এক দিনের অবরোধে খুলনায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি
26 Dec, 2013
প্রতি এক দিনের হরতাল-অবরোধে খুলনার ব্যবসা-বাণিজ্যে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ১৮ দলীয় জোটের দফায় দফায় হরতাল-অবরোধে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা পড়েছেন বিপাকে।
জানা যায়, ছকবাঁধা অবরোধে এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। দূরপাল্লার পরিবহন চলাচল করতে না পারায় হিমায়িত চিংড়ি খুলনা থেকে দেশ-বিদেশে পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে না। একইভাবে মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে না। যার কারণে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকার হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব।
বিভাগের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এক দিন অবরোধ কিংবা হরতাল হলে খুলনাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, অবরোধ হলে সড়ক ও নৌপথে পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগ-ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। মংলা বন্দরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আমদানি ও রপ্তানিকারক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন। বিশেষ করে, ইউরোপের যেসব দেশে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করা হতো অবরোধের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
জানা যায়, খুলনা অঞ্চলের সাদা সোনা খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ি বিশ্বের ১৯টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশগুলো হচ্ছে- ফ্রান্স, চীন, জাপান, ইতালি, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম, তাইওয়ান, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, মারিশাস, ইউএই, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, সাইপ্রাস ও ডেমোনিকান রিপাবলিক।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, খুলনায় ছোট-বড় শতাধিক হিমায়িত মাছ রপ্তানিকারক কো¤পানি রয়েছে। আর এ শিল্পটির সঙ্গে নানাভাবে জড়িত কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। চিংড়িসহ নানা ধরনের মাছ প্রক্রিয়া ও রপ্তানির মাধ্যমে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে এ শিল্প থেকে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এম খলিলউল্লাহ বলেন, চলমান অবরোধে খুলনাঞ্চলের চিংড়ি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। চিংড়ি যথাসময়ে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। যেসব চিংড়ি ঘের থেকে ধরা হয় সেগুলো কোম্পানিতে আনা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া যেসব চিংড়ি কোম্পানিতে আনা হয় সেগুলোতে পচন ধরে। তিনি চিংড়ি শিল্পকে অবরোধ ও হরতালের আওতামুক্ত রাখার আহ্বান জানান।
কয়েকজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, দফায় দফায় হরতাল থাকার কারণে লাভজনক শিল্পগুলো ক্রমান্বয়ে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হচ্ছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য অচল করে দেওয়া এই ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির বিপরীতে ভিন্ন কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তারা। চলমান অবরোধে চিংড়িশিল্প ছাড়াও খুলনার সরকারি ও বেসরকারি ১৫-২০টি পাটকল ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে। এ ছাড়া ব্যাংক-বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ শেয়ারবাজারের সিকিউরিটিজ হাউজগুলো গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীশূন্য হয়ে পড়ছে।
এদিকে হরতাল-অবরোধে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। চাল, ডাল থেকে শুরু করে শীতকালীন সবজির দামও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে গেছে।
নগরীর কয়েকজন ক্রেতা বলেন, ‘এ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই বাজারে সবজির দাম কম থাকার কথা। কিন্তু আমরা কম দামে সবজি পাচ্ছি না। পাশাপাশি অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী।’
তারা আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। এরই মধ্যে নিত্যপণ্যসহ সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দুর্বিষহ দিন কাটছে।’
এ প্রসঙ্গে শান্তিধাম মোড় এলাকার ব্যবসায়ী মো. ইরফান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে চলছে। আর এতে আয়-রোজগারহীন সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
দাম বাড়া প্রসঙ্গে বড়বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, দেশের এরূপ অবস্থায় আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে লোকসান। মহাসড়কে পণ্য পরিবহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটায় ঠিক সময়ে পণ্য বাজারে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই তাদের বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে পণের দাম।
সবজি ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘অবরোধের কারণে গ্রামগঞ্জ থেকে বাজারে সবজি আসতে না পারায় বাজারগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সবজি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে পাইকারি বাজার থেকেই আমাদেরকে বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে। তাই খুচরা বাজারে আমরা কম দামে সবজি বিক্রি করতে পারছি না।’
সবজি ব্যবসায়ী মো. মজিবুর রহমান বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের অনেক এলাকা থেকে পণ্যবাহী ট্রাক আসতে পারছে না। এ কারণে সবজির দাম কমছে না। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে বাজারে সবজির দামও কমে আসবে।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, দফায় দফায় অবরোধে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা মংলা ইপিজেড ও খুলনার শিল্প এলাকার উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। চলতি বছর বারবার অবরোধ ও হরতাল হওয়ার কারণে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে।
তিনি জানান, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
তিনি হরতাল না দেওয়ার জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান।
উৎসঃ রাইজিংবিডি
Share on facebook Share on email Share on print
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন