এই লুৎফরই সেই লুৎফর
23 Dec, 2013
ধর্মের নামে বিকৃত মতবাদ তৈরি করেছিলেন কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক। বানিয়েছিলেন 'হিযবুল মাহদী' নামের সংগঠন। তাঁর তৈরি মতবাদে নামাজ করা হয়েছিল দুই ওয়াক্ত। রোজা রাখা অবস্থায়ও হালকা সুযোগ ছিল হালকা খাবার-দাবার গ্রহণের। আর আল্লাহকে 'আব্বা আল্লাহ হুজ্জুতুল্লা' বলে ডাকতেন তিনি। অনুসারিরাও লুৎফরকে ডাকতেন 'আব্বা' বলে। সেই লুৎফর গত শনিবার সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তদের হাতে গোপীবাগের বাসায় নিহত হলেন ছেলেসহ আরো পাঁচজনের সঙ্গে।
২০০৭ সালের ২৯ জুলাইয়ের কথা। এই প্রতিবেদক লুৎফর রহমান ফারুকের বিতর্কিত মতবাদের খবর পেয়ে তাঁর গেণ্ডারিয়ার বাসায় যান। ওই সময় অনুসারিরা পালা করে পাহারা দিতেন বাসাটি। নজর রাখতেন কারা বাসায় আসছেন, যাচ্ছেন। কারণ লুৎফরের প্রতি তখন ধর্মভিরু মানুষের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছিল। এ প্রতিবেদককে দেখে অনেক প্রশ্ন করেন বাবুল নামে ফারুকের এক অনুসারী। একপর্যায়ে এ প্রতিবেদকে একটি কক্ষে নিয়ে যান বাবুল। কার্পেট বিছানো কক্ষ। তার ওপরই বসতে দেওয়া হলো। বাবুলও বসলেন। বাবুল জানালেন, তাঁদের 'আব্বা' লুৎফর রহমান নতুন ধরনের ইবাদত শিখিয়েছেন। সে অনুসারে তাঁরা দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। রোজা রেখেও হালকা খাবার খান। এক প্রশ্নের জবাবে বাবুল বলেন, সারা দেশে 'আব্বার' সংগঠনের লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সংগঠনের নাম জানতে চাইলে বলেন, হিযবুল মাহদী। এক প্রশ্নের জবাবে বাবুল বলতে শুরু করেন, 'দেখুন জঙ্গিরা ইসলামী আইন চালুর জন্য একের পর এক বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ মারছে। এটা কি তারা ঠিক করছে। আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।' তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই কক্ষে আসেন লুৎফর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে বাবুল উঠে শির নত করে বেরিয়ে যান।
সাংবাদিক এসেছেন জানতে পেরে লুৎফর রহমান বেশ ক্ষিপ্ত হন সেদিন। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং একের পর এক পাল্টা প্রশ্ন করতে থাকেন, একপর্যায়ে হুমকিও দিতে থাকেন। অবশেষে তিনি কথা বলতে রাজি হন। ফারুক বলেন, 'আমি কোনো সাম্প্রদায়িক লোক নই। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নামে বিভীষণ মাজুজ সম্প্রদায়ের লেজুড়বৃত্তি করার লোক নই। আমি আমার পালনকর্তা আব্বা আল্লাহর কথা বলি। আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, ইমাম মাহদী আব্বা আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পাদন করতে কোনো মাখলুকের সাহায্য নেবে না। আমার কথা না মেনে কেউ পারবে না। ইমাম মাহদীকে গ্রহণ না করে কেউ ইমান নিয়ে মরতে পারবে না।' ইসলামের প্রচলিত বিধানকে 'তথাকথিত শরীয়ত' উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব মানবের জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা শরীয়তে মাহদী মোতাবেক ইবাদতে আত্মনিয়োগ করতে আহ্বান জানাচ্ছি।'
লুৎফর রহমান সেদিন এও দাবি করেন, ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এলাকায়। তিনি ১১ বছর আগে মারা গেছেন। ওই সময় ইমাম মাহদী তাঁকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে যান। আর তখন থেকেই তিনি ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং মতবাদ প্রচার করছেন। তাঁর অনুসারির সংখ্যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
লুৎফর রহমানের এ বক্তব্যসহ তাঁর মতবাদ ও সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে এই প্রতিবেদকের তৈরি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তখন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে সূত্রাপুর থানা পুলিশ লুৎফর রহমান ফারুককে আটক করে আদালতে পাঠায়। জানা যায়, লুৎফর রহমান ফারুককে রাখা হয়েছিল মণিহার সেলে। সেই সেলেও তিনি নিজেকে ইমাম মাহদীর পরিচয় দিয়ে অনুসারি বানানোর চেষ্টা করেন। তিন মাস জেলে থাকার পর বেরিয়ে এসে তিনি এ প্রতিবেদককে ফোন দেন এবং দেখা করতে বলেন। এক প্রশ্নের জবাবে ওই সময় তিনি বলেছিলেন, 'কারাগারে আমাকে সম্মানের সঙ্গেই রাখা হয়েছিল। আমি সেখানেও আমার মতবাদ প্রচার করে এসেছি।' একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, 'আমি ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি। আমাকে আটকে রাখতে পারবে এমন কোনো কারাগার তৈরি হয়নি।'
জানা যায়, গেণ্ডারিয়া এলাকার এক পীরের মুরিদ হওয়ার পর থেকেই লুৎফর রহমান নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা চালান। তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুকও শনিবার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৯৭ সাল থেকে তাঁর বাবা নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন।
উৎসঃ কালের কন্ঠ
Share on facebook Share on email Share on print
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন