দীর্ঘ হচ্ছে গুমের মিছিল
17 Dec, 2013
খোঁজ মিলছে না। প্রতিদিনই কারও না কারও। হঠাৎ বেড়ে গেছে নিখোঁজের ঘটনা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দীর্ঘ হচ্ছে গুমের মিছিল। এদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। রয়েছেন সাংবাদিক থেকে সাধারণ
মানুষও। কখনও একা, কখনও নেই হয়ে যাচ্ছেন একসঙ্গে কয়েকজন। রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরাই প্রধান টার্গেট। যারা বয়সের দিক থেকে তরুণ ও যুবক। গত
তিন সপ্তাহে নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে সাদা পোশাকধারী দল তুলে নেয়ার পর সন্ধান মিলছে না অনেকের। নিখোঁজের পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি। কিন্তু বরাবরই সে অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে। নিখোঁজের স্বজনদের সাফ জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাদের কাছে এ ধরনের কোন তথ্য নেই। বিগত তিন সপ্তাহে নিখোঁজদের মধ্যে মাত্র দু’জনকে শাহবাগে বাস পোড়ানোর মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে তিনজনের লাশ। এ পরিস্থিতিতে ১৮ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক। বিরোধীদলীয় একাধিক নেতা জানান, গুমের ভয়েই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণে ভয় পাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। ওদিকে নিখোঁজ নেতাকর্মীদের পরিবারের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় নেতাদের খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও তৃণমূলের নিখোঁজ নেতাকর্মীর খবর সেভাবে প্রচার হয় না। দলের পক্ষ থেকেও নেই জোরালো মনিটরিং। এমন কি খোঁজও নেয়া হচ্ছে না।
সামপ্রতিক সময়ে প্রথম নিখোঁজের ঘটনাটি ঘটে গত ২৭শে নভেম্বর। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ দলের আহত নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে এ্যাম্বুলেন্সে করে কুমিল্লা হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। পথে আলীশ্বর এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে এ্যাম্বুলেন্সটি থামায় সাদা পোশাকধারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দল। তারা হিরু ও পারভেজের সঙ্গে স্থানীয় এক্সিম ব্যাংকের ম্যানেজারকেও তুলে নিয়ে যায়। ব্যাংক ম্যানেজারকে থানায় সোপর্দ করা হলেও এরপর থেকে খোঁজ মিলছে না হিরু ও পারভেজের। নিখোঁজ দু’জনের পরিবার অভিযোগ করেছে, ওই রাতে কুমিল্লা র্যাব-১১ হিরুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করে এবং দুই ব্যবসায়ীসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে র্যাব সদস্যরাই এ দু’জনকে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে আটক করেছে। তাদের মুক্তির দাবিতে এলাকাবাসী প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান থেকে মানববন্ধন, হরতাল নানা কর্মসূচি পালন করলেও এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ মেলেনি। এর আগে ২৮শে নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজনৈতিক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মহানগর ছাত্রদলের ৫ কর্মী। তারা হলেন সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সাংগঠনিক সম্পাদক সম্রাট মোল্লা, ৭৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি খালেদ হাসান সোহেল, ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি আনিসুর রহমান খান, একই ওয়ার্ডের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিকদল সম্পাদক মিঠু। পরিবারের সদস্যরা জানান, কারাগারে দেখা করতে গিয়েছিলেন ৬ জন। ঘটনার সময় তাদের একজন নামাজ পড়তে যান। তিনি ফিরে এসে দেখেন তার ৫ সহকর্র্মী নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে জানিয়েছেন, সাদা পোশাকধারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে গেছে। ৪ঠা ডিসেম্বর রাজধানীর নাখালপাড়া থেকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমন নিখোঁজ হন। পরিবারের সদস্যরা জানান, র্যাব-১ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করে র্যাব। ৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের পাঠাগার সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলের আবাসিক ছাত্র জিয়াউর রহমান শাহীন। শাহীনের সহপাঠীরা জানান, ওইদিন বিকালে আশিকের পল্লবীর বাসায় দেখা করতে গিয়েছিল শাহীন। এরপর তিনি আর ক্যাম্পাসে ফিরেননি। অন্যদিকে আশিকের ছোট ভাই হামিদুর রহমান জানান, ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে আশিককে কল দেয়া হলে অপরিচিত এক ব্যক্তি তার ফোন রিসিভ করে। এসময় হৈ চৈ-এর শব্দ শোনা যায় এবং কোন কথা না বলেই ফোন কেটে দেয়া হয়। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আশিকের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও শাহীনের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারে। দু’জনের পরিবারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে পল্লবী ও মিরপুর থানায় জিডি করা হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজধানী থেকে অন্যদের মধ্যে নিখোঁজ হন ছাত্রদল নেতা আব্দুল কাদের ভুঁইয়া সুমন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা রাসেল মিয়া, শাহবাগে রেল কলোনি যুবদল নেতা লিটন ও তেজগাঁও শিল্প এলাকার মৎস্যজীবী দল নেতা মো. আল আমিনসহ ৮ জন। ৭ই ডিসেম্বর রাত ১২টায় সোনারগাঁও থানার নোয়ারকান্দি গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে সবুজবাগ থানা ছাত্রদল সভাপতি মাবুদ হাসান সুজনকে আটক করে সাদা পোশাকধারী ডিবি পুলিশ। এমন অভিযোগ তার পরিবারের। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেছে ডিবি পুলিশ। ২রা ডিসেম্বর ঢাকার সূত্রাপুর ও বংশাল থেকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান সেন্টু, বংশাল থানার সহ-সভাপতি সোহেল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি জহির ও সাধারণ সম্পাদক পারভেজ, ৭২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সহ-সভাপতি সাব্বির, বংশাল থানা ছাত্রদলের সদস্য চঞ্চল, ৭১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সদস্য কালু, কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাফরান হোসেন উজ্জ্বলকে আটক করে। এদের মধ্যে ৭ই ডিসেম্বর জাফরান হোসেন উজ্জ্বল ও সোহেলকে গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়। বাকিদের এখনও খোঁজ মিলেনি। ৪ঠা ডিসেম্বর গুলশান আমেরিকান দূতাবাসের সামনে থেকে সাদা পোশাকধারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদুজ্জামান রানা, মাযহারুল ইসলাম রাসেল ও আল আমিন নামের ৪ ছাত্রদল কর্মী। এখন পর্যন্ত তাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ৬ই ডিসেম্বর দক্ষিণখান থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলাম মন্টুকে। তারপর থেকে মন্টুর খোঁজ মেলছে না। এদিকে দুই সপ্তাহে আগে রাজধানী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও স্থানীয় আলোর পরশ পত্রিকার সম্পাদক আলতাফ হোসেন। তিনি দৈনিক আমার দেশ-এর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি। পরিবারের দাবি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীই তাকে গুম করেছে। তবে যথারীতি অস্বীকার করেছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। ১লা ডিসেম্বর খুলনার রূপসায় বিএনপি কর্মী ইলিয়াসসহ নিখোঁজ হন চারজন। চারদিন পর রূপসা থানার পাথরঘাটা পদ্মার বিলে ইলিয়াসের লাশ মিলে। অন্য দু’জনকে গুরুতর মুমূর্ষু অবস্থায় পাওয়া যায়। এর আগে ২৩ জুন থেকে নিখোঁজ রয়েছেন খুলনার নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বিবিএ’র দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র আল-আশিক নির্মাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা শেষে রায়েরমহল থেকে নিখোঁজ হন খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক টিএম সানাউর রহমানের একমাত্র ছেলে নির্মাণ। ৬ই ডিসেম্বর নিখোঁজ হন মুন্সীগঞ্জ কেকে গভর্মেন্ট হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র কামরুল হাসান কনক। নামাজ পড়তে গিয়ে সে আর ঘরে ফেরেনি। এ ঘটনায় জিডি করেছেন কনকের পিতা শহরের নয়াগাঁও মধ্যপাড়া গ্রামের কাজল মুন্সী। ২০শে নভেম্বর গুম হন জামায়াত নেতা সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন জামায়াতের সেক্রেটারি আমিনুল ইসলাম আমীন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফেরার পথে চৌদ্দগ্রামের সুয়াগাজী এলাকার হাইওয়ে ইন রেস্টুরেন্টে নাস্তা করার সময় গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ১০-১২ জন লোক একটি মাইক্রোতে করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের পান্থটিলা এলাকার পাশে একটি কসাইখানার পাশে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার কয়েক পর নীলফামারীর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক জালাল উদ্দীন প্রামাণিকের ক্ষতবিক্ষত লাশের সন্ধান মিলছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজনের গুম-নিখোঁজের অভিযোগ করেছে বিরোধীদল বিএনপি ও জামায়াত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় নিখোঁজের ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালের ১৭ই মার্চ। রাতে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি এম. ইলিয়াস আলী। রাজধানীর মহাখালীতে নিজ বাসভবনের কাছেই গাড়ি থামিয়ে চালকসহ তুলে নেয়া হয় প্রভাবশালী এ নেতাকে। তার কিছুদিন আগে ফার্মগেট থেকে গুম হন ডিসিসির কমিশনার চৌধুরী আলম। এ দুই নেতার সন্ধান চেয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে বিএনপি। সে আন্দোলন করতে গিয়ে অকালে ঝরে গেছে একাধিক তাজাপ্রাণ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সন্ধান চেয়েছেন তাদের পরিবার। দু’জনের সন্ধান দাবিতে আন্তর্জাতিক মহল দফায় দফায় তাগিদ দিয়েছে সরকারকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্ধান মেলেনি।
এদিকে ১০ই ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, আন্দোলন দমাতে নতুন করে বিরোধী নেতাদের গুম করা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে ঢাকা, লাকসাম, সাতক্ষীরাসহ সারা দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীকে সাদা পোশাকধারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে, যারা আর ফিরে আসেনি। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য দিচ্ছে না। অবিলম্বে তাদের খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি। একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান অভিযোগ করেন, সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার করার পর অদ্যাবধি তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা আশা করবো সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবিলম্বে তাদেরকে জনসম্মুখে হাজির করবে।
উৎসঃ manabzamin
Share on facebook Share on email Share on print 15
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন