রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩


Mon, 30 Dec, 2013 02:57:56 AM ‘আধুনিকতা’, আমাদের বোধবুদ্ধি ও হূমায়ূন থেকে শিলা আলাউদ্দীন মোহাম্মদ বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে ছেলেমেয়ের প্রেমকে ‘এই বয়সে একটু-আধটু করেই থাকে’ বলে গার্ডিয়ানরা ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট থাকলেও ছেলে-মেয়ের প্রেমিককে ‘গার্লফ্রেন্ড’-‘বয়ফ্রেন্ড’ নামে পারিবারিক প্রোগ্রামে আত্মীয়স্বজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা ঢাকাই উচ্চবিত্ত সমাজ পেরিয়ে এখন মধ্যবিত্ত সোসাইটিতেও একটা স্টান্ডার্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। আর যারা ভার্চুয়াল্লি পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে আছেন তাদের একটা অংশ আবার একধাপ পেরিয়ে ‘লিভ টুগেদার’ করি বলেও একটা উচ্চমার্গীয় বিপ্লবী স্বস্তি বোধ করে থাকেন। আর সমাজের এই চলমান রূপকে অনেকেই বাংলাদেশী সমাজের আধুনিকতার পরীক্ষায় উত্তরোত্তর সিজিপিএ বৃদ্ধি বলে উচ্চকিত হয়ে থাকেন। সমাজে কে কীভাবে জীবন-যাপন করবে সেটা নিতান্তই তার সামাজিক অধিকার। কেউ কারোর ন্যয়সঙ্গত জীবনচর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না এবং সেটাকে বিষিয়ে তুলবে না-এই সামাজিক বোধটুকু একটা সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য। বলা বাহুল্য সামাজিক এ অধিকারবোধগুলো এসেছে ইউরোপের ‘এনলাইটেনমেন্টে’র হাত ধরে যার কেন্দ্রে ছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের ধারণা যেটির পরবর্তী ধাপে শুরু হয় ‘মডার্নিজম’ বা ‘আধুনিকতা’র অধ্যায়। শিল্পবিপ্লব ও নগরের দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে নগরে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের সূত্রগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এই পরিবর্তনের ফলেই জন্ম নেয় ‘মডার্নিজম’ বা আধুনিকতাবাদ। মর্ডানিজম বা আধুনিকতাবাদ বলতে আমরা বুঝি, উনবিংশ ও বিংশ শতকের গোঁড়ার দিকে ইউরোপীয় সমাজের দর্শনগত চিন্তা চেতনার সাথে সাথে আর্ট বা কলা ও সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। মর্ডানিজমের কেন্দ্রে রয়েছে ‘রিজেকশন’ বা প্রশ্নহীন মেনে না নেয়ার প্রবণতা। তাই আমরা দেখি মর্ডানিস্ট চিন্তকেরা ‘এনলাইটেনমেন্টে’র নিশ্চয়তাকে বাতিল করে দেন। কিছু কিছু মর্ডানিস্ট আবার ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্বও বাতিল করে থাকেন। এভাবে পুরাতন চিত্রকলা, প্রথা, বিশ্বাস, স্থাপত্যরীতি, সাহিত্যসহ প্রতিটি এস্টাব্লিশড সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা নব্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবেশের আলোকে যাচাই-বাছাই করে খারিজ করার দাবি তোলাটা আধুনিকতাবাদের চেতনা। আর এ সবকিছুই করা হয়ে থাকবে আত্ম-সচেতনতার ভিত্তিতে যেটি আবার তৈরি হয় নতুন প্রযুক্তিগত আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। অনেক তাত্ত্বিকই মর্ডানিজমকে সামাজিকভাবে ‘প্রোগ্রেসিভ’ বা প্রগতিশীল দাবি করে থাকেন। তাদের এ দাবির পেছনে যুক্তি হলো, মর্ডানিস্ট চিন্তা সমাজকে যে ফ্যাক্টরগুলো পেছনে টেনে ধরে থাকে সেগুলোর মূলোৎপাটনে সহায়ক। কারণ এটি ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তাকে গুরুত্বারোপ করে উদ্ভাবন, অগ্রগতি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যবহারসহ জ্ঞানের যেকোনো শাখাকে চ্যালেঞ্জ করে রি-এক্সামিন করতে প্রণোদনা দেয়। একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্প ও সেবাভিত্তিক সমাজে রূপান্তর এবং ইউরোপীয় ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গোলকায়নের প্রভাবে বলতেই হবে বাংলাদেশের সমাজেও এক প্রকার আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু সে আধুনিকতাটা কতটুকু আধুনিক তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। প্রথমত, আধুনিকতার প্রধান দুইটি রূপ আমরা দেখতে পাই জীবনাচরণে এবং চিন্তা-চেতনায়। এগুলো আবার একটি অপরটির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা। আসলে বক্তব্যটা হওয়া উচিত ছিল সম্পৃক্ত, কিন্তু ঘটনাটি সবসময় একই সমীকরণে নাও ঘটতে পারে। দ্বিতীয় বিষয়টি এই না ঘটতে পারার বিষয়। যেভাবে মর্ডানিজম এবং মর্ডানাইজেশনকে ব্যখ্যা করা হয়ে থাকে সেখানে একটি সমাজের উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরাতন বোধ এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে নতুন বোধ এবং প্রতিষ্ঠানের সংঘাতের প্রেক্ষিতে সে সমাজ থেকেই সমাজের নতুন দর্শন বের হয়ে আসবে। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে উৎপাদন কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে একটি সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ায় নতুন চিন্তার উদ্ভব এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে নতুন চিন্তার আলোকে এক নতুন সামাজিক জীবনাচরণের বিকাশ। আধুনিকতার এই পুরো প্রক্রিয়াটা তাই পুরাতনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুনভাবে আবিষ্কার করার মানবীয় উৎকর্ষতার প্রক্রিয়া। আর এই উৎকর্ষতার কেন্দ্রবিন্দু তার বিবেচনাবোধ ও নিত্য এই বোধকে নতুন জ্ঞানের আলোকে ঝালিয়ে নিয়ে নতুন রাখার প্রক্রিয়া।আর তাই আধুনিক মানুষ এবং সমাজকে আমরা অগ্রগামীদের কাতারে দেখে থাকি। বলেছিলাম ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের সমাজেও এক প্রকার আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আমার কাছে বাংলাদেশে আধুনিকতার প্রধানতম উদাহরণটিই হল তার জন্মের ইতিহাস। ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দর্শনকে চ্যালেঞ্জ করা এবং নিজেদের আলাদা সত্ত্বা অনুধাবণপূর্বক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত সংগ্রামটিকে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর আধুনিক মননশীলতার রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিন্তা করতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু কষ্ট হয় যখন দেখি জন্মমাত্র আধুনিক রাষ্ট্রটির সমাজ-কাঠামোতে আধুনিকতার নামে ‘ইমিটেশনে’র চর্চা হয়। আধুনিকতাকে এখানে সীমিত করে ফেলা হয়েছে আমাদের পোশাক-আশাক, ভোগ-ব্যায় আর পাশ্চাত্যের ফেনোমেনাল কিছু লাইফস্টাইলের আবরণে। আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করতে ভুলে যাই আমরা কি করছি, কেন করছি। আমরা আমাদের চিন্তার সামনে দাঁড়াতে কুন্ঠাবোধ করি, নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করতে ভয় পাই, নিজেদের কর্মের ব্যখ্যা খোঁজার প্রয়োজন বোধ করি না। আমরা আধুনিক হওয়ার ভান করি অনাধুনিক উপায়ে! অবশ্য এর জন্য আমাদের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষা ও আয়ের স্বল্প হারও অনেকাংশে দায়ী। আধুনিকতা যেহেতু একটা সামাজিক মূল্যবোধের রূপান্তরের ধারণা তাই আধুনিকতার সাথে রয়েছে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যুগপৎ ভাঙাগড়ার সম্পর্ক। বাংলাদেশের সমাজে চর্চিত আধুনিকতা এবং আধুনিক মানুষের চিন্তাচরণ এখানে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আলোকে দেখার চেষ্টা করা হবে। বিয়ে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সমাজে এখনো সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা এখনো আমাদের আধুনিকতার বোধ দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে ছুঁড়ে ফেলিনি কিংবা ফেলতে পারিনি। এ প্রতিষ্ঠান তাই আমাদের সামাজিক বাস্তবতা এবং নরনারীর সম্পর্কের সর্বোচ্চ সম্মানের স্থান। আর সে কারণে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক যেটা লিভ টুগেদার কিংবা প্রেম যে রূপেই থাকুক না কেন বিবাহের চেয়ে সামাজিকভাবে নিম্নস্তরের। এই ‘সামাজিকভাবে’ বিষয়টি বাংলাদেশের সামগ্রিক সমাজ বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই বলা হচ্ছে যেটি এখানকার ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি ধর্মের মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত। এখন এই সমাজের কোনো নরনারী যদি পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে অন্য আপাত অপ্রাতিষ্ঠানিকতা কিংবা নিম্নস্তরের প্রাতিষ্ঠানিকতার চর্চা করে তাহলে সমাজের অন্য কেউ তাতে কী প্রতিক্রিয়া জানাবেন সেটা মূখ্য বিষয় নয়। তবে আধুনিক কেউ হয়তো সেটা নিয়ে প্রথমত নিজেকেই প্রশ্ন করে দেখবেন। যদি বোধ-বুদ্ধি পথ দেখায় এবং সমাজের বেশিরভাগ মানুষ সে পথে হাঁটতে থাকে তাহলে সেটা আরেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে পারে। কিন্তু, সে পর্যায়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সামাজিক বাস্তবতায় বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান নরনারীর সম্পর্কের অন্য রূপের চেয়ে ঊর্ধ্বেই অবস্থান করবে এবং সেটাই আধুনিকতার তাত্ত্বিক অবস্থান। অবশ্য পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতা সব ব্যাখ্যাকেই সমান গুরুত্ব দেয় যেখানে মর্ডানিজমে ব্যাখ্যার আপেক্ষিক প্রাইওরিটি আছে। তাই বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় যদি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান প্রেম, লিভ টুগেদার কিংবা পরকীয়া সম্পর্কের ব্যখ্যার চেয়ে প্রণিধানযোগ্য হয় তাহলে যেকোন বিবেচনায় বিবাহকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো ব্যাখ্যাকে গ্রহণ-তোষণ করা আধুনিকতা হতে পারে না। কোনো নরনারীর প্রেমের আবেগকে বিবাহের মাধ্যমে রূপদান এই সমাজে তাই এক আধুনিক কর্ম। কারো এই ব্যাখ্যায় দ্বিমত থাকতেই পারে তবে কারো কাছে যদি মনে হয় এই অনাধুনিক কর্ম নিয়ে আরেকটা নোংরা খেলায় লিপ্ত হওয়া যায় তবে নিঃসন্দেহে তিনি আধুনিক নন! বাংলাদেশের এযাবতকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ কেন মাঝবয়সে মেয়ের বয়সী শাওনকে বিয়ে করলেন সেটা নিয়ে ঢাকার প্রথম সারির দৈনিকগুলোও নোংরামিতে মেতে উঠেছিল। মরহুমের লাশকে ঘিরে যতগুলো হিট নিউজ তৈরি হয়েছিল সেখানেও আকারে-ইঙ্গিতে ছিল সে বিষয়টির চর্বন। লেখকের মৃত্যুর এক বছর পর প্রায় এক দশক পরে মরহুমের মেয়ে শিলা আহমেদ যখন তার প্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে জনপ্রিয় কলামিস্ট অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিয়ে করলেন তখন সেটা ঘিরেও চলছে সামাজিক মিডিয়ায় নোংরামির ধূম-৪! অথচ বাংলাদেশের অনেক নামীদামি নক্ষত্রের ‘উচ্ছৃঙ্খল জীবন’, ‘সেক্স টেপ’ কিংবা ব্যভিচারের খবর আমরা বেশ রসবোধ নিয়েই পাঠ করে থাকি! আমাদের মনে থাকে না এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ও নিম্নস্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্কের বলি অস্বাভাবিক জেনারেশনের কথা। কিন্তু আমরা খুব চিন্তিত বিবাহিত ব্যক্তির পূর্বাপর সন্তানের কল্যাণ ভাবনায়! কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে অভীষ্টের কেন্দ্রে রেখেও ইনফিরিওর প্রাতিষ্ঠানিকতাকে লালন করা আধুনিকতা নয়। আর ব্যক্তির যথার্থ বোধবুদ্ধি নিঃসৃত ব্যক্তিগত ভালো-মন্দ সিদ্ধান্তকে নিয়ে নোংরামি করা তো নয়ই! তাহলে আমরা এখানে করছিটা কি? আমার কাছে এর কোনো সরাসরি জবাব নেই। চলুন এর জবাব খুঁজি আমাদের ‘প্রগতিশীল’ রাজনীতির বিদ্যমান বাস্তবতায়! আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: কবি ও প্রাবন্ধিক alauddin0112@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন