মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩


সহায়তা করছে সরকারদলীয়রা সাতক্ষীরায় বিএনপি-জামায়াত দমনে নিষ্ঠুর অভিযান খুলনা ব্যুরো ২৫ ডিসেম্বর ২০১৩, বুধবার, ১০:৫৪ মন্তব্য: ২ সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার কুশলিয়ায় যৌথবাহিনী ও আ’লীগ ক্যাডারদের হামলায় বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার পর খালি ভিটায় বসে চোখের পানি ফেলছেন এই পর্দানশীন মহিলা : নয়া দিগন্ত সাতক্ষীরা জেলায় জামায়াত-শিবির দমনে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সবশেষ গতকাল সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ঝাউডাঙ্গা বাজারে এক ভ্যানচালক নিহত হন। এ নিয়ে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ জনে। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরো কয়েক শ’। আর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশের পর থেকে জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের নিহত নেতাকর্মীর সংখ্যা হয়েছে ৩৩ জন। মামলা হয়েছে অসংখ্য। গ্রেফতারের সংখ্যা ৭০ এর বেশি। জেলার অসংখ্য মানুষের বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব বাড়ির মূল্যবানসামগ্রী লুট করা হচ্ছে। আগুন দিয়ে মজুদ খাদ্যশস্য, আসবাব, কাপড়-চোপড় এবং গৃহপালিত পশু-পাখিসহ আয়-রোজগারের উপায় ধ্বংস করা হচ্ছে। সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয় ১৫ ডিসেম্বর রাতে। তখন থেকে সেখানে স্থানীয় সাংবাদিকদের চলাফেরা সীমিত রয়েছে। প্রথম দিকে কেউ কেউ ঘটনার ছবি ও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালান। কিন্তু তারা নিবৃত্ত হতে বাধ্য হন। এখন যেসব গ্রামে অভিযান চালানো হচ্ছে সেখানকার মানুষের সাথে মোবাইলে কথা বলে ও তাদের মোবাইলে ধারণ করা ছবির ওপর নির্ভর করে এবং বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সংবাদ প্রস্তুত করা হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টার দিকে জামায়াত সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা বাজারে একটি মিছিল বের করে। পুলিশ মিছিলে সরাসরি গুলি চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। এ সময় ভ্যান নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চালক হাফিজুল ইসলাম (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। হাফিজুল এক ভিক্ষুক পিতার সন্তান বলে জানা গেছে। গুলিতে আহত হন সাইকেল মিস্ত্রি হারান চন্দ্র পাল। তাকে কলারোয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। সাতক্ষীরা থানার ওসি এনামুল হক ফোনে ঝাউডাঙ্গায় শটগানের ১০ রাউন্ড গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেন। সেখানে থানার এসআই আবুর কাসেম আহত হয়েছেন বলে তিনি জানান। সাতক্ষীরার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের লোকজন যৌথবাহিনীর অভিযানকে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীশূন্য করে ফেলার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা জেলার জামায়াত অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত অভিযান চালায়। আওয়ামী লীগের এসব ক্যাডার এমনকি আগে থেকে যাদের সাথে শত্রুতা ছিল তাদের অনেকের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করছে। আর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। এসব হামলায় সুন্দরবনের দস্যুদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ রকম বহুমুখী আক্রমণে দিশেহারা সাতক্ষীরার বালক থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব পুরুষই পলাতক জীবন বেছে নিয়েছেন। পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, সাতক্ষীরা জেলায় বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে শুরু থেকে সহায়তা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা। গত রোববার বিকেলে দেবহাটা উপজেলায় কুলিয়া ঈদগাহ মসজিদ থেকে আসরের নামাজ পড়ে বের হওয়ার সাথে সাথে আলীম কাসের ছাত্র মাসুম বিল্লাহকে পুলিশ আটক করে। সেখান থেকে তাকে সাতক্ষীরা শহরের পাশের বাকাল ব্রিজের কাছে একটি পেট্রলপাম্পে নিয়ে পায়ে ও কোমরে গুলি করা হয়। গুলির পর সেখান থেকে দেবহাটা থানার ওসি তারেক বিশ্বাস মাসুমের বড়ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসান ইলিয়াস তামিমের মোবাইলে ফোন দিয়ে বলেন, তোর ভাইকে পায়ে-কোমরে গুলি করেছি। তামিম ফোনে এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। মাসুম গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানে ছটফট করার সময় এলাকার লোকজন এগিয়ে গেলে ওসি তাদের তাড়িয়ে দেন। পরে নিথর হয়ে পড়লে মাসুমকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগেও যৌথবাহিনীর সদস্যরা মুকন্দপুর এলাকার রুহুল আমীনের ছেলে শিবিরকর্মী আশরাফুল ইসলাম বাবুকে ধরে রাস্তায় এনে ঠাণ্ডা মাথায় পায়ে গুলি করে। তাকে সাতীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাবুর পিতা রুহুল আমিন জানান, তার ঘুমন্ত ছেলেকে বাড়ি থেকে ধরে এনে পুলিশ গুলি করে। যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হয় আগরদাঁড়ি অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে এ অভিযানে যৌথবাহিনীর সঙ্গী ছিল আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের একটি দল এবং বুলডোজার। জামায়াতকর্মীরা আগেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। যৌথবাহিনী ও সহায়তাকারীরা সেখানে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করলে গ্রামে উপস্থিত স্বল্পসংখ্যক মানুষ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। নিহত হয় একজন এবং ২০-২৫ জন আহত হয়। এরপর সেখানে জামায়াতের জেলা আমির অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেকের দ্বিতল পাকা বাড়িসহ জামায়াত সমর্থক ও বিএনপি নেতাদের বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এর পর থেকে এ নৃশংসতা চলে অব্যাহতভাবে। শনিবার রাত ১২টার দিকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগের মুখোশপরা সশস্ত্র ক্যাডারদের সাথে নিয়ে সাতীরা সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে অভিযান চালায়। তারা ওই গ্রামের বাসিন্দা সাতীরা (সদর পূর্ব) জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা শফিকুল ইসলামের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তার গোয়ালঘরে আগুন দেয়া হয়। আগুনে তার কয়েকটি ছাগল পুড়ে মারা যায়। প্রতিবেশী জুলফিকারের স্ত্রী নাছিমা জানান, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন তার ঘরে ঢুকে জুলফিকারকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে নাছিমাকে তারা লাঞ্ছিত করে এবং গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চলে যায়। রাত ১টার দিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য আনিছুর রহমানের বাড়িতে যায়। তাকে বাড়িতে না পেয়ে তার পাকা বাড়িটি যৌথবাহিনী ও আওয়ামী লীগের মুখোশধারী ক্যাডাররা গুঁড়িয়ে দেয়। পরে তারা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মহিলাদের ল্য করে পর পর তিন রাউন্ড গুলি করে আর স্লোগান দিতে দিতে চলে যায় বলে পরিবারের প থেকে দাবি করা হয়েছে। একই সময় বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য আনিছুর রহমানের ভাই সীমান্ত কলেজের অধ্য আজিজুর রহমানের বাড়িটি ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। সবশেষে গত রোববার ভোরে যৌথবাহিনী কালিগঞ্জ উপজেলার কুশলিয়া ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে অভিযান চালায়। সেখানে পুরুষদের না পেয়ে যৌথবাহিনীর সদস্যরা গালিগালাজ করে এবং বেশ কিছু বাড়িঘরের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। পুলিশের প থেকে দাবি করা হচ্ছে উত্তেজিত জনতা এসব ভাঙচুর করেছে। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল আলম চৌধুরীর সাথে ফোনে কথা বলা হয়। তিনি বলেন, আমাদের অভিযান কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে। তারা যত দিন অপরাধ অব্যাহত রাখবে আমাদের অভিযান চলবে। সাম্প্রতিককালের এসব ঘটনায় করা মামলা ও গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা জানতে চাইলে তার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য নেই বলে তিনি জানান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন