মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৩


সালতামামি ২০১৩: শোক আর ষড়যন্ত্রে পোশাক শিল্প ধ্বসের এক বছর 31 Dec, 2013 সহিংসতা, দুর্ঘটনা আর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে একটি অস্থির বছর শেষ করল দেশের পোশাক শিল্প। সব চেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের ১ হাজার ১শ’ ৩৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা। যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এছাড়া বছর জুড়েই ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা ও নানা নাশকতার ঘটনা। এর সাথে নূন্যতম মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়েন মালিকরা। মোটকথা, বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কেটেছে পোশাক শিল্পের ঘটনা বহুল একটি বছর। চলতি ২৬ জানুয়ারি মোহম্মদপুরে স্মাট এক্সপোর্ট গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দিয়ে শুরু হয় বছর। শেষ হয় গাজীপুরের আর একটি কারখানার অগ্নিকাণ্ড দিয়ে। ইতিহাসে ভয়াবহতম রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দুর্ঘটনা এবং সর্বশেষ স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টে ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে। বছরের শেষের দিকে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। মজুরি কাঠামো নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আন্দোলন সংগ্রাম। অন্যদিকে, সারা বছর জুড়েই চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা। হরতাল, অবরোধে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় রফতানি আমদানি। আগুনে পুড়ে নষ্ট হয় কোটি কেটি টাকার রফতানি পণ্য। বছর শেষে এ শিল্প ঘিরে তৈরি হওয়া উদ্বেগ আর অনিশ্চিয়তা আরও ঘনীভূত হয়। রানা প্লাজা ধ্বস : চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮:৪৫ মিনিটে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজার বহুতল ভবন ধ্বসে পড়ে ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। দুই হাজারেও বেশি মানুষ আহত হয়। সাধারণ মানুষ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকাজ চালায়। সাভারের এই রানা প্লাজায় পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। ২৩ শে এপ্রিল ভবনে ফাটল দেখা দিলে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তার পরেও পরের দিন শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। নিহত হয় ১১৩৪ জন শ্রমিক। এখনও ২০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি আরো বেশি মারা গেছেন এবং নিখোঁজ রয়েছে ৪শতাধিক। আর উদ্ধার অভিযানে জীবিত উদ্ধার হয় ২৪৩৮ জন। এর মধ্যে প্রায় ১৫০০ শ্রমিক আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ৮৪২ জনের লাশ তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কোন দাবিদার না থাকায় ৩২২ টি লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তবে এখনও পাওয়া যাচ্ছে লাশের হার ও মাথার খুলি। এ পর্যন্ত ৪ টি লাশের হার পাওয়া গেছে। ভবন ধ্বসের পর জীবিত উদ্ধারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে হালকা যন্ত্র দিয়ে কনক্রিট কেটে কেটে উদ্ধার কাজ চলছিল। ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছিল ভারী যন্ত্র দিয়ে উদ্ধার অভিযান। ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধার: ১৭ দিন পরে সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপ থেকে রেশমা নামের এক নারি পোশাক শ্রমিককে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনেন উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ ঘটনাকে অলৌকিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রেশমার জীবিত উদ্ধার নিয়ে ব্যাপক বির্তকের সৃষ্টি হয়। ওঠে নানা প্রশ্ন। অবশ্য এটাকে অনেকেই নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রেশমার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। রেশমাকে উদ্ধারের পর তাকে দেখতে হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ন্যূনতম মজুরি : রানা প্লাজা ধ্বসের পরেই প্রশ্ন শুরু হয় ন্যূনতম মজুরি নিয়ে। শুরু হয় মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন। মালিক শ্রমিকদের মধ্যে চলে দর কষাকষি। অনেক জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের পর অবশেষে শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত হয় পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি। ৫৩০০ টাকা চূড়ান্ত করে মজুরি বোর্ড। মজুরি বোর্ডের প্রস্তাব অনুযায়ী ৫৩০০ টাকা রেখেই গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকেই এ মজুরি কার্যকর করা হবে। বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে মূল বেতনের ৫ শতাংশ। এছাড়া বাড়িভাড়া ১২০০, চিকিৎসাভাতা ২৫০, যাতায়াত ভাড়া ২০০ ও খাদ্যভাতা ৬৫০ টাকা করা হয়েছে। অগ্নিকা- : চলতি বছরে পোশাক শিল্পের প্রায় ২৯ টি কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ২৯ নভেম্বর পোশাক শিল্পের অহঙ্কার বলে খ্যাত বড় কম্পায়েন্স কারখানা স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কারখানাটিতে আগুন দেয় শ্রমিকরা। এতে দশ তলা ভবনটি পুড়ে যায়। মালিকের দাবি অনুযায়ী ক্ষতি প্রায় প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা। মালিকের দাবি তার কারখানাটি ছিল শান্তিপূর্ণ একটি কারখানা কখনো তার কারখানায় বেতন বোনাস নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম হয়নি। তার পরও তার কারখানাটি আগুন দিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। মালিকদের অভিযোগ অতীতের নাশকতার সাথে জড়িদের বিচার ন করার কারণে বার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনার জন্য কিছু শ্রমিক সংগঠন সুশীল সমাজ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করছেন উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, পোশাক শিল্পের এক পেশা গবেষণা করে শ্রমিকদের উস্কে দেয়া হয়। এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ, এখন ভাল কারখানাগুলোকে শেষ করতে টার্গেট করেছে একটি চক্র। শ্রমিকদের মজুরি এবং স্ট্যান্ডার্ড কারখানার ঘটনা গুছাতেই শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। পোশাক শিল্প বাচাঁতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন তারা। এ শিল্পকে টিকাতে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পোশাক কারখানায় নাশকতার প্রতিবাদে মানবন্ধনও করেন ব্যবসায়ীরা। পোশাক খাতের অস্থিরতা বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে রাজপথে কঠোর আন্দোলনের নামার হুমকিও দেন তারা। এতে তারা সমস্যা উত্তরণে দুই নেত্রীকেই সমঝোতা পথ বের করা আহ্বান জানান। জিএসপি সুবিধা : রানা প্লাজা ধ্বসের পর চলতি বছরের ২৭ জুন নিরাপত্তার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না বলে তা স্থগিত করে দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের আশঙ্কা করছেন মালিকরা। ইইউ বাংলাদেশকে কিছু শর্ত দিয়েছে, এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে জিএসপি সুবিধা বাতিল হতে পারে বলে হুশিয়ারি দিয়েছে ইইউ। এতে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার রফতানি কমে যাবে বলে জানান উদ্যোক্তারা। এ শিল্পের ৬০ শতাংশ পণ্য রফতানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। বাটেক্সপো’তে সারা ছিল না : তৈরি পোশাক শিল্পের বড় পণ্য প্রদর্শনী বাটেক্সপো (বাংলাদেশ অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইল এক্সপোজিশন) এ বছর তেমন সারা মেলেনি। প্রতিবছর বড় পরিসরে মেলার আয়োজন করা হলেও এ বছর হোটেল সোনারগাঁয়ে ছোট পরিসরে আয়োজন করা হয়। আসেনি তেমন বিদেশি ক্রেতা। মেলেনি দর্শনার্থীও। রানা প্লাজা ধ্বসে বিপুলসংখ্যক গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হওয়ায় ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে তা উদ্ধারের চেষ্টা করছে বিজিএমইএ। পোশাক খাতের সার্বিক মূল্যায়নে বিজিএমএইএ’র সাবেক সভাপতি ও ইএবি’র সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী শীর্ষ নিউজকে বলেন, গত বছরটি ছিল পোশাক শিল্পের জন্য একটি ঘটনাবহুল বছর। একটি কঠিন সময় পার করেছে এ শিল্পটি। এর চ্যালেঞ্জ সামনে রয়ে গেছে। তাজরীন ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, শ্রমিক অসন্তোষ ও নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা। তাজরীন ফ্যাসন ও রানা প্লাজার ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে এ শিল্পের ইমেজ নস্ট হয়েছে। এছাড়া আমরা আন্তর্জাতিকভাবে চ্যালেঞ্জে পড়ে গেছি। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান জিএসপি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। ভারতও এ সুবিধা পেতে যাচ্ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়াতে আমরা অর্ডার হারাচ্ছি। ভারতে রুপির মূল্য কমে যাওয়ায় অর্ডারগুলো ভারত চলে যাচ্ছে। এছাড়া আমাদের পণ্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। এ বিষয়গুলো পোশাক উদ্যোক্তাদের মারাত্মক চাপে রেখেছে। সব মিলিয়ে আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে আসতে পারবো এমন আশা করেন তিনি। সব মিলিয়ে রফতানির দিক দিয়ে আমরা এখনও ভাল অবস্থানে আছি। রফতানি নিয়ে আমরা সন্তোষ্ট। উৎসঃ শীর্ষ নিউজ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন