রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩


আতঙ্ক গ্রাস করছে প্রশাসনকে 16 Dec, 2013 আতঙ্ক গ্রাস করছে গোটা প্রশাসনকে। অচল হয়ে পড়েছে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় মন্ত্রী, উপদেষ্টা, রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তারা তাদের নিরাপত্তা বাড়াতে সরকারকে চিঠি দিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানী বিভাগ, রেলওয়ে, শিল্প, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পৃথক এসব চিঠিতে দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পেট্রোলপাম্প, সিএনজি ষ্টেশন, রেলপথ, কেপিআইভুক্ত স্থাপনা, ব্রীজ-কালভার্ট এবং ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা জোরদারের তাগিদ দিয়েছে। ইতোমধ্যেই ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকদের সাবধানে চলাচল করতেও বলা হয়েছে স্ব স্ব দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে। সেইসাথে মার্কিন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণ এড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অবনতিশীল এই পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির জরুরি সভা হয়েছে। এই সভা থেকে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সভায় গত এক মাসে শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রাধান্য পায় আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ভেঙ্গে যাওয়া মনোবল চাঙ্গা করে তোলার বিষয়টি। আলোচনা হয়েছে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর গ্রামের বাড়ীতে বোমা হামলা, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক মাহাবুবুল আলম হানিফের বাসায় বোমা হামলা, এইচটি ইমামের গ্রামের বাড়ীতে বোমা হামলা, কয়েকজন বিচারপতির বাড়ীতে বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর গ্রামের বাড়ীতে হামলা, দেশের বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ অফিস ও এই দলের নেতা-কর্মীদের বাড়ী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুরের ঘটনা। বিএনপি’র এক নেতার বাড়ী ভাংচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ এমপি আসাদুজ্জামান নূরের গাড়ী বহর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটিও সভায় আলোচনা হয়। সভায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এক মন্ত্রী জানতে চান, যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে করে গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙ্গে পড়েছে কিনা? এর জবাবে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা মন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ওই মন্ত্রী। বৈঠকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ঢাকাসহ ঝুঁকিপূর্ণ ৩৫টি জেলার নিরাপত্তা জোরদার করতে হেলিকপ্টার ব্যবহ্রা শুরু করেছে। এতে করে তারা নৈরাজ্যকর যেকোন পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। অন্যদিকে, পুলিশের পক্ষ থেকে সভায় অবহিত করা হয়, দেশজুড়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে করে ভেঙ্গে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করার মত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য তাদের নেই। কমিটির সভাপতি ভূমি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে করণীয় বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সভায় আলোচনা হয়, দেশের ১০টি জেলা ও ৬১টি উপজেলায় জামায়াত শিবির নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব জায়গার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেয়া হয় এই বৈঠক থেকে। সেইসাথে নির্বাচন পূর্ব নিরাপত্তা এবং নির্বাচন পরবর্তী নিরাপত্তা নিয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনের পূর্বে এবং পরে দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থান, হাইওয়ে এবং নৌ-পথ ও রেলপথের নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জননিরাপত্তায় সম্পৃক্ত করার জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সভায় শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রবাসী কল্যাণ ও শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, রেলপথ ও ধর্মমন্ত্রী মুজিবুল হক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশের প্রধানসহ দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে, দেশজুড়ে চলমান সংঘাত-সংঘর্ষ ও বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করতে যেয়ে সম্প্রতি প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মুসা বলেছেন, শেখ হাসিনা এখন গণপ্রজাতন্ত্রী ঢাকার প্রধানমন্ত্রী। তিনি যেসময়টিতে এরকম মন্তব্য করেছেন, ওই সময়ের চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরও শোচনীয়। দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান ও রাশিদা কে চৌধুরী বলেন, সরকার নির্বাচনকে তামাসায় পরিণত করে দেশকে আরও নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ৩০০ আসনের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১৫৪টি আসনের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। এই নির্বাচনকে তামাসার নির্বাচন হিসাবে দেখছে গোটা দেশবাসী। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের কর্মকর্তারাও নির্বাচনের এই ফলাফল নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। নানা ধরণের টিপ্পনি কেটে কথা বলছে-নির্বাচনী সরকারের মন্ত্রী সভার কোন সদস্যকে দেখলেই। খোদ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাই বলছেন, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’কে বাইরে রেখে ভেলকিবাজীর নির্বাচন করতে যেয়ে-সরকার নিজেকেই গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আর বিরোধী দল এই নির্বাচন প্রতিহত করতে আরও কঠিন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার যে ঘোষণা দিয়েছে-তা মাঠ প্রশাসনকে বিচলিত করে তুলেছে। গতকাল এক চিঠির মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই চিঠিতে বলা হয়, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যাংকসমূহের নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এজন্য পুলিশের আইজিপিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে এ চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ও অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এতে চলমান অস্থিরতা ও নাশকতার কবলে ব্যাংকসমূহে বিভিন্ন ধরনের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো সহিংস ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করা হয়েছে। অপরদিকে, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে-যাতে করে দায়িত্বপালনকালে পুলিশ সদস্যরা সংঘবদ্ধভাবে চলাফেরা করেন। এই নির্দেশনা প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ বাহিনীতেও রীতিমত আতঙ্ক বিরাজ করছে। চোরাগোপ্তা হামলার আশঙ্কায় রাতে পুলিশের কোন সদস্য দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। দেশের বিভিন্ন জেলায় যেভাবে পুলিশের উপর বোমাবাজি, থানা ও ফাঁড়িতে আক্রমণ, বোমা হামলা, পুলিশকে আক্রমণ করার মত ঘটনা ঘটছে-তাতে করে পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে। তদুপরি গত তিন মাস যাবত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একের পর এক বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। এই অবস্থার অবসান না হলে তাদের পক্ষে বেশি দিন জনগণের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান বহাল রাখা সম্ভব নয়। অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ফোন করে জেলা প্রশাসকরা জানতে চাচ্ছেন চলমান আন্দোলন মোকাবেলায় তারা আর কতটা কঠোর হবেন? উপজেলা কর্মকর্তারা থানাগুলোর নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকেও একই দাবি জানানো হয়েছে। বিশেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো যাতে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মুখে না পড়ে- সে দিক বিবেচনায় রেখেই বাড়তি নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। জানা গেছে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাহিদা মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না প্রতিটি থানায়। বিশেষ করে অতি ঝুকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুগাঁও, রংপুর, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, ভোলাসহ ৩৫টি জেলা শহর এবং এসব জেলার প্রতিটি থানায়। অথচ এসব জেলার জেলা প্রশাসকগণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন যে, ইউএনও এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যে কোন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের কাছে বাড়তি নিরাপত্তা দাবি করেছেন। ইউএনওদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অতিরিক্ত ফোর্স দেয়া না হলে তাদের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় মাঠ প্রশাসনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আমলা হিসাবে চিহ্নিতরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এসব কর্মকর্তার মধ্যে। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুৃক সরকারপন্থী এক সচিব ক্ষোভের সাথে বলেন, প্রশাসনে এখন যে ধরণের স্থবিরতা বিরাজ করছে-ইতোপূর্বে আর কখনো এমনটি দেখা যায়নি। বিশেষ করে সরকারকে সহযোগিতা না করার ব্যাপারে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানের পর গোটা মাঠ প্রশাসনেই নেমে এসেছে স্থরিবতা। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে যে, বর্তমান সরকারের ওপর প্রশাসনের কর্মকর্তারা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের কারণেই। উৎসঃ inqilab

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন