সঙ্গে মানসিকতাও বদলেছে। পদ্মা সেতু এর অন্যতম উদাহরণ। এর চেয়ে আরো বড় দুর্নীতি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পুরো বিষয়টা অদক্ষতার সঙ্গে হ্যান্ডল করা হয়েছে। সমস্যা হলো, স্বীকার না করার প্রবণতাই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির চেয়ে ‘দুর্নীতি নেই’ মনোভাব বেশি ক্ষতি করছে। প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংকটে পড়ছে। সরকারের ধ্যান-ধারণা অতি রাজনীতিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। অর্থনীতির মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনগুলো বিবেচনায় রেখে যেসব উদ্যোগ নেয়ার কথা ছিল, তা ক্রমে গৌণ হয়ে পড়েছে। জ্বালানি নীতি এর জ্বলন্ত উদাহরণ। গুরুত্বপূর্ণ হলেও এক্ষেত্রে সরকার তেমন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। অর্থনীতি বিচিত্রকরণের ক্ষেত্রেও আমরা খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছি না। অর্থনীতির আঞ্চলিক সম্ভাবনার সুফল পেতে হলে যেভাবে লেগে থেকে ধারাবাহিকভাবে নীতি-উদ্যোগ নিতে হয়, তাতেও ব্যাঘাত ঘটছে। সবকিছুই হয়ে গেছে রাজনীতিকেন্দ্রিক। সব মিলিয়ে এখন সংকট নির্বাচনকেন্দ্রিক হলেও বৃহত্তর অর্থে আমাদের অর্থনীতি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে সংকটে পড়তে যাচ্ছে। প্রশ্ন: চলমান রাজনৈতিক সংকট তো আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: বিগত দিনগুলোয় একটি শাসনামলের পরের শাসনামলে প্রবৃদ্ধি সবসময়ই ছিল ইতিবাচক। অর্থাৎ প্রতি শাসনামলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। এই প্রথমবারের মতো প্রবৃদ্ধি আগের আমলের তুলনায় কমে গেছে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মাত্রা ৫ শতাংশেরও নিচে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি ঐতিহাসিক ছন্দপতন। এ ছন্দপতন দীর্ঘায়িত হবে কিনা, তা নিশ্চিত নয়। তবে রাজনৈতিক সংকট এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে হয়তো আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরতে পারব না। প্রশ্ন: এমন সংকট সৃষ্টির কারণ কী? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ঔপনিবেশিক আমল থেকে বের হয়ে এসে রাষ্ট্রগুলো স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করছে। সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে এমনভাবে ত্বরান্বিত করা হয়, তাতে রাষ্ট্রের দক্ষতার সঙ্গে বিকাশের বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। এমন রাজনীতির মাধ্যমে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতা ধরে রাখা বা ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে সমস্যাটা নিহিত। এ ধরনের রাজনীতি অনেক সময় প্রয়োজনীয় হতে পারে। তবে এটি যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন বিভাজনের ইস্যুগুলোই মূলত সামনে আসছে। প্রশ্ন: এসব থেকে সামাজিকভাবেও কিছু সংকট সৃষ্টি হচ্ছে… ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আমাদের সমাজে বিভাজন আগে তেমন ছিল না। আসলে ভাষাগতভাবে আমরা ঐক্যবদ্ধ একটি দেশ। এথনিক ডাইভারসিটি থাকলেও সাধারণভাবে আমাদের মধ্যে বিভাজন প্রকটা ছিল না। বাংলাদেশকে আমরা এ সমস্যার ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছিলাম। এখন আত্মপরিচয়মূলক রাজনীতিকে খুব বেশি উসকে দেয়ার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। যৌক্তিক আবেগ থাকা ভালো। তবে অন্ধ আবেগের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা আমাদের জন্য বড় চিন্তার। প্রশ্ন: স্বাধীন দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ কী? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম, তার একটা আদর্শিক ভিত্তি ছিল। সে সময় যেসব মূল্যবোধ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, তা ছিল মূলত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সাম্য নিশ্চিত করা। এটি লিখিত না থাকলেও মানুষ সেটাই মনে করত। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, সামাজিক ভিন্নতাকে বিভাজন হিসেবে না দেখা। ছিল সমৃদ্ধির সৎ আকাঙ্ক্ষা। এসব মূল্যবোধ আমাদের সামাজিক শক্তি হিসেবে রয়ে গেছে। এ মূল্যবোধের মধ্যে ধর্ম, দেশপ্রেম প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারপূর্বক জোর করে বিভাজন সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। আমরা সর্বশেষ দেখছি, আঞ্চলিক পরিচয়কেও পলিটিকস অব আইডেনটিটির চরম একটি জায়গায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ৪২ বছরে বাংলাদেশ যেখানে সম্মুখপানে হাঁটার বাস্তবতা তৈরি করেছে, নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের মূল চাহিদা যেখানে সৎ আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়ার সেখানে এ দেশের মানুষের সহজাত আকাঙ্খার বিপরীতে ক্ষমতাসীন ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী বাংলাদেশকে পিছু হটানোর চেষ্টায় লিপ্ত। অর্থনীতি এখানে একটি উপেক্ষিত বিষয় বলে মনে হচ্ছে। আমাদের সবার একটু থমকে দাঁড়ানো দরকার। আত্মপরিচয়মূলক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ভিন্নতা যদি আমাদের অস্তিত্ব সংকটের পর্যায়ে নিয়ে যায়, তা ভালো ফল দেবে না। এর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিও ধসে পড়ার একটা বাস্তবতা তৈরি হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন: নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এর মূল কারণ কী - রাজনৈতিক নাকি প্রশাসনিক ব্যর্থতা? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। নির্বাচন-পরবর্তীকালে কয়েকটি স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, সেটিও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। দিনাজপুর শহর থেকে ৭-১০ মিনিটে পৌঁছানো যায়, সেখানেও কেন পুলিশ নিরাপত্তা দিতে যেতে পারছে না? যশোরের অভয় নগরে যে প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, তিনি শাসক দলের। বিজয়ী প্রার্থী সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের জন্য পরাজিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, সংখ্যালঘুদের মধ্যেও যারা বেশি নিরীহ, তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিক খেলার পাশার ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। শুনেছি, অভয় নগরে ফায়ার ব্রিগেড যেতে চাইলেও সেখানে তাদের যেতে দেয়া হয়নি। আবার দিনাজপুরে পুলিশ বা ফায়ার ব্রিগেড যায়নি। সার্বিকভাবে বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে একপেশে এবং খুবই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, সংখ্যালঘুদের ওপর এ ধরনের আক্রমণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং এ বিষয়ে সংর্কীণ রাজনৈতিক ফয়দা লোটার কৌশলে না গিয়ে আক্রান্ত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। প্রশ্ন: সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা রয়েছে কী? ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: একজন মানুষ, সে সংখ্যালঘু ধর্মীয়, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক - যে কারণেই হোক, এসব ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে নিরীহ অংশ। সবাই বলছেন,আমরা শান্তি চাই। আমারও বক্তব্য সেটাই। আমিও মনে করি, মানুষ শান্তি ও উন্নয়ন চায়। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, আমরা একটা গভীর সংকটের মধ্যে সংকীর্ণ ক্ষমতার লড়াইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হচ্ছি। আর সরকারি দলের প্রতি ভারতের সমর্থন পুরো বিষয়টাকে আরো জটিল করে ফেলেছে। (আমাদের বুধবার, ১০/০১/২০১৪) Share on facebook Share on email Share on print 2

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন