বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আনন্দ বাজার এবং শাহ মোয়াজ্জেমের স্পর্শকাতর মন্তব্য
17 Dec, 2013
মোবায়েদুর রহমান
ভারতের আস্কারা পেয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নির্বাচন নিয়ে যে খেলা খেলছে সেটিকে বাঁদর নাচ বললে বেশি বলা হবে না। গত রবিবার বেলা ২টার টেলিভিশন সংবাদে দেখলাম, এ পর্যন্ত ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে। নির্বাচন কমিশন সূত্রের বরাত দিয়ে ঐ প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের খবরে বলা হয়েছে, এই সংখ্যা অর্থাৎ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তাদের সংখ্যা ১৫৪ ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ অবরোধ ও হরতালের কারণে মফস্বল থেকে সম্পূর্ণ তথ্য নাকি এখন ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের হাতে এসে পৌঁছায়নি। ইতোমধ্যেই নির্বাচিত হওয়ার পথে ১৫৪ জন। জাতীয় সংসদের মোট সদস্যের অর্ধেকেরও বেশি। এই সংখ্যা দিয়ে সহজেই দেশের পরবর্তী সরকার গঠন করা যায়। তাই বিদগ্ধ জনেরা বলছেন যে, সরকার গঠনের মত আসন পাওয়া গেছে। আর নির্বাচন করে লাভ কি? আবার অন্যেরা বলছেন, পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক, সভ্য এবং উন্নত দেশের পার্লামেন্টে অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়নি। জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদ রবিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, এই তথ্য অর্থাৎ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদের অর্ধেকেরও বেশি অংশ গঠনের সংবাদ, গিনেজ বুকে স্থান পেতে পারে। পৃথিবীতে নির্বাচনের নামে এত বড় তামাশা অতীতে আর কখনো হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে মার্কিন প্রস্তাবে হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এমন একটি নির্বাচন হবে সেটি কেউই আশা করেনি। এমনি কারো ধারণাতেও সেটি ছিল না।
বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার প্রভৃতি নিয়ে ভারত আমেরিকার সাথে প্রতিনিয়ত দেন-দরবার করে চলেছে। ভারত চায় আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসুক। ভারত আরো চায় যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় বিএনপির প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধ করা। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং কয়েকদিন আগে যখন ঢাকা সফরে এসেছিলেন তখন তিনি ভারতের এই ইচ্ছা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাছে ব্যক্ত করেন। এরশাদ সেই কথা প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে জানিয়ে দেন। মনে হচ্ছে, সেটিই হয়েছে এরশাদের কাল। এরশাদ সুজাতা সিংকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্ষমতায় আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। কারণ, জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগের আর কোন সমর্থন নেই। এমন কি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়া নির্বাচনী এলাকাতেও যেতে পারবে না। এরশাদের এই ধরনের স্পষ্ট উচ্চারণের কারণেই সম্ভবত তাকে চিকিৎসার নাম করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আটক রাখা হয়েছে।
নির্বাচনের উপরোক্ত ফলাফল ঘোষণার আগের মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এসব মিলিয়ে মার্কিন প্রশাসন শুধু নয়, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়েও এটি নিয়ে ভারত আলাপ-আলোচনা করেছে। এসব কথা জানা গেছে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার প্রত্রিকার রিপোর্টে। ‘আনন্দ বাজারের’ একটি খবরের বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউজ থেকেও নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করা হয়েছিল। গত শনিবার দৈনিক ইনকিলাবে কোলকাতার আন্দবাজারের একটি সংবাদ ছাপা হয়। আনন্দবাজারের উদ্ধৃতি দিয়ে ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে, বিএনপির কথা মেনে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে নির্বাচন দেয়ার অনুরোধ করেছিল হোয়াইট হাউস। এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ফোনে কথাও বলেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। এই প্রতিবেদনে জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে মার্কিন মনোভাবও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, আমেরিকা মনে করে, জামায়াতে ইসলামী জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়। তাই রাজনৈতিক পরিসরে তাদের জায়গা দিলে, মৌলবাদী তালিবানপন্থীদের সঙ্গে লাড়াইয়ে আমেরিকাই লাভবান হবে। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশে ভারতীয় লাইনে ভূমিকা নিতে আমেরিকার ওপর চাপ তৈরি করছে ভারত। বাংলাদেশ নিয়ে হোয়াইট হাউসের অবস্থানে হতাশ সাউথ ব্লক। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে, কোনও আড়াল না রেখেই, সেই হতাশার কথা নাকি আমেরিকাকে জানিয়েছে ভারত। বিদেশ সচিব সুজাতা সিং তার সদ্যসমাপ্ত মার্কিন সফরে সে দেশের বিদেশ সচিব ওয়েন্ডি শেরম্যানের সঙ্গে ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাউথ ব্লক মার্কিন নেতৃত্বকে স্পষ্ট জানিয়েছে, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্বের উচিত, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক এবং হিংসামুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা।
দুই
কিন্তু বাংলাদেশে গণবিরোধী এবং সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ভারতই আওয়ামী লীগ সরকারকে উস্কানি দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমেরিকা এখনও সক্রিয়ভাবে সাড়া দেয়নি বলে মনে করে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়। সরকারি সূত্রের দাবি, আমেরিকা মনে করে, জামায়াতে ইসলামী জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়। তাই রাজনৈতিক পরিসরে তাদের জায়গা দিলে, মৌলবাদী তালিবানপন্থীদের সঙ্গে লড়াইয়ে আমেরিকার লাভই হবে। হোয়াইট হাউস থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফোনও গিয়েছে। তাকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে, বিএনপির কথা মেনে শেখ হাসিনা যেন নিজে পদত্যাগ করেন এবং সেই সাথে তার সরকারও পদত্যাগ করেন।
পক্ষান্তরে ভারত আমেরিকাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, জামায়াতের হিংসাত্মক কাজের জন্যই বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। আনন্দবাজারের রিপোর্ট মোতাবেক, গত শনিবার ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন জানান, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে কথা হয়েছে। বিদেশ সচিব মার্কিন নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিকে দেখা হয়েছে।’
আনন্দবাজারে আরো বলা হয়, কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে উত্তাল বাংলাদেশ। সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কায় ভারতও। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের কথায়, ‘আমরা এ কথা বিশ্বাস করি যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষ হিসেবে বাংলাদেশী রাজনীতিকরা তাদের মতপার্থক্য কথার মাধ্যমেই মেটাবেন।’ বাংলাদেশ থেকে আবার কিছু মানুষকে ভাগিয়ে শরণার্থী বাননোর তালে আছে ভারত। মুখে সংলাপের কথা বললেও বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা নয়াদিল্লীর রয়েছেই। এই কথা মনে করে আনন্দবাজার। পত্রিকাটি আরো বলে যে, যে সুবিপুল পুঁজি ইসলামিক ব্যাংকের মাধ্যমে জামায়াতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের হাতে গিয়েছে, তার কুপ্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে ভারতেও পড়তে পারে বলে নয়াদিল্লির আশঙ্কা। অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনও এ সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে বলে তারা মনে করে। আনন্দবাজার খবর দিচ্ছে যে, সম্ভাব্য শরণার্থীর প্রবেশ রোধের জন্য পাঁচ হাজার বাড়তি বিএসএফ জওয়ান মোতায়েন হয়েছে।
তিন.
আনন্দবাজারের এই রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়েছে ভারত। শুধু জড়িয়ে পড়া নয়, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে আমাদের দেশের রাজনীতিতে মারাত্মকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, ভারতের নির্দেশেই জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি এখন বিএনপি নেতা এবং এক সময় বাংলাদেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এক সময় তিনি ছাত্র লীগের সভাপতি ছিলেন এবং শেখ মুজিব সরকারের পার্লামেন্টারি দলের চিফ হুইপ ছিলেন। তিনি হলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। গত রবিবার ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ডবল কলাম শিরোনামে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের এই বক্তব্য ছাপা হয়েছে। শিরোনামটি ছিল, ‘বাইরের নির্দেশে কাদের মোল্লাকে হত্যা করা হয়’। খবরে বলা হয়, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের স্বার্থে যারা (ভারত) এখানে এসে পাকসেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের নির্দেশেই জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আপনারা (সরকার) কাদের নির্দেশে আইনের সংশোধন করে তাকে হত্যা করেছেন তা আমরা জানি। তিনি বলেন, কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়ার আগে আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। তাকে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর্যন্ত সুযোগও দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, অন্যের নির্দেশে এবং আইনের তোয়াক্কা না করে কাদের মোল্লাকে হত্যা করার অপরাধে ক্ষমতাসীনদেরও একদিন বিচারের মুখোমুখী হতে হবে। তিনি বলেন, এই সরকার যাকে ফাঁসি দিয়েছে সেই কাদের মোল্লার বাসায় আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ দিনের পর দিন মিটিং করেছেন। অথচ তারাই তাকে হত্যা করলো। ফাঁসির এই নির্দেশ কোত্থেকে এলো তা আমরা জানি। ১৪ ডিসেম্বর (শনিবার) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে’ আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সরকারকে উদ্দেশ্য করে বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, কিভাবে এবং কাদের কথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন সেটা জনগণ ভালো করেই জানে। আর এর জন্য আপনাদের বিচারও করা হবে। দেশে দুই সরকার রয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের আইন কে পরিবর্তন করলো? শাহবাগের আন্দোলনের পর সরকার আইন পরিবর্তন করে কাদের মোল্লাকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, দেশে শাহবাগের কথায় সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে, একজন মুক্তিযুদ্ধা হয়ে এটা দেখে আমর খুব কষ্ট লাগে।
প্রিয় পাঠক, এসব বিষয় অত্যন্ত সেনসিটিভ এবং স্পর্শ কাতর। তাই আজকের এই কলামে আমরা এই ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে নিজেরা কোন কথা না বলে গুরুত্বপূর্ণ মহল এবং ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিলাম। পাঠক ভাই-বোনেরা সমগ্র বিষয়টি নির্মোহভাবে বিবেচনা করবেন।
উৎসঃ ইনকিলাব
Share on facebook Share on email Share on print 14
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন