রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৩
কান্ডারী অথর্ব
কুমারী মাঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ
30 November 2013, Saturday
ইংরেজি মেইডেন শব্দটির অর্থ কুমারী। ম্যাগডেন অর্থাৎ অবিবাহিত নারী থেকে মেইডেন শব্দটির উৎপত্তি। ঋতুবতী অথচ বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত কোনো নারী পুরুষের সঙ্গে যৌন সংযোগ না করে থাকলে সে কুমারী। বাংলায় এর সমার্থক শব্দগুলো হচ্ছে অনূঢ়া, অধবা, অপাত্রস্থা, কৌমারী। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বঙ্গীয় শব্দকোষে কুমারীর সংজ্ঞায় বলেছেন, “দ্বাদশ বর্ষীয়া বালিকা, সম্ভান্তে দ্বাদশ বর্ষে কুমারীত্ব বিধিয়তে অথবা অজ্ঞাতপুষ্প ষোড়শ বর্ষ পর্যন্ত বয়স্কা বালিকা”। সৎ+ঈপ = ‘সতী’ শব্দটির উৎপত্তি । ‘সৎ’ (অসবিদ্যমান থাকা + শতৃ কর্তৃ) অর্থ যা বিদ্যমান, যা উত্তম, সাধু এবং সভ্য। নারীদেহে হাইমেন বা সতীচ্ছেদ নামক একটি পর্দা নির্ণীত হয় যা নারীর সতীত্ব প্রমান করে অর্থাৎ একজন নারীকে কুমারী বা ইংরেজিতে ভার্জিন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّيْ خَالِقٌ بَشَرًا مِّن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ، فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيْهِ مِن رُّوحِيْ فَقَعُوْا لَهُ سَاجِدِيْنَ-
অর্থঃ স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব পূর্ণভাবে তৈরী করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে (হিজর ১৫/২৮-২৯)।
অন্যত্র তিনি বলেন,هُوَ الَّذِيْ يُصَوِّرُكُمْ فِي الأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَآءُ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ- (آل عمران
অর্থঃ তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে আকার-আকৃতি দান করেছেন যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি মহা পরাক্রান্ত ও মহা বিজ্ঞানী (আল ইমরান ৩/৬)।
তিনি আরও বলেন, يَخْلُقُكُمْ فِيْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِّن بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلاَثٍ- (زمر
অর্থঃ তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে সৃষ্টি করেন একের পর এক স্তরে তিনটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণের মধ্যে (যুমার ৩৯/৬)। তিনটি আবরণ হলোঃ পেট, রেহেম বা জরায়ু এবং জরায়ুর ফুল বা গর্ভাধার।
উপরোক্ত আয়াতগুলোতে আদম সৃষ্টির তিনটি পর্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে মাটি দ্বারা অবয়ব নির্মাণ, অতঃপর তার আকার-আকৃতি গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহে শক্তির আনুপতিক হার নির্ধারণ ও পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং সবশেষে তাতে রূহ সঞ্চার করে আদমকে অস্তিত্ব দান।
অতঃপর আদমের অবয়ব পাঁজর থেকে কিছু অংশ নিয়ে তার জোড়া বা স্ত্রী সৃষ্টি করা হয়। সৃষ্টির সূচনা পর্বের এই কাজগুলো আল্লাহ সরাসরি নিজ হাতে করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)।
অতঃপর এই পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে প্রথম যে যমজ সন্তান জন্ম দেয়, তারাই হলো মানুষের মাধ্যমে সৃষ্ট পৃথিবীর প্রথম মানব যুগল। তারপর থেকে এই পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর মিলনে মানুষের বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
মৃত্তিকাজাত সকল প্রাণীর জীবনের প্রথম ও মূল একক হচ্ছে ‘প্রোটোপ্লাজম’। যাকে বলা হয় ‘আদি প্রাণসত্তা’। এ থেকেই সকল প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী একে বম্ব শেল বলে অভিহিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাটির সকল প্রকারের রাসায়নিক উপাদান। মানুষের জীবন বীজে প্রচুর পরিমাণে চারটি উপাদান পাওয়া যায়। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন। আর আটটি পাওয়া যায় সাধারণভাবে সমপরিমাণে। সেগুলো হলোঃ ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, সালফার ও আয়রণ। আরও আটটি পদার্থ পাওয়া যায় স্বল্প পরিমাণে। তাহলোঃ সিলিকন, মোলিবডেনাম, ফ্লুরাইন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার ও যিংক। প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে সরাসরি আদমকে অতঃপর আদম থেকে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ আদম সন্তানদের মাধ্যমে বনু আদমের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। এখানেও রয়েছে সাতটি স্তর। যেমনঃ মৃত্তিকার সারাংশ তথা প্রোটোপ্লাজম, বীর্য বা শুক্রকীট, জমাট রক্ত, মাংসপিন্ড, অস্থিমজ্জা, অস্থি পরিবেষ্টনকারী মাংস এবং সবশেষে রূহ সঞ্চারণ (মুমিনূন ২৩/১২-১৪; মুমিন ৪০/৬৭; ফুরক্বান ২৫/৪৪; তারেক্ব ৮৬/৫-৭)।
স্বামীর শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে রক্ষিত ডিম্বকোষে প্রবেশ করার পর উভয়ের সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে (দাহর ৭৬/২)। উল্লেখ্য যে, পুরুষের একবার নির্গত বীর্যে লক্ষ-কোটি শুক্রাণু থাকে। আল্লাহর হুকুমে তন্মধ্যকার একটি মাত্র শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবেশ করে। এই শুক্রকীট পুরুষ ক্রোমোজম Y অথবা স্ত্রী ক্রোমোজম X হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেটি স্ত্রীর ডিম্বের X ক্রোমোজমের সাথে মিলিত হয়, সেভাবেই পুত্র বা কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে আল্লাহর হুকুমে। মাতৃগর্ভের তিন তিনটি গাঢ় অন্ধকার পর্দার অন্তরালে এইভাবে দীর্ঘ নয় মাস ধরে বেড়ে ওঠে একটি পূর্ণ জীবন সত্তার সৃষ্টি (আবাসা ৮০/১৮-২০)।
এভাবেই জগত সংসারে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা এগিয়ে চলেছে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই কেবল আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। একারণেই আল্লাহ অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে গেল প্রকাশ্যে বিতন্ডাকারী’। ‘সে আমার সম্পর্কে নানারূপ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়, আর বলে যে, কে জীবিত করবে এসব হাড়গোড় সমূহকে, যখন সেগুলো পচে গলে যাবে? (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৮)।
অতএব প্রমানিত হলো যে, স্বয়ং আল্লাহর সৃষ্ট নিয়ম অনুযায়ী একজন কুমারী নারীর পক্ষে কখনও সন্তান জন্ম দিয়ে মা হওয়া সম্ভব নয়। এবং বিজ্ঞানও তাই প্রমান করে বলেই কুমারী মা সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি ভিত্তিহীন অমূলক ধারনা। কুমারী মা বলে আসলে পৃথিবীতে কিছুই নেই। আর তাই যদি হয়, তাহলে বিভিন্ন পুরাণ আর বিভিন্ন ধর্ম অনুসারে আমরা কুমারী মা সম্পর্কে যে ধারনাগুলো পেয়ে থাকি সবই মিথ্যা মানুষের রচিত কল্প কাহিনী ব্যতীত আর কিছুই নয়। তবে দেখে নেয়া যাক বিভিন্ন পুরাণ আর বিভিন্ন ধর্মে কুমারী মা নিয়ে প্রচলিত কাহিনিগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
গ্রীক পুরাণ অনুযায়ীঃ
সৃস্টির শুরুতে পৃথিবী ছিলো না, সমুদ্র ছিলো না, আকাশ ছিলো না , ছিলো শুধু অসীম অনন্ত শুন্যতা, বিশৃংখল নিরাকার অন্ধকার। সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই ছিলো কিন্তু তার কোন গুনাবলি ছিলো না, পৃথিবীর আকার ছিলো না ,পানির তরলতা ছিলো না আকাশে আলো ছিলো না। একটা মাত্র পাখি ছিলো নাম তার নিক্স। কালো ডানার পাখি নিক্স সোনালী ডিম পেড়ে যুগের পর যুগ তাতে ‘তা’ দেওয়ার পর একদিন প্রানের লক্ষন দেখা গেলো এবং আরো কিছুদিনপর ডিম ফেটে জন্ম নিলেন ভালোবাসার দেবতা এরোস। ডিমের খোসার এক অংশ বাতাসের উপরে উঠে গিয়ে হলো আকাশ আর অপর অংশ হলো পৃথিবী। এরোস আকাশের নাম রাখলেন ইউরেনাস আর পৃথিবীর নাম রাখলেন গাইয়া, তারপর এরোস, গাইয়া এবং ইউরেনাসের মনে ভালোবাসা সঞ্চার করলেন।
গাইয়া এবং ইউরেনাসের অনেক সন্তান সন্ততি হলো, নাতিপুতি হলো। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ক্রোনাস। ক্রোনাস তার সন্তানদের কেউ হয়ত তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হয়ে যাবে এই ভয়ে জন্ম মাত্রই তাদের গিলে খেয়ে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু ক্রোনাস স্ত্রী রিয়া তাদের সবচে ছোট সন্তানকে লুকিয়ে রাখলেন। যখন ক্রোনাস সন্তান চাইলেন তিনি কম্বলে জড়ানো এক টুকরো পাথর দিলেন আর ক্রোনাস তাই গলাধঃকরন করলেন। এই সন্তান হলেন জিউস। জিউস যখন বড় হলেন তখন বাবার হাত থেকে তার ভাই বোনদের কৌশলে রক্ষা করতে থাকলেন। তারপর জিউসে্র নেতৃত্বে পিতার বিরুদ্ধে তারা অনেক বছর যুদ্ধ করে জয়ী হলেন। তারা আকাশকে গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে সাঁজালেন আর পৃথিবীতে সাঁজালেন প্রানী দিয়ে। এরপর জিউস তার দুই পুত্র প্রমিথিউস এবং এপিমেথিউস এই দুজনকে পৃথিবীতে পাঠালেন মানুষ এবং অন্যান্য প্রানী তৈরী করে প্রত্যেককে একটা করে উপহার দিতে।
প্রমিথিউস দেবতাদের অনুকরনে সৃস্টি করলেন মানুষ এবং এপিমিথিউস সৃস্টি করলেন অন্যান্য প্রানী। এপিমিথিউস অনেক আগেই প্রানী সৃস্টি করে প্রত্যককে উপহার দিলেন। মানুষ সৃস্টি শেষ হলে প্রমিথিউস যখন তাদের উপহার দেওয়ার জন্য এলেন এপিমিথিউস তাকে লজ্জিতমূখে জানালেন আর কোন উপহার অবশিষ্ট নেই, সবই দিয়ে ফেলেছেন প্রানীদের। তখন বিষন্ন প্রমিথিউস ঠিক করলেন মানুষকে তিনি আগুন উপহার দেবেন।
পরদিন সকালে সূর্য্য আকাশে ওঠার পর তিনি সেখান থেকে আগুন চুরি করে এনে মানুষদের কে আগুনের ব্যবহার শেখালেন। আগুনের উপর দেবতা ছাড়া অন্য কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। জিউস প্রমিথুসের এই কাজ জানতে পেরে তাকে শাস্তি স্বরুপ এক পাহাড়ের সাথে বেধে রাখলেন। অনন্ত কাল ধরে প্রতিদিন ঈগল এসে তার লিভারের কিছু অংশ খেয়ে যায়।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ীঃ
গীতার কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছেন কৃষ্ণ। হিন্দুশাস্ত্রীয় বিবরণ বা লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৩২২৮ সালে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষ্ণের পূজা করে থাকে। একাধিক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তাকে বিষ্ণুর অবতার রূপে গণ্য করা হয়; অন্যদিকে কৃষ্ণধর্মের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিতে তাকে ঈশ্বর এর মর্যাদা দেওয়া হয়। কৃষ্ণকে যেহেতু ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করা হয় সেহেতু তাদের কাছে গীতা হচ্ছে ঈশ্বরের বাণী। অন্যদিকে আবার তারা যেহেতু ঈশ্বরকে স্বচক্ষে দেখে বিশ্বাস করে সেহেতু তারা খ্রীষ্টান, মুসলিম, ও ইহুদীদেরকে ‘অন্ধ বিশ্বাসী’ বলে সমালোচনা করে থাকে। যদিও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যেমন রাম ও কৃষ্ণকে মানুষরূপী ঈশ্বর হিসেবে বিশ্বাস করে, খ্রীষ্টানরাও তেমনি যীশুকে মানুষরূপী গড বা গডের পুত্র হিসেবে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও মুসলিম ও ইহুদীদের সাথে খ্রীষ্টানদেরকেও ‘অন্ধ বিশ্বাসী’ বলা হয়! কৃষ্ণ যাদব-রাজধানী মথুরার রাজপরিবারের সন্তান। তিনি বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র। তাঁর পিতামাতা উভয়ের যাদববংশীয়। দেবকীর দাদা কংস তাঁদের পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একটি দৈববাণীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তাঁর মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাঁদের প্রথম ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। দেবকী তাঁর সপ্তম গর্ভ রোহিণীকে প্রদান করলে, বলরামের জন্ম হয়। এরপরই কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বসুদেব তাঁকে গোকুলে তাঁর পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। কৃষ্ণ ছাড়া বসুদেবের আরও দুই সন্তানের প্রাণরক্ষা হয়েছিল। প্রথমজন বলরাম যিনি বসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং সুভদ্রা বসুদেব ও রোহিণীর কন্যা, যিনি বলরাম ও কৃষ্ণের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, কোনো প্রকার যৌনসংগম ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র "মানসিক যোগের" ফলে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সেযুগে এই ধরনের যোগ সম্ভব ছিল।
কুন্তির আসল নাম পৃথা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের পিসি। একবার মহর্ষি দুর্বাসা অতিথিরূপে গৃহে এলে কুন্তি তাঁকে আতিথেয়তা ও পরিচর্যায় সন্তুষ্ট করেন। দুর্বাসা তাঁকে এক অমোঘ মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে বলেন যে, এই মন্ত্রের প্রভাবে কুন্তি যে-দেবতাকে স্মরণ করবেন সেই দেবতাই তাঁর নিকটে আসবেন এবং তাঁর সাহায্যে কুন্তির পুত্রলাভ হবে। বর পেয়ে যে কোনো দেবতার সঙ্গে পুত্রসন্তান জন্মাতে পারবেন জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বুঝেই কিশোরী কুন্তি কৌতূহলবশত মন্ত্রের গুণাগুণ পরীক্ষা করার জন্যে সূর্যদেবকে ডেকে বসেন। আসলে কুমারী কুন্তিদেবী গুরুদেবের দেওয়া মন্ত্রের গুরুত্ব না বুঝে ভুলক্রমে বিবাহের পূর্বে সন্তান প্রার্থনার মন্ত্রটা পাঠ করে ফেলেছিলেন। ফলে অবিবাহিত অবস্থায় তাঁর গর্ভে জন্ম নেন কর্ণ। সূর্য যথারীতি চলে যান নিজ গৃহে কুন্তির গর্ভে সন্তানের ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করে। তবে কুন্তি যে জেনেশুনেবুঝে সূর্যকে ডাকেননি এটা বুঝতে পেরে সূর্য কুন্তিকে পুনরায় কুমারীত্বে ফিরে যাওয়ার আশ্বাস দেন পুত্রজন্মের পর, এবং সেটা ঘটে। কৌমার্য হারালে কুন্তির আর বিয়ে হতো না। যথাসময়ে পুত্র কর্ণের জন্ম হয়। মা-বাবা বা সমাজ কেউ কুন্তিকে এই অবস্থায় গ্রহণ করতে পারবে না বলে পুত্র কর্ণকে তিনি জলে ভাসিয়ে দেন। এক সন্তানহীন রথচালক ও তার স্ত্রী আদি রাধা কর্ণকে প্রতিপালন করেন। অতঃপর স্বয়ংবর-সভার মাধ্যমে কুন্তির সঙ্গে বিয়ে হলো পান্ডুর। পান্ডু সন্তান উৎপাদনক্ষম ছিলেন না। হরিণের বেশে রতিক্রিয়ায় রত দুই ঋষিকে শিকার করায় তাঁর প্রতি দেবতার অভিশাপও ছিল, কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করলেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। পান্ডু কুন্তিকে অনুরোধ করেন, দুর্বাসার দেওয়া মন্ত্রের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করতে। কুন্তি তখন একে একে তিন ধর্মদেবতাকে স্মরণ করে তিন পুত্র লাভ করেন। যমরাজের সঙ্গে জন্ম নেন যুধিষ্ঠির, বায়ুর সঙ্গে ভীম আর ইন্দ্রের সঙ্গে অর্জুন। পৌরুষত্বহীন, নির্জীব পান্ডুকে বিয়ে করে শরীরের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে পারেননি কুন্তি। কিন্তু মন্ত্র ও বরের শক্তিতে তিন দেবতাকে দিয়ে তিন পুত্রের জননী হয়েছেন। এছাড়া, পান্ডু অন্য স্ত্রী মন্দ্রাকে সেই গোপন মন্ত্র শিখিয়ে তাঁর দ্বারাও পান্ডুকে দুই পুত্র, সহদেব আর নকুল, দান করতে সমর্থ হন কুন্তি।
মিশরীয় পুরাণ অনুযায়ীঃ
আইসিস, পৃথিবীর অধিকর্তা গেব স্বর্গের অধিকর্তী নাট দেবীর চার সন্তানের একজন। আইসিস এবং তাঁর স্বামী অসিরিস ছিলেন জমজ ভাই বোন। তাদের অন্য দুই ভাইবোন নেফথিস এবং তার স্বামী সেথও ছিলেন জমজ। এক রাতে অসিরিস নেফথিসকে তার স্ত্রী আইসিস মনে করে তার সাথে রাত্রি যাপন করে। যার ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় আনুবিস । নেফথিসের স্বামী সেথ ব্যাপারটা স্বভাবতই সহজ ভাবে মেনে নিল না। গোপনে সে ফন্দি আঁটতে শুরু করল কি করে অসিরিসকে হত্যা করা যায়। তার গোপন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সেথ গোপনে অসিরিসের দেহের মাপ নেয় এবং সেই মাপে একটি সুন্দর কারুকার্য খচিত কফিন তৈরী করে যাতে সেই কফিনে নিখুঁত ভাবে অসিরিসের দেহ এঁটে যায়। একদিন দেবতাদের ভরা মজলিশে সেথ তার কারুকার্য মন্ডিত কফিনটি প্রদর্শন করে এবং ঘোষণা দেয় যে এই কফিন যার দেহের সাথে নিখুঁত ভাবে মানিয়ে যাবে কফিনটি তাকে উপহার দেয়া হবে। মজলিশের সবাই একে একে তাদের মাপ দেয়ার জন্য যায় কিন্তু কারো সাথেই কফিনটি মিলে না। অবশেষে অসিরিস কফিনের ভেতর যায় এবং তা আবশ্যিক ভাবেই তার সাথে একদম মিলে যায়। এদিকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অসিরিস কফিনে ঢোকা মাত্রই সেথ কফিনের ঢাকনা বন্ধ করে দেয় এবং কফিনে বন্দী করে নীল নদে ডুবিয়ে তাকে হত্যা করে। আনুবিসের জন্মের কারণে অসিরিসের মৃত্যুর উপাখ্যানের মাধ্যমেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় শেয়াল দেবতা আনুবিস মৃত্যুর দেবতার আসনে আসীন হয়। আর অসিরিসের মৃত্যু হয়ে উঠে নীল নদের বন্যা এবং উর্বরতার প্রতীক। আর এই বন্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় মৃত্যুর দেব শেয়াল দেবতা আনুবিস। এদিকে অসিরিসের মৃতদেহ নীল নদে ভেসে ভেসে সিরিয়ার উপকূলে চলে যায়। এবং সমুদ্র সৈকতে তার শবদেহ সহ কফিনটি একটি গাছে পরিণত হয়। যার থেকে বেরুতে থাকে দারুণ সুগন্ধ। এদিকে সিরিয়ার রাজার সেসময় একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিয়েছে। রাজা গাছের সুখ্যাতি এবং সুবাসের কথা শুনে তার সন্তানকে উপহারের জন্য গাছটি কেটে এনে প্রাসাদের থাম বানিয়ে রাখে। এদিকে আইসিস তার স্বামীকে খুজতে বের হয়। নীল নদের ধারে ধারে স্বামীর মৃতদেহ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে হাজির হয় সিরিয়াতে। সিরিয়াতে উপস্থিত হয়েই আইসিস লোকমুখে সেই আশ্চর্য কারুকার্য খচিত গাছ এবং তার সুবাসের কথা শুনতে পায়। এবং শোনা মাত্রই তার স্থির বিশ্বাস জন্মে এটাই তার স্বামীর মৃতদেহের পরিবর্তিত রুপ। অবশেষে স্বামীর খোঁজে আইসিস রাজার সন্তানের পরিচারিকা হিসেবে কাজ নেয়। রাজা তার সন্তানের প্রতি আইসিসের মমত্ব দেখে আপ্লুত হয় এবং আইসিসকে তার ইচ্ছা মতো রাজার থেকে পুরষ্কার নিতে বলে। তখন আইসিস সেই সুগন্ধী গাছের থামটা চেয়ে নেয়। তারপর সেই থাম নিয়ে রাজকীয় নৌকায় চড়ে আইসিস মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথিমধ্যে আইসিস সেই গাছের থামের সাথে মিলিত হয় এবং তাদের এই মিলনের ফলে জন্ম নেয় দেবতা হোরাস ।
তুলনামূলক মিথ তত্ত্বে হোরাসকে প্রাচীন মিশরের যীশুও বলা হয়। যে প্রাচীন মিশরের কুমারী মাতা আইসিসের পুত্র।
অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ফেল্কন পাখির দেহ নিয়ে হোরাস ছিলো মিশরীয় দেবতা। আনুমানিক ৩০০০ বিসি এর সময়ের হোরাসকে মিশরীয়রা সান অব গড (সূর্য দেবতা) হিসেবে জানত। আমাদের আধুনিক সময় গণনার সূর্যভিত্তিক যে সিস্টেম তা কিন্তু এসেছে এই হোরাস থেকেই। আরও সহজভাবে বললে horus শব্দ টিকে একটু উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লিখলেই কিন্তু hours শব্দটি চলে আসে যাকে আমরা এখন দিনের ২৪ ভাগের এক ভাগ বলি। তাছাড়া সূর্যোদয়ের (হোরাসের উদয়) যেদৃশ্য যদি আমরা দেখি তা কিন্তু আমরা দিগন্ত কে হরাইজনটালি রেখে। এই horizon শব্দটা এসেছে horus has risen থেকে। এবার আসি যীশুর কথায়। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারক যীশু ছিলেন savior of humanity. মরার আগ পর্যন্ত যীশু এক ঈশ্বর এর বানী প্রচার করে গেছেন। কিন্তু তার আমাদের সামনে তার যে জীবনী আছে তা যদি আমরা ভালভাবে দেখি তাহলে আমরা তাকে বলতে পারি replica of horus। এই যীশু আর হোরাস মিলের ব্যাপারটা সবার আগে খেয়াল করেন MASSEY (1828-1927) নামের একজন ইংরেজ কবি, মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে যার ছিলো প্রবল আগ্রহ। মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে যখন তিনি গবেষণা শুরু করলেন তখনি একদিন যীশু আর হোরাসের মিলের ব্যাপারটি তিনি খেয়াল করেন।
হোরাস এবং যীশুর মধ্যে মিলগুলোঃ
১। যতটুকও জানা যায় যীশু জন্মের প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে হোরাসের পৃথিবীতে আগমন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তারা দু জনই জন্ম গ্রহণ করেন ২৫ ই ডিসেম্বর।
২। তাদের দু জনের জন্মই কুমারী মাতার গর্ভে। যীশুর মা ছিলেন মেরী অন্যদিকে হোরাসের মা ছিলেন আইসিস যিনি আইসিস মেরি নামেও পরিচিত ছিলেন।
৩। খৃষ্টান ধর্মের ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে যীশুর জন্মের সময় স্টার সিরিয়াস এবং থ্রি কিংস নামে তিনটি তারা একই লাইন বরাবর ছিলো। আশ্চর্যের ব্যাপার হল হোরাসের কাহিনীতেও এই চারটা তারা একইভাবে ছিলো। তাছাড়া দুজনের জন্মই গুহার মধ্যে।
৪। দুজনেরই ১২ জন করে শিষ্য ছিলো।
৫। যীশুর সিম্বল ছিল fish,beetle,the vine &shepard’s cross. এই চারটি সিম্বলের প্রত্যেকটিই হোরাসের সিম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৬। তারা দুজনেই একই রকম মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনা দেখাতে পারতেন। যেমন দুজনেই পানির উপরে হাঁটতে পারতেন।
৭। তারা জনেই ক্রুচিফাইড হন।
৮। তারা দুজনেই নিজ নিজ অনুসারিদের নিকট king of kings, son of god, light of the world, savior of humanity ইত্যাদি নামে পরিচিত।
আরও অনেক মিল আছে তাদের মধ্যে। এসব মিল শুধুমাত্র co-incidence নয়। খুব সুকৌশলে যীশুর ইতিহাস গুলিয়ে ফেলা হয়েছে হোরাসের সাথে। পৃথিবীর মানুষজনকে সত্য ইতিহাস থেকে দূরে রাখা হয়েছে। কালক্রমে খুব ধীরে ধীরে তার ইতিহাস পরিবর্তন করা হয়েছে, সাথে সাথে বদলে দেওয়া হয়েছে যীশুর অনেক ইতিহাস, এভাবেই দুজনকে একবিন্দুতে নিয়ে আসা হয়েছে, বানান হয়েছে একই রকম সত্ত্বা। আসলে এটা হাজার বছর ধরে চলা একটি পুরনো ষড়যন্ত্র। এটা ধর্মের সাথে ধর্মের সংঘাত, সত্যর সাথে মিথ্যার, আলোর সাথে আঁধারের সংঘাত। যারা এই কাজটি করছে তারা সবসময় চেয়েছে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো এবং এগুলোর প্রচারকদের প্রকৃত ইতিহাস কখনই মানুষ না জানুক। তাদের ষড়যন্ত্র এর শিকার মুসা (আঃ), ইসা (আঃ), মুহাম্মদ (সাঃ) সহ অনেক নবী রাসুলগণ। তবে যীশুর ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি সফল।
খ্রিষ্টান ধর্ম অনুযায়ীঃ
খৃস্ট ধর্মমতে যীশু স্বয়ং ঈশ্বর পুত্র। খৃস্ট ধর্মানুসারীদের মতে ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্নিত মসীহ হলেন যীশু। খৃস্ট ধর্মমতে মসীহ বলতে বোঝায় “ঈশ্বর কর্তৃক অভিষিক্ত”, ইহুদী ধর্মমতে “যিনি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন”, ইসলাম ধর্মমতেও ইহুদী ধর্মের অনুরূপ, তবে ইহুদী ধর্মানুসারীদের মতে যীশুর মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী নবীদের গুণাবলী ছিলো না, আর ইসলাম ধর্মমতে গুণাবলী ছিলো তবে ঈশ্বরের পুত্র না। ইহুদী ধর্মে যীশু’র স্বীকৃতি না থাকলেও ইসলাম ধর্মে যীশুকে ঈসা নবী বলে মান্য করা হয়।
মেরী’র সাথে যোসেফের বিয়ে ঠিকঠাক। এমন সময় গ্যাব্রিয়েল হাজির। কুমারী মেরীকে গ্যাব্রিয়েল এসে বলে তোমাকে ঈশ্বর আশীর্বাদ করেছেন। মেরী তো আতংকে অস্থির, আবার কি হলো! গ্যাব্রিয়েল বললো ভয় করোনা মেরী, ঈশ্বর তোমার সাথেই আছেন, তিনি তোমাকে দয়া করেছেন। তোমার একটা পুত্র সন্তান হবে। সেই পুত্র হবে স্বয়ং ঈশ্বরের পুত্র। নাম হবে যীশু, যীশু ডেভিডের সিংহাসনে বসবে। য্যাকবের বংশের উপর চিরকাল রাজত্ব করবে। এই কথা শুনে হাহাকার করে উঠলেন মেরী, বললেন, আমার তো এখনও বিয়েই হয়নি, বাচ্চা হবে কিভাবে! উত্তরে গ্যাব্রিয়েল বললেন, তোমার উপর পবিত্র আত্মা ভর করবে, ঈশ্বরের শক্তির ছায়া তোমার উপর পরবে। এতে যে পুত্র জন্মগ্রহন করবে সে হবে ইশ্বরপুত্র। মেরী’র অবিশ্বাস অবস্থা দেখে গ্যাব্রিয়েল আবারো শুরু করলেন, ঈশ্বরের কাছে অসম্ভব কিছু নেই। মেরী এই কথা যোসেফকে জানালেন, যোসেফ মেরীর কথা বিশ্বাস করে মেরীকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে ছেড়ে দিবেন ভাবলেন। স্বপ্নে ঈশ্বরের একজন দূত স্বরুপে যোসেফকে দেখা দিলেন, বললেন, ভয় করোনা ডেভিডের বংশধর যোসেফ! মেরীর গর্ভে ঈশ্বরের পুণ্যাত্মা আসছে, ওর নাম রেখো ইমানুয়েল। ইমানুয়েল মানে হলো ঈশ্বর আমাদের সংগে আছেন। কথামত কাজ করলেন যোসেফ। মেরীকে বিয়ে করলেন কিন্তু মিলিত হলেন না। ছেলের জন্ম হওয়ার পর নাম রাখলেন যীশু। ইহুদিয়া রাজ্যের সম্রাট ছিলেন অগাস্ট। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার রাজ্যের গণনা’র জন্য সবার নাম লিখা হবে। নাম লিখাবার জন্য সবাই নিজ নিজ গ্রামে যেতে লাগলেন। রাজা ডেভিডের জন্মস্থান ছিলো ইহুদিয়া রাজ্যের গ্যালিলি প্রদেশের বেথেলহেম গ্রাম। যোসেফ নাজারেথ গ্রাম থেকে বেথেলহেমে রওনা করলেন, সাথে গর্ভবতী স্ত্রী মেরী। বেথেলহেমে থাকা অবস্থায়ই সন্তান প্রসবের সময় চলে আসলো। জন্ম হলো নাজারেথ যীশু’র। গ্রামে তাদের থাকার যায়গা ছিলো না, সদ্য ভুমিষ্ট যীশুকে তাই যবপাত্রে রাখা হলো।
খৃস্ট ধর্ম প্রচারক যীশু'র জন্ম একটি বিতর্কের বিষয়। খৃস্ট ও ইসলাম ধর্মমতে পিতা ছাড়াই কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে যীশু’র জন্ম হয়েছিলো। খৃস্ট ধর্মমতে যীশু’র পিতা স্বয়ং ইশ্বর, আর ইসলাম ধর্মমতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার ক্ষমতা বলে কুমারী মাতার গর্ভে যীশুকে স্থান দিয়েছিলেন। যীশু’র বংশধরেরা ছিলেন ক্ষমতাবান ধর্মপ্রচারক ও রাজ বংশীয়। মেরী’র সাথে যোসেফ’র (নবী ইউসুফ) বিয়ে যখন ঠিকঠাক, তখনি মেরী’র গর্ভে সন্তান এলো। বিন্দুমাত্র বাস্তব জ্ঞান থাকলে যে কেউই স্বীকার করবে স্বামী ছাড়া কেবল ইশ্বরের আশীর্বাদে সন্তানের জন্ম সম্ভব না। যোসেফের সাথে অবশ্যই মেরী’র বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ছিলো। যার ফলে মেরির গর্ভে সন্তান আসে। ক্ষমতাশালী পরিবার হওয়ায় ব্যাপারটা ইশ্বরের ইচ্ছা বলে চালিয়ে দিয়ে মেরী-যোসেফ সহ তাদের পরিবার পার পেয়ে গিয়েছিলো। কেননা ইব্রাহীমের বংশের কোন পুরুষের লাম্পট্য কোনভাবেই গ্রহনযোগ্যতা পেত না। যোসেফের নিজ বংশীয় ডেভিডের প্রচারিত ধর্মে মসীহের আগমনের সংবাদ ছিলো। সুচতুর যোসেফ আর মেরী পরিবারের অন্যদের সহায়তায় রটিয়ে দিলো গর্ভে আসা সন্তানই হবে সেই মসীহ। যীশু নাম নিয়ে সে ঈশ্বরের সত্য ধর্ম প্রচার করবে। ঐসময় এলাকার কিছু মানুষ আপত্তি তুললে মেরী ও যোসেফ বেথেলহেমে চলে যায়, সেখানেই জন্ম হয় যীশু’র। যোসেফের সাথে মেরীর বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই কিন্তু মেরী গর্ভবতী হয়। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারনেই বিয়ে ঠিক হয়েছিলো কিনা তাই বা কে জানে। ততকালীন সময়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক দুধ ভাত হলেও মেরী-যোসেফের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হেলাফেলার বিষয় ছিলো না। কারন মেরীর পিতা য্যাকব, বোন এলিজাবেথ ও জামাই যাকারিয়াও ধর্ম প্রচারক ছিলেন।
আমরা বহু আগে থেকেই জানি, শুধুমাত্র পিতা অথবা মাতা হতে সন্তান জন্ম সম্ভব না। ছেলে সন্তানের জন্য যেই সেক্স ক্রোমোসোম Y লাগে তা শুধুমাত্র পুরুষ হতেই পাওয়া সম্ভব। যেহেতু খৃস্ট ধর্মমতে কোন পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ছাড়াই কেবল মেরী হতে যীশু’র জন্ম হয়েছিলো, আর তিনি ইশ্বর পুত্র, তাই এই গাজাখুরি কথার পিঠে বলা যায় স্বয়ং ইশ্বরের সাথে মেরীর সম্পর্ক ছিলো, ইশ্বরের শুক্রানু থেকেই যীশু’র জন্ম। তাহলে আবার "নিরাকার" ইশ্বরের তত্ত্ব টিকেনা। আরেকটা কথা বলা যায় মেরীর শরীরেই ডিম্বানু ও শুক্রানু উৎপন্ন হয়েছিলো, তা নিষিক্ত হয়েই যীশু’র জন্ম। স্বাভাবিক কোন নারীর পক্ষে এইসব অসম্ভব ব্যাপার। ধর্মীয় মতেও আবার এই যুক্তি টিকেনা। কারন মেরীকে সবচেয়ে নিখুঁত নারী হিসেবেই খৃস্ট ধর্মাবলম্বীরা মানে, ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কোরআনেও মেরীকে একমাত্র নিখুঁত নারী বলা হয়েছে (দ্রষ্টব্যঃ সহিহ্ মুসলিম, বই ৩১, হাদিস ৫৯৬৬)। হয় যোসেফের সাথে মেরীর যৌন সম্পর্ক ছিলো, অথবা তার পরিবারেরই কারো সাথে!
বিজ্ঞান অনুযায়ী একজন কুমারী নারীর মা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
একজন কুমারী নারীর কোন রকম যৌন সম্পর্ক ছাড়া মা হওয়া সম্ভব। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। একজন কুমারীকে মা হতে হলে তার নিজের ডিম্বগুলোর একটিকে অবশ্যই গর্ভনিষেক নির্দেশক জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন করতে হবে এবং শুক্রানু ডিএনএ'র অভাব পুরণের জন্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে হবে। এই ব্যাপারটা অনেকটাই সহজ এবং ডিম্ব বা ডিম্বপূর্ব অবস্থার কোষগুলোতে এই ঘটনা ঘটতে পারে, যার সম্ভাবনা কয়েক হাজার নারীর মধ্যে একজন। কিন্তু একটি সফল বাচ্চা দিতে ডিম্ব'কে কমপক্ষে দুটি বিশেষ জ্বীনগতভাবে মুছন কাজ করতে হবে। স্পাইক সেন্স করার পর ডিম্ব ভাগ হতে শুরু করে। শুক্রানু প্রবেশের সময় এটি স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। কিন্তু সতঃস্ফুর্ত ক্যালসিয়াম স্পাইকও দেখা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে ডিম্ব তার কাজ যথারীতি শুরু করতে পারে। ত্রুটিযুক্ত শুক্রানু যাতে ডিএনএ নেই ফেইক ক্যালসিয়াম স্পাইক তৈরি করতে পারে। নিষেক হওয়ার পর ডিম্বকোষ বিভাজনের ফাইনাল স্টেইজ সম্পন্ন করতে পারে মিওসিস-২ । এই সময় ডিম্ব তার অর্ধেক জ্বীনবস্ত হারায়, যাতে শুক্রানুর ডিএনএ স্থান পেতে পারে। কিন্তু যদি শুক্রানু না থাকে তাহলে বিভাজিত প্রত্যেক অর্ধডিম্বকোষ ধীরে ধীরে কমে আসবে এবং উভয় কোষের মৃত্যু ঘটবে। কুমারী জন্মদান অব্যাহত রাখতে হলে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিষিক্ত ডিম্বের মিওসিস প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দেয়া যাবে না।
মানবজাতির মধ্যে যৌনসংসর্গ ব্যতীত সন্তানজন্ম Parthenogenesis আপাতঃদৃষ্টিতে সম্ভব নয়। কারণ ডিম্বানু এবং শুক্রানু উভয়ের সিগন্যালই প্রয়োজন। একটি অনুপস্থিত থাকলে অন্যটি প্রকট থাকবে এবং ফাইনালি নিষিক্ত ডিম্ব মারা যাবে। কাজেই মানবজাতির মধ্যে কুমারী মাতার সন্তান জন্মদান সম্ভব হলেও তার সম্ভাবনা খুবই কম। মূলত এই যে জ্বীনগত মুছনকার্য এর সম্ভাবনা এক বিলিয়নভাগের একভাগ।
এবার ব্লগার মুদ্দাকির তার একটি পোস্টে কি বলছেন দেখে নেয়া যাকঃ
ভালোবাসার জৈবিক বিজ্ঞান টেষ্টোস্টেরন
এই যুক্তি খন্ডানোর আগে আবার হিন্দু শাস্ত্র থেকে কুমারী পূজা সম্পর্কে কিছু ধারনা নেয়া যাকঃ
বৃহদ্ধর্মপুরাণ এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারন করলেন।
সব নারী ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবী প্রতিমা চিন্তা করে পূজা করা হয়। এটা মাতৃভাবের প্রতিই শ্রদ্ধা নিবেদন।
চণ্ডীতে বলা হয়েছে, “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম”
অর্থঃ সকলের মধ্যে মায়ের রূপ ধরে যে দেবী বিরাজিতা, তাঁকে পুনঃপুন নমস্কার করি।
সঠিকভাবে পূজা হলে মন বিশুদ্ধ হয়, ঈশ্বরের কৃপালাভ হয়। বয়স অনুসারে কুমারীর নানা শাস্ত্রীয় নাম হয়ে থাকে। যেমনঃ কালিকা, সুভগা, উমা, মালিনী ইত্যাদি। শান্ত, পবিত্র, সর্তশীলা এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণে বিধান আছে। ব্রহ্ম ও শক্তি অভিন্ন। যাঁকে ঈশ্বর, হরি, গড প্রভৃতি বলা হয়, তাঁকেই মাতৃভাবে সাধনার সময় বলা হয় জগজ্জননী। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানবজাতির ক্ষেত্রে মায়ের নীরব অবদানের ঋণ পরিশোধ করা অসম্ভব। নারী শক্তিরূপিণী। তাঁর সঠিক মূল্যায়নের অভাবে আমাদের অবক্ষয় নেমে আসে। আবার তাঁর উপযুক্ত মর্যাদায় সমাজ হয় কল্যাণমুখী। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “মেয়েদের পূজা করেই সব জাত বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতে মেয়েদের পূজা নেই, সে দেশ, সে জাত কখনও বড় হতে পারেনি, কস্মিন্কালেও পারবে না”।
“যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তএ দেবতা। যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যতে সর্বাস্তত্রাফলা ক্রিয়া”।
অর্থঃ যেখানে নারীগণ পূজিতা হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন। যেখানে নারীগণ সম্মানিতা হন না, সেখানে সকল কাজই নিষ্ফল। (মনুসংহিতা, ৩.৫৬) যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসারের, সে দেশের কখনও উন্নতির আশা নেই।
মাটির প্রতিমায় যে দেবীর পূজা করা হয়, তারই বাস্তব রূপ কুমারী পূজা। কুমারীতে সমগ্র মাতৃজাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি পবিত্রতা, সৃজনী ও পালনী শক্তি, সকল কল্যাণী শক্তি সূক্ষ্মরূপে বিরাজিতা। তাই কুমারী পূজা। কুমারী প্রতীকে আমাদের মাতৃরূপে অবস্থিত। সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই মাতৃভাবে আরাধনা। যে জাতির মধ্যে শুদ্ধা, শিক্ষিতা, করুণাময়ী মায়ের সংখ্যা বেশি সে মাতৃজাতির সন্তানেরা সমাজের আদর্শ সন্তান। নিজ নিজ শক্তির বিকাশের জন্য সমগ্র নারী জাতির প্রতি প্রয়োজন নিজের মায়ের শ্রদ্ধা। তাই কুমারী পূজার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ শ্রদ্ধা জানায়। যিনি সকল প্রাণীতে মাতৃরূপে আছেন, তাকে প্রণাম। কুমারী পূজার প্রণামে আছে তিনি “পরমভাগ্যসন্দায়িনীম এবং ভুবনবাক কুমারীং ভজে”। অর্থঃ কুমারী প্রতীকে জগজ্জননীর পূজায় পরম সৌভাগ্য লাভ হয়। এ কুমারী সমগ্র জগতের বাক্যস্বরূপা, বিদ্যাস্বরূপা। তিনি এক হাতে অভয় এবং অন্য হাতে বর প্রদান করেন। অন্য ধ্যান আছে, “ভদ্রবিদ্যাপ্রকাশিনীম”। তিনি সকল শুভ বিদ্যার প্রকাশিকা। তাই মাতৃজাতির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমরা আমাদের সমাজ ও জীবনকে মহৎ করে তুলতে পারি। শাস্ত্রকাররা নারীকে সন্মান ও শ্রদ্ধা করতে এই পূজা করতে বলেছেন। আমাদের সনাতন ধর্মে নারীকে সন্মানের শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে। “নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সন্মান জানাতে হবে” এটাই কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য। সকল নারীর মধ্যই বিরাজিত রয়েছে দেবীশক্তি। তবে কুমারী রূপেই মা দুর্গা বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছিলেন। তাই, কুমারী রূপে নারীকে দেবীজ্ঞানে সন্মান জানানোর একটি বাস্তব উদাহরন হচ্ছে “কুমারী পূজা”।
এবার দেখে নেয়া যাক, মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্যঃ
আল্লাহ পাক নিজেই মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন,
وَمَرْيَمَ ابْنَتَ عِمْرَانَ الَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهِ مِن رُّوْحِنَا وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنَ الْقَانِتِينَ- (التحريم ১২)-
অর্থঃ তিনি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ইমরান তনয়া মারিয়ামের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ হতে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাব সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল এবং সে ছিল বিনয়ীদের অন্যতম (তাহরীম ৬৬/১২)।
মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিলো। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল (আঃ) উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপঃ
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَاناً شَرْقِيًّا- فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَاباً فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا- قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَن مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا- قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلاَمًا زَكِيًّا- قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلاَمٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا- قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا- (مريم ১৬-২১)-
অর্থঃ (হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হতে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিলো’ (মারিয়াম ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিলো। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’ (১৭)। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’ (১৮)। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’ (১৯)। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’ (২০)। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম ১৯/১৬-২১)। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হলো (আম্বিয়া ২১/৯১; তাহরীম ৬৬/১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান ৩/৪৫)।
অতঃপর আল্লাহ বলেন,
فَحَمَلَتْهُ فَانتَبَذَتْ بِهِ مَكَانًا قَصِيًّا- فَأَجَاءهَا الْمَخَاضُ إِلَى جِذْعِ النَّخْلَةِ قَالَتْ يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذَا وَكُنتُ نَسْيًا مَّنْسِيًّا- فَنَادَاهَا مِنْ تَحْتِهَا أَلاَّ تَحْزَنِي قَدْ جَعَلَ رَبُّكِ تَحْتَكِ سَرِيًّا- وَهُزِّيْ إِلَيْكِ بِجِذْعِ النَّخْلَةِ تُسَاقِطْ عَلَيْكِ رُطَبًا جَنِيًّا- فَكُلِيْ وَاشْرَبِيْ وَقَرِّيْ عَيْنًا فَإِمَّا تَرَيِنَّ مِنَ الْبَشَرِ أَحَدًا فَقُولِيْ إِنِّيْ نَذَرْتُ لِلرَّحْمَنِ صَوْماً فَلَنْ أُكَلِّمَ الْيَوْمَ إِنسِيًّا- (مريم ২২-২৬)-
অর্থঃ ‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করলো এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেলো’(মারিয়াম ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খেজুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলো। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’ (২৩)। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’ (২৪)। ‘আর তুমি খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’ (২৫)। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখো, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য সিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারও সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম ১৯/২২-২৬)।
যেহেতু ঈসা (আঃ) এর জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অলৌকিক, তাই তার গর্ভধারণের মেয়াদ স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত ছিল বলেই ধরে নিতে হবে। নয় মাস দশদিন পরে সন্তান প্রসব শেষে চল্লিশ দিন ‘নেফাস’ অর্থাৎ রজঃস্রাব হতে পবিত্রতার মেয়াদও এখানে ধর্তব্য না হওয়াই সমীচীন। অতএব ঈসাকে গর্ভধারণের ব্যাপারটাও যেমন নিয়ম বহির্ভূত, তার ভূমিষ্ট হওয়া ও তার মায়ের পবিত্রতা লাভের পুরা ঘটনাটাই নিয়ম বহির্ভূত এবং অলৌকিক। আর এটা আল্লাহর জন্য একেবারেই সাধারণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হবে, মাকে দশ মাস গর্ভধারণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এই নিয়ম ভেঙ্গে সন্তান দান করাও তাঁরই এখতিয়ার। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,
إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ- الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّنَ الْمُمْتَرِيْنَ- (آل عمران ৫৯-৬০)-
অর্থঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে ঈসার দৃষ্টান্ত হলো আদমের মতো। তাকে তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং বলেন, হয়ে যাও ব্যস হয়ে গেলো’। ‘যা তোমার প্রভু আল্লাহ বলেন, সেটাই সত্য। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/৫৯-৬০)।
অর্থাৎ, আদমকে যেমন পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়াই শুধু মায়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এটাই যে সত্য এবং এর বাইরে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা যে মিথ্যা, সে কথাও উপরোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, যে বনু ইস্রাঈলের নবী ও রাসূল হয়ে ঈসা (আঃ) এর আগমন ঘটলো, সেই ইহুদী-নাছারারাই আল্লাহর উক্ত ঘোষণাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছে। অথচ এই হতভাগারা মারিয়ামের পূর্বদিকে যাওয়ার অনুসরণে পূর্বদিককে তাদের ক্বিবলা বানিয়েছে।
এর পরের ঘটনা, আল্লাহ বলেন,
فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ قَالُوْا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئًا فَرِيًّا- يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوْكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيًّا- (مريم ২৭-২৮)-
অর্থঃ ‘অতঃপর মারিয়াম তার সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলো। তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমি একটা আশ্চর্য বস্ত্ত নিয়ে এসেছো। ‘হে হারূণের বোন! তোমার পিতা কোন অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা তোমার মাতাও কোন ব্যভিচারিণী মহিলা ছিলেন না’ (মারিয়াম ১৯/২৭-২৮)।
কওমের লোকদের এ ধরনের কথা ও সন্দেহের জওয়াবে নিজে কিছু না বলে বিবি মারিয়াম তার সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে ইশারা করলেন। অর্থাৎ একথার জবাব সেই দিবে। কেননা সে আল্লাহর দেওয়া এক অলৌকিক সন্তান, যা কওমের লোকেরা জানে না।
আল্লাহ বলেন,
فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَنْ كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيًّا- قَالَ إِنِّيْ عَبْدُ اللهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا- وَجَعَلَنِيْ مُبَارَكاً أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِيْ بِالصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا- وَبَرًّا بِوَالِدَتِيْ وَلَمْ يَجْعَلْنِيْ جَبَّارًا شَقِيًّا- وَالسَّلاَمُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوْتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا- (مريم ২৯-৩৩)-
অর্থঃ ‘অতঃপর মারিয়াম ঈসার দিকে ইঙ্গিত করল। তখন লোকেরা বলল, কোলের শিশুর সাথে আমরা কিভাবে কথা বলবো’? (মারিয়াম ২৯)। ঈসা তখন বলে উঠলেন, ‘আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’ (৩০)। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে’ (৩১)। ‘এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’ (৩২)। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করবো এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হবো’ (মারিয়াম ১৯/২৯-৩৩)।
ঈসার উপরোক্ত বক্তব্য শেষ করার পর সংশয়বাদী ও বিতর্ককারী লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন,
ذَلِكَ عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِيْ فِيْهِ يَمْتَرُوْنَ- مَا كَانَ ِللهِ أَن يَّتَّخِذَ مِنْ وَلَدٍ سُبْحَانَهُ إِذَا قَضَى أَمْراً فَإِنَّمَا يَقُوْلُ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ- وَإِنَّ اللهَ رَبِّيْ وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْهُ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيْمٌ- (مريم ৩৪-৩৬)-
অর্থঃ ‘ইনিই হলেন মারিয়াম পুত্র ঈসা। আর ওটাই হলো সত্যকথা (যা উপরে বর্ণিত হয়েছে), যে বিষয়ে লোকেরা (অহেতুক) বিতর্ক করে থাকে’ (মারিয়াম ৩৪)। ‘আল্লাহ এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন (যেমন অতিভক্ত খৃষ্টানরা বলে থাকে যে, ঈসা ‘আল্লাহর পুত্র’)। তিনি মহাপবিত্র। যখন তিনি কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! ব্যস, হয়ে যায়’ (৩৫)। ‘ঈসা আরও বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। (মনে রেখো) এটাই হলো সরল পথ’ (মারিয়াম ১৯/৩৪-৩৬)।
মারিয়ামের গর্ভধারণ ও ঈসার জন্মগ্রহণ ছিলো সম্পূর্ণরূপে অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ পাক নিয়মের স্রষ্টা এবং তিনিই নিয়মের ভঙ্গকারী। তাকে কোন বিষয়ে বাধ্য করার মতো কেউ নেই। তিনি পিতা-মাতা ছাড়াই আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পিতা ছাড়াই শুধু মাতার মাধ্যমে ঈসাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন। ঈসা কোন উপাস্য ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অন্যদের মত আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর একজন সম্মানিত নবী ও কিতাবধারী রাসূল। ঈসা যে বিনা বাপে পয়দা হয়েছিলেন, তার অন্যতম প্রমাণ এই যে, কুরআনের সর্বত্র তাঁকে ‘মারিয়াম-পুত্র’ (عيسى ابن مريم) বলা হয়েছে (বাক্বারাহ ২/৮৭, ২৫৩; আলে ইমরান ৩/৪৫ প্রভৃতি)। পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে হয়তবা তাঁকে কেবল ঈসা বলেই সম্বোধন করা হতো, যেমন অন্যান্য নবীগণের বেলায় করা হয়েছে। অথচ মারিয়ামকে তার পিতার দিকে সম্বন্ধ করে ‘মারিয়াম বিনতে ইমরান’ (ابنت عمران) ‘ইমরান-কন্যা’ বলা হয়েছে (তাহরীম ৬৬/১২)। একমাত্র মারিয়ামের নাম ধরেই আল্লাহ তাঁর সতীত্বের সাক্ষ্য ঘোষণা করেছেন (তাহরীম ৬৬/১২)। যা পৃথিবীর অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে করা হয়নি। অতএব যাবতীয় বিতর্কের অবসানের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তাছাড়া আল্লাহ তাঁকে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ অর্থাৎ কথায় ও কর্মে ‘সত্যবাদীনী’ আখ্যা দিয়েছেন (মায়েদাহ ৫/৭৫)। যেটা অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে দেওয়া হয়নি।
অর্থাৎ, পৃথিবীতে কুমারী মা নিয়ে যেসকল পুরাণ আর ধর্মে কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে তার সবগুলোই একই সূত্রে গাঁথা। ঈশ্বর তার সৃষ্টিকর্মের স্বরূপ পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রমান হিসেবে কুমারী মায়ের মাধ্যমে রূপক আকারে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যেন আমরা যুগে যুগে এক ঈশ্বরের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করি এবং হেদায়েত প্রাপ্ত হই।
উৎসঃ সামহোয়ারইনব্লগ
Share on facebook Share on email Share on print
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন