শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩
হিংসার রাজনীতি, বিপন্ন মানুষ
29 Dec, 2013
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে বিজয়ের মাসে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়েছিল। এরপর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সরকারের যাত্রা শুরু হয়, তাকে যদি গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা ধরা হয়, ২৩ বছর পর বিজয়ের মাসে এসে সেই যাত্রা কোথায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে?
২০১৩ সালের শেষে এসে দেশের রাজনীতির হালখাতায় বিভেদ-বিভক্তি, হিংসা-বিদ্বেষ, বলপ্রয়োগ-রক্তক্ষরণ ও অবিশ্বাস-অনিশ্চয়তার যে চিত্র পাওয়া যায়, তা অতীতের যেকোনো সময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনেক দিন ধরে চলে আসা হিংসার রাজনীতির সঙ্গে এ বছর যুক্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর হিংস্রতা।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের যন্ত্রণা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। বিএনপির লক্ষ্য নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন। আর সরকারের ইচ্ছা রূপকল্প ২০২১। এই ত্রিমুখী স্বার্থের লড়াইয়ে ২০১৩ সালে বিপর্যস্ত পুরো দেশ।
শুরু থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলে আসছে, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেভাবে নির্বাচন হয়, সেভাবেই নির্বাচন হবে। সংবিধান থেকে ‘এক চুলও নড়চড় হবে না’।
আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বক্তব্য, উচ্চ আদালতের রায়ে আরও অন্তত দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়কের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক বাদ দিয়েছে।
বছরের শুরুতে ১১ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, সংবিধানের বাইরে যাবেন না। একই সঙ্গে তাঁর সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন। তাঁর এ ঘোষণার পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দুই দলের মধ্যে অবিশ্বাস আরও বেড়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। পুরো বছর ধরে সরকার চেয়েছে নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারকে একত্র করে প্রধান বিরোধী দলকে চাপিয়ে রাখতে। আর, জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা এবং আন্দোলন কর্মসূচি সফল করতে দলটির ওপর নির্ভরতার কারণে এই বৈরী পরিস্থিতি থেকে বের হওয়াও বিএনপির জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে মুখে যতই ‘আন্তর্জাতিকমানের’ যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলুক না কেন, এ বিষয়ে দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি বিএনপি।
বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার ঘোষণা দিয়ে ৩০ জানুয়ারি থেকে গতানুগতিক হরতালের রাজনীতি শুরু করলেও সরকারকে খুব একটা চাপে ফেলতে পারেনি। জোটের শরিক জামায়াতের কর্মীদের সহিংস কর্মকাণ্ড বাদ দিলে বছর ধরে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের খুব একটা মাঠে দেখা যায়নি। হরতাল-অবরোধে চোরাগোপ্তা হামলা হয়ে ওঠে কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান অনুষঙ্গ। বছরের শেষ দিকে এসে শুরু হয় বাসে-গাড়িতে পেট্রলবোমা মেরে বা আগুন ধরিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার হিংস্র তৎপরতা।
অবশ্য বিএনপির নেতারা অভিযোগ করে আসছিলেন, পুলিশ তাঁদের মিছিল, সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচিও ঠিকভাবে পালন করতে দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা, সেখানে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আটকের ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি দলটির কোনো কোনো নেতাদের গুম করার অভিযোগও কম নয়।
তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় প্রত্যাখ্যান করে ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে ‘গণজাগরণ’ সৃষ্টির পর কয়েক মাস রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে অনেকটা হারিয়ে গিয়েছিল বিএনপি। কিছুদিন জামায়াত থেকে দূরে থাকার কৌশল হিসেবে জোটগত কর্মসূচিও বন্ধ রেখেছিল বিএনপি। এমনকি একপর্যায়ে গণজাগরণ মঞ্চকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতিও দেয় দলটি। যদিও অল্প কদিন পরই এর বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি শুরু করেন দলটির নেতারা।
২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় বের হওয়ার পর জামায়াত দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা চালায়। এরই মধ্যে ১৩ দফা দাবি নিয়ে ভয়ংকরভাবে দৃশ্যপটে আসে হেফাজতে ইসলাম। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই ধর্মীয় গোষ্ঠী ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে রাতারাতি প্রভাবশালী এক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে তখন প্রধান দুই দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ হেফাজতে ইসলাম। ৫ মে হেফাজতের শাপলা চত্বরের কর্মসূচি ঘিরে বিএনপি সরকার পতনের ছক কষছিল বলেও তখন অভিযোগ ওঠে। সমাবেশের দুদিন আগে ৩ মে বিএনপি একই স্থানে সমাবেশ করে এবং ৬ মে থেকে নেতা-কর্মীদের রাজপথে বেরিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছিল।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তখন প্রকাশ্যে হেফাজতের ১৩ দফার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলেও ভেতরে ভেতরে সংগঠনটিকে বাগে আনতে চালিয়েছে নানা তৎপরতা। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও মন্ত্রী ৫ মের আগে দফায় দফায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে বৈঠক করেন। ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি হেফাজতের কর্মসূচিকে প্রকাশ্য সমর্থনও দিয়েছিল।
অবশ্য বলপ্রয়োগ করে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে সরিয়ে দেওয়ার পর আবার কিছুদিনের জন্য চাপে পড়ে বিএনপি। এরপর বিরোধী দলের কর্মসূচিতে শক্তিপ্রয়োগ আরও বাড়িয়ে দেয় সরকার। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখে দিনের পর দিন। ধরপাকড়ের মুখে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের কয়েক দফায় আত্মগোপনেও যেতে হয়েছে।
১৫ জুন পাঁচ সিটি করপোরেশন ও ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সরকারি দলের প্রার্থীদের ভরাডুবির পর বিএনপি নতুন করে উজ্জীবিত হয়। আওয়ামী লীগও নির্দলীয় সরকারের দাবি না মানার ব্যাপারে আরও শক্ত অবস্থানে যায়। তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে এ কথাও আসে যে, আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করার ছক কষছে। এমনকি বিএনপিকে ভাঙার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে গোপনে তৎপরতা ছিল। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামে একটি নতুন দলও গঠন করা হয়। বিএনপির একাংশকে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে এনে বিএনএফ থেকে ভোট করানোর সে পরিকল্পনা অবশ্য শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বিএনএফ এখন টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে ২২টি আসনে ভোট করছে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বছরের শুরু থেকেই আলোচনা বা সংলাপের কথা বলা হলেও উভয় পক্ষই যার যার অবস্থানে ছিল অনড়। সংলাপ নিয়ে দুই নেত্রীর ফোনালাপে তাঁদের মধ্যকার বিভেদ-বিদ্বেষ দেশবাসীর কাছে নতুন করে উপস্থাপিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় এসে দুই পক্ষকে সংলাপে বসাতে সক্ষম হন। তাঁর উপস্থিতিতে দু দফা ও তিনি যাওয়ার পর এক দফা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বৈঠক ছাড়া কার্যত এ সংলাপের আর কোনো অর্জন নাই।
অবশ্য সংলাপের আগেই ২৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা, এক তরফা নির্বাচন, ভোট ছাড়াই ১৫৪ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, এরশাদ ও তাঁর দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে টানাটানি, নাটকীয় কর্মকাণ্ড—সব মিলিয়ে সরকার একটি তামাশার নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে।
অপরদিকে বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ২৬ নভেম্বর থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। এ সময় চোরাগোপ্তা পেট্রলবোমা ও গাড়িতে আগুন ধরিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
‘সংবিধান রক্ষা’ ও ‘ভোটাধিকার রক্ষার’ নামে দুই দলের পাল্টাপাল্টি তৎপরতায় জনগণের সুবিধা-অসুবিধাকে বিবেচনায় নেওয়ার গরজ অনুভব করেনি কোনো পক্ষ। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন ২৮ নভেম্বর শাহবাগে পেট্রলবোমায় দগ্ধ বাসযাত্রী গৃহবধূ গীতা সেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গীতা সেন ১ ডিসেম্বর হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছে পেয়ে আকুতি আর ক্ষোভ মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, ‘আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।...আমরা অসুস্থ সরকার চাই না..’
গীতা সেনের এই আকুতি কি রাজনীতিবিদদের স্পর্শ করেনি। বরং সংবিধান রক্ষার নামে একতরফা নির্বাচনের পথে একরোখা পদযাত্রা এবং জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার কথা বলে ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রার’ নামে বছর শেষে দুই জোট শক্তির খেলায় নেমেছে। একই সঙ্গে প্রকট হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিভাজন। প্রশ্ন উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধ না গণতন্ত্র—কোনটা অগ্রাধিকার? মানুষের জন্য সংবিধান, নাকি সংবিধানের জন্য মানুষ?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শ্বাসরুদ্ধকর একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। সমাধান কোন দিকে জানি না।’
উৎসঃ প্রথম আলো
Share on facebook Share on email Share on print
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন