সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩


যোগাযোগ খাতের বেশির ভাগ প্রকল্প পরিকল্পনা পর্যায়েই স্টাফ রিপোর্টার | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, মঙ্গলবার, ১০:২৬ Share on facebook Share on twitter Share on email Share on print More Sharing Services 0 স্বপ্নের সেতু পদ্মা স্বপ্নেই থেকে গেল। যোগাযোগ খাতের বেশির ভাগ প্রকল্প পরিকল্পনা পর্যায়েই রয়ে গেছে। পদ্মা সেতু এ মেয়াদে শুরু করে এ মেয়াদেই প্রায় শেষ করে আনার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। কিন্তু দুর্ভাগ্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর। এখনও শুরু করাই সম্ভব হলো না সেতুর কাজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন, মেট্রোরেল এমআরটি উড়াল সড়ক, উত্তরা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত বিআরটিসহ আরও বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ করতে এবং এমনকি শুরু করতেও পারেনি সরকার। সারা দেশের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার সড়ক, মহাসড়ক যান চলাচলের ঝুঁকিপূর্ণই রয়ে গেছে। রাজধানীতে যানজট রোধে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে শোচনীয়ভাবে। যোগাযোগ খাতে এমনি ব্যর্থতার পাশাপাশি যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, এয়ারপোর্ট রোড থেকে মিরপুর এবং পূর্বাচল প্রকল্প পর্যন্ত উড়াল সড়ক, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলসহ কয়েকটি নির্মাণকাজ সরকারের সাফল্য তুলে ধরছে। এতে মানুষের দুর্ভোগও বহুলাংশে লাঘব হয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে বড় রকমের হোঁচট খেয়েছে সরকার। দুর্নীতিবাজ ও সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে গিয়ে গোটা প্রকল্পই ঝুলে যায়। অসন্তুষ্ট বিশ্বব্যাক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সরে যায়। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে। সন্দেহের তালিকার শীর্ষে থাকা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া এবং শেষ পর্যন্ত তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ার পরও বিশ্বব্যাংকের আস্থা অর্জন করতে পারেনি সরকার। বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর স্বল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতে সুবিধা ও দেশের অর্থনীতির জন্য লাভজনক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারা সরকারে জন্য রাজনৈতিক দিক দিয়েও মারাত্মক ক্ষতিকর হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং আত্মমর্যাদাবোধ থেকে সরকার শেষ পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে সেনাবাহিনী দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজও শুরু করা হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণকাজ উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিতে চায় সরকার। ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন স্বল্প সময়ে নিরাপদে যাতায়াতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা কখনও সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পণ্যবাহী লরি, ট্রাক, যাত্রীবাহী বাস রাস্তায় আটকে থাকে। যাত্রীদের দুর্ভোগ গার্মেন্ট সামগ্রী পরিবহনে ব্যাঘাত নিত্যকার ব্যাপার। এ অবস্থার অবসানে ফোর লেন প্রকল্প নেয়া হয়। বর্তমান যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ডিসেম্বরের মধ্যে ফোর লেনের ৩২ কিলোমিটারের নির্মাণকাজ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো প্রকল্পই সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু বড় ব্রিজগুলোর নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্প মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পের ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৯ শতাংশ। ১২ কিলোমিটার সাবমেইজের কাজ এখনও বাকি। কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম রেলওয়ে ব্রিজ, ইলিয়টগঞ্জ, লালপুর, লেমুয়া, মুহুরি ও ধুমঘাট ব্রিজের নির্মাণকাজ এক বছরেও শেষ করা সম্ভব হবে কিনা সংশয় রয়েছে। ১৭টি বড় ব্রিজের মধ্যে মাত্র দু’টির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ব্রিজগুলোর কাজ ২৫ থেকে ৪৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ২২৮৩ কোটি টাকার ফোর লেন প্রকল্পে চীনা ঠিকাদারদের সাতটি অংশের কাজ দেয়া হয়। তারা শুরু থেকেই অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় নেয়। তাদের ধীরে চলো নীতিতে কাজের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। ১২টি বাইপাসের জন্য প্রয়োজনীয় মাটি পাওয়া বড় সমস্যা। মসজিদ, মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, শ্মশান সরিয়ে নেয়াও সময় সাপেক্ষ। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকা হতে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগবে তিন থেকে বড় জোর সাড়ে তিন ঘণ্টা। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে গার্মেন্টসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহন দ্রুততর হবে এবং বন্দরের কর্মচাঞ্চল্য বহুগুণে বেড়ে যাবে। কিন্তু আগামী ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রাজনৈতিক নৈরাজ্যে প্রায় দু’ মাস কাজ ব্যাহত হয়েছে। চমক জাগানো প্রকল্প মেট্রোরেল। নগরবাসীর স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ে নিরাপদ চলাচল এবং এর মাধ্যমে রাজধানীর যানজট কমিয়ে আনা এর উদ্দেশ্য। এ সরকারের সময়েই প্রকল্পটি অনেকখানি এগিয়ে আনা সম্ভব ছিল। তেমন পরিকল্পনা ছিল সরকারের। কিন্তু শুরুতেই অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা দীর্ঘ সময় নিয়েছে। রুট নির্ধারণে জটিলতা নিরসনেই এক বছর লেগে যায়। ডিপোর জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি জমি প্রাপ্তিতেও অনেক সময় লেগে যায়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাতে জমি থাকা সত্ত্বেও তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে প্রায় দুই বছর সময় নিয়েছে। ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর যানজট বহুলাংশে কমে যাবে। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে জাইকা এতে ১৬ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা দেয়ার ঋণচুক্তি করেছে। এতে সুদ মাত্র দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এতে স্বল্প হারের সুদে কোন দেশকে জাইকা ঋণ দেয়নি। কনসালট্যান্টও নিয়োগ করা হয়েছে। ডিজাইন-ড্রইংয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন। এতে প্রায় দেড় বছর লেগে যাবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা বিলম্বিত হলেও সরকার প্রাথমিক পর্যায়ের কাজগুলো শেষ করেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তরা থেকে পল্লবী-মিরপুর-১ রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ-খামারবাড়ি-ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মিত হবে। পরে মেট্রোরেল হবে সায়েদাবাদ পর্যন্ত। এমআরটি স্টেশন হবে ১৬টি। ৩ মিনিট ৩০শে সেকেন্ড পর পর ট্রেন ছাড়বে। সকাল সাতটা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নগরীর যানজট, যাত্রী দুর্ভোগ বহুলাংশে কমে যাবে। উত্তরা থেকে কমলাপুর হয়ে কুতুবপুর পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেও থেকে আছে আজ দুই বছর ধরে। ৮৭৩০ কোটি টাকার এ প্রকল্প নেয়া হয় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে। ইতালি-থাই নামক কোম্পানি অর্থ সংস্থান করতে পারছে না বলে আজ থেমে আছে। শহরের সড়কের বদলে রেললাইনের উপর দিয়ে উড়াল সড়ক নির্মাণের সংশোধিত রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। এলাইন ও ডিজাইন সংশোধনেও দীর্ঘ সময় নেয়। সাশ্রয়ী ও নিরাপদ এ উড়াল সড়কও সরকারের পকিল্পনায়ও থেকে যাবে। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ চার লেন সড়ক করার পরিকল্পনা গত জুনে শেষ করার কথা। ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০০ কোটি টাকা। ৪১১ মিটার দীর্ঘ ভালুকা ব্রিজ, ১২৬ মিটার দীর্ঘ স্টার ব্রিজ, ৪৫০ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার ও রেল ওভারব্রিজ নির্মাণ সময় সাপেক্ষ বলে প্রকল্প বাস্তবায়নে কমপক্ষে আরও দুই বছর লেগে যাবে। তবে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ায় দ্রুত মানসম্পন্ন কাজ আশা করছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ইস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালের নভেম্বরে। পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩৭ শতাংশ। ১১৮টি সেতুর মধ্যে এ পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে মাত্র ২১টি। গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনাবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের কাজ ২০১৪-এর এপ্রিলে শুরু করার কথা। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ করতে আরও ৮ মাস লেগে যাবে। ২০৩৯ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারে বাস চলাচল করবে। দ্বিতীয় কাঁচপুর, মেঘনা, গোমতি সেতু নির্মাণও পরিকল্পনায়ই রয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ছোট-বড় দুই শতাধিক প্রকল্পের বেশির ভাগ অবাস্তবায়িত রয়েছে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মাঝেও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণ ও হাতিরঝিল প্রকল্প সরকারের বড় সাফল্য। দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল ঢাকায় যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার সায়েদাবাদ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত পথের অসহনীয় দীর্ঘ যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন