রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৩


অবরুদ্ধ ঢাকা, পণ্ড ‘অভিযাত্রা’ নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: ০৩:০৪, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ ৮৩ মারধর ও লাঠিপেটার শিকার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও নিস্তার মেলেনি আইনজীবী সিমকী ইমামের। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গতকাল ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র সমর্থনে বিক্ষোভরত আইনজীবীদের ওপর হামলা চালান ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা । ছবি: প্রথম আলোএলোপাতাড়ি লাথিরাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ১৮-দলীয় জোটের ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ কর্মসূচি পণ্ড করে দিল সরকার। অভিযাত্রা সফল করতে না পারায় আজ সোমবার ঢাকায় একই কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে আন্দোলনরত জোট। আর ঢাকার বাইরে জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথে আজ অবস্থান কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণার পর সরকারি দল তা প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। পুলিশও জানিয়ে দেয়, বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমবেত হতে দেবে না এবং খালেদা জিয়াকেও বাসা থেকে বের হতে দেবে না। কাল পুলিশ ও সরকারি দল তাদের কথা রেখেছে। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের কর্মসূচি পালন তো দূরে থাক, রাজপথে দাঁড়াতেই দেয়নি। আবার নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে কেন্দ্রীয় নেতাদের জড়ো হওয়ার চেষ্টা করতেও দেখা যায়নি। ঢাকায় কর্মসূচির সমর্থনে সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কয়েক শ আইনজীবী পতাকা হাতে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা আদালত চত্বর থেকে বেরিয়ে নয়াপল্টনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বারবার জলকামান ব্যবহার করলেও লাঠিপেটা করেনি, ভেতরেও ঢোকেনি। তবে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা ভেতরে ঢুকে যখন বিরোধী দলপন্থী আইনজীবীদের ধাওয়া ও মারপিট করছিলেন, পুলিশ তখন তাঁদের নিবৃত্ত করেনি। বরং রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের কর্মীরা পুলিশের পাহারায় ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছেন। প্রায় একই সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকদের সমাবেশে আওয়ামী লীগের কর্মীরা হামলা চালান। বাইরে থেকে ইটপাটকেল ছুড়ে সমাবেশ পণ্ড করে দেন তাঁরা। এ ছাড়া মালিবাগে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শিবিরের কর্মী মুনসুর প্রধানিয়া নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সোয়া ১১টার দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মালিবাগের সোনালীবাগের গলির ভেতর থেকে একটি মিছিল বের করে মালিবাগ ডিআইটি সড়কে আসেন। মিছিলটি মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ ধাওয়া করে। মিছিলকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ও ইট ছুড়তে থাকেন। পুলিশ বেশ কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। রামপুরা থানা পুলিশের একটি দল মালিবাগ সুপার মার্কেটের পাশ দিয়ে চৌধুরীপাড়ার ওই গলিতে ঢুকে পড়লে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। মিছিলকারীরা ইট ছুড়লে তিন পুলিশ সদস্য একটি দোকানে ঢুকে পড়েন এবং দোকানের ঝাঁপ আটকে দেন। শিবির কর্মীরা ঝাঁপ ভেঙে দোকানে ঢুকতে গেলে পুলিশ গুলি করে। গুলিতে সেখানেই মুনসুর রাস্তায় পড়ে যান। মুনসুরের বন্ধু পরিচয় দিয়ে মনোয়ার হোসেন নামে একজন প্রথম আলোকে বলেন, মুনসুর আশকোনা ৩ নম্বর ওয়ার্ড শিবিরের সভাপতি ছিলেন। তবে বোন ফেরদৌসী আক্তার দাবি করেন, মুনসুরের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। বেলা আড়াইটার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনে বোমা বিস্ফোরণে রেলওয়ের নিরাপত্তাকর্মী আবুল কাশেম নিহত হন। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাদা দলের শিক্ষকদের ওপর সরকারি দলের কর্মীদের হামলা ছাড়া বড় ধরনের কোনো সহিংসতা বা নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। গতকালের ঘটনায় পুলিশ রাজধানীতে ৪০৯ জনকে আটক করে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী বলে পুলিশ দাবি করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের চারজন সদস্য ও বিএনপি-জামায়াতের ককটেল বিস্ফোরণে দুজন আহত হয়েছেন। বিএনপি কর্মসূচি সফল করতে না পারলেও রাজধানীবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। গতকাল রাতে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বিরোধী জোটের কর্মসূচি অব্যাহত থাকায় পুলিশের প্রস্তুতিও আগের মতোই থাকবে। এ ছাড়া, কর্মসূচি পণ্ড করে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দল সারা দেশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটাও অব্যাহত থাকবে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। রাতে রাজশাহী থেকে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাওয়া ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন ঈশ্বরদী যাওয়ার পর সেখান থেকে রাজশাহীতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কাল খুব সকাল থেকেই রাজধানীর ভেতরে ও প্রবেশমুখগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের লাঠি হাতে ব্যাপক উপস্থিতি ও তৎপরতা বিএনপির সব প্রস্তুতিকে ব্যর্থ করে দেয়। সাহস করে দু-একজন নেতা রাজপথে বের হলেও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্যরা আত্মগোপনে ছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকা অভিমুখে অভিযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি দলের নেতা-কর্মী ও সক্ষম মানুষকে নয়াপল্টনে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। তবে কাল পুলিশ বিএনপির চেয়ারপারসনকেও তাঁর গুলশানের বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। তাঁর বাড়িও অবরুদ্ধ করে রাখে। পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নজিরবিহীন তৎপরতায় বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপক প্রস্তুতি কোনো কাজেই আসেনি। লাখ লাখ নেতা-কর্মী ঢাকায় এসেছেন, বিএনপির এমন দাবির সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। নয়াপল্টনে সমবেত হননি কেউ: নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতা-কর্মীদের সমবেত হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল সকাল থেকে সেখানে চার-পাঁচজন নেতাকে আসতে দেখা গেছে। তাঁদের পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী নয়াপল্টনে যেতে চাইলে তাঁকে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে আটক করা হয়। পরে রাতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংসদ রওশন আরা ফরিদ এবং মহিলা দলের আরও তিনজন নেতাকে নয়াপল্টন এলাকা থেকে আটক করা হয়। সোনারগাঁও থানা মহিলা দলের সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসী গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পুলিশ বাধা দিলে তিনি বলেন, হয় তাঁকে ভেতরে যেতে দিতে হবে, নয়তো গ্রেপ্তার করতে হবে। না হলে তিনি সেখানেই অবস্থান করবেন। এরপর পুলিশ তাঁকে আটক করে নিয়ে যায়। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ অন্যা নেতারা নয়াপল্টনে আসার চেষ্টাই করেননি। নয়াপল্টন ও এর আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রতিটি সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। এসব এলাকায় পুলিশ কাউকে জড়ো হতে দেয়নি। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কের দুই পাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আটকে দেয় পুলিশ। ওই পথে যাতায়াতকারীদের প্রত্যেককে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে অবস্থান নেন আইনজীবীরা। তাঁরা বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ সেখানেই তাঁদের আটকে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ওসমান ফারুক, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা জয়নাল আবেদিন ও মাসুদ তালুকদার। গত শুক্র ও শনিবার কর্মসূচি সফল করতে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান ও ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ। শেষ বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের সময় কেবল হাফিজউদ্দিনকে দেখা গেছে। অবশ্য সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রেসক্লাব থেকে বের হওয়ার সময় তাঁকে আটক করে পুলিশ। বের হতে পারেননি খালেদা জিয়া: পুলিশের বাধার মুখে এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও গুলশানের বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’য় যোগ দিতে বেলা তিনটার পর গুলশানের বাসভবন থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠেন খালেদা জিয়া। সকাল থেকেই বাড়ির মূল ফটকের সামনে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। খালেদা জিয়ার গাড়ি বাড়ির মূল ফটকে আসতেই তা আটকে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রায় আধা ঘণ্টা গাড়িতে অপেক্ষা করে নেমে আসেন খালেদা জিয়া। কিন্তু পায়ে হেঁটেও তাঁকে এগোতে দেওয়া হয়নি। এ সময় তিনি পুলিশ সদস্যদের বকাঝকা করেন, সরকারের বিরুদ্ধেও নিজের ক্ষোভ ঝাড়েন। বাড়ির মূল ফটকের সামনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বিকেল চারটার দিকে বাড়ির ভেতরে আঙিনায় চলে যান তিনি। এরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় মূল ফটক। বাড়ির আঙিনায় জাতীয় পতাকা হাতে কিছুক্ষণ বসেন খালেদা জিয়া। এ সময় তাঁর বাড়ির দেয়াল টপকে কয়েকজন সাংবাদিক ভেতরে প্রবেশ করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন বিরোধীদলীয় নেতা। সোয়া চারটার দিকে আবার বাসায় ঢুকে যান বিরোধীদলীয় নেতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পথ বালুভর্তি তিনটি ট্রাক ও পূর্ব পাশের গলিতে দুটি ট্রাক আড়াআড়িভাবে রেখে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শনিবার রাত থেকেই। কর্মসূচি: গতকাল রাতে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির নেতা হাফিজউদ্দিন বলেন, নির্বাচনী তফসিল স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথে অবস্থান কর্মসূচি চলবে। তবে এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, আজ শুধু ঢাকায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচি থাকবে। এ ছাড়া শুধু আজ জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় শহরে রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথে অবস্থান কর্মসূচি চলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন