বন্ধ হচ্ছে ৫০০ গার্মেন্ট
22 Dec, 2013
রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভেঙে পড়েছে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড তৈরী পোশাক শিল্প। ইতিমধ্যেই ৫০০-এর বেশি গার্মেন্ট মালিক তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিজিএমইএ-কে তারা কারখানা বন্ধ করার কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। এ সংখ্যা আগামী মাসে ৭০০-তে পৌঁছবে বলে বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে। বিজিএমইএ নেতারা জানিয়েছেন, চলমান অস্থিরতা ও রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ক্রমেই হুমকির মুখে পড়েছে পোশাকশিল্প। উৎপাদন ও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে তা গভীর সঙ্কটে রূপ নিতে পারে। চলমান সহিংস পরিস্থিতির কারণে গত মাসে এক অনুষ্ঠানে গার্মেন্ট ব্যবসা বাদ দিয়ে নিরাপদ প্রস্থানের জন্য সরকারের কাছে একটি পরিকল্পনা চান বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম। এরপর কারখানার মালিকরা বিজিএমইএ’র কাছে আবেদন করেন। জানতে চাইলে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বর্তমানে ৩৬০০ কারখানা চালু রয়েছে। এর মধ্যে বড় কারখানার অর্ডার নিয়ে কাজ করছে ২৪০০ কারখানা। এসব কারখানায় বর্তমানে ৪৪ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। তিনি বলেন, বর্তমান পোশাকশিল্পে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে ব্যবসা চালু রাখা মালিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। ‘খুবই খারাপ অবস্থা যাচ্ছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক মালিক ব্যবসা বন্ধের জন্য আবেদন করেছেন। এ সংখ্যাটা ৫০০-র কাছাকাছি হবে। জানুয়ারি মাসে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। তখন ৭০০ ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে অনেক কারখানার মালিক ব্যয় কমানোর জন্য তাদের শ্রমিকদের ছাঁটাই করেছেন। কারণ চাহিদা ও সরবরাহ না থাকায় তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। কাজ কম, বেশি পরিমাণে শ্রমিক মালিকরা রাখবেন কেন? বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে মালিকদের পক্ষে ব্যবসা চালু রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়। একদিন অবরোধ হলে পোশাকশিল্পের ক্ষতি হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর প্রভাব তো সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর পড়বেই। বিজিএমইএ সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ২৭০১ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যেখানে শুধু পোশাক খাত থেকে এসেছে ২১৫১ কোটি ৫৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ হিসাবে দেখা যায়, গত ১০ বছরে প্রবাসীদের পাঠানো ও রপ্তানি খাত থেকে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ১৫১ হাজার ৪৬৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু তৈরী পোশাক খাত থেকে এসেছে ১১ হাজার ৭৫৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭ হাজার ডলার। ১০ বছর আগে দেশে পোশাক কারখানা ছিল ৪১০৭টি। বর্তমানে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬০০-তে। ফলে প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে।
তবে অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এখন সব কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কারখানা থেকে মাল বন্দরে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। বন্দর থেকে কোন কাঁচামাল কারখানাতে আনাও যাচ্ছে না। পুলিশ পাহারায় রাতে যে কটা গাড়ি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ছে। এ কারণে অতিরিক্ত খরচ দিয়ে বিমানে করে ক্রেতাদের কাছে মালামাল পৌঁছানো হচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদনের সরবরাহ ব্যবস্থাটা একদমই ভেঙে পড়েছে বলে মনে করছেন বিজিএমইএ নেতারা।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আমাদের প্রোডাকশনের যে সাপ্লাই চেইন আছে, এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে তা পুরোপুরি ভেঙে যায়। শ্রমিকরা ঠিকমতো কর্মস্থলে যেতে পারছেন না, ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম বন্ধ, প্রোডাকশন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থাকলে শিল্প টিকবে না। আর পোশাকশিল্প না টিকলে দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির ডাকা ১৯শে নভেম্বর পর্যন্ত ১৮ দিনের হরতালে প্রতিদিন ২০০ কোটি টাকা করে ক্ষতি হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬০০ কোটি টাকা। বিজিএমইএ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, টানা অবরোধে গত ১ থেকে ৯ই ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যাদেশ বাতিল, মূল্যছাড়, এয়ারফ্রেইট, জাহাজীকরণে দেরি ও নাশকতায় পোশাকশিল্পের মোট ১৬৫ লাখ ডলারের ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ১২৯ কোটি টাকা। তবে এ হিসাব মাত্র ২১টি পোশাক কারখানার। ২১টি পোশাক কারখানার ক্ষতির হিসাব করলে দেখা যায়, ওই সময়ের মধ্যে কার্যাদেশ বাতিল ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫৬.৭০ ডলার সমমূল্যের, মূল্যছাড় ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ৩১৪.২৫ ডলার, এয়ারফ্রেইট ৮ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৩.৬৮, জাহাজীকরণে দেরি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার ৭৯৭.৪৮ এবং নাশকতায় ক্ষতি হয়েছে ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৯০.৫৮ ডলার।
তা ছাড়া তফসিল ঘোষণার আগেও হরতাল-অবরোধ ছিল, যা এ খাত এবং সার্বিক অর্থনীতির জন্যই অকল্যাণকর বলে মনে করছেন পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টরা। বিগত দশ বছরে এ শিল্পে যে অগ্রগতি হয়েছে তা আজ হুমকির মুখে। শুরু হয়েছে অস্তিত্ব নিয়ে টানাপড়েন।
একদিকে কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, অন্যদিকে সময়মতো শিপমেন্ট দিতে না পারায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে তৈরী পোশাকের অর্ডার। বিপাকে পড়েছেন পোশাক কারখানার উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা আন্দোলনে নেমে বারবার অনুরোধ জানালেও রাজনীতিকরা তা আমলেই নিচ্ছেন না।
এদিকে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরসহ সব অঞ্চলের পোশাক শ্রমিকই ছাঁটাই আতঙ্কে ভুগছেন। সমপ্রতি ২০টি কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পর এ আতঙ্ক আরও বেড়ে গেছে। ছাঁটাইয়ের অপেক্ষায় আছেন আরও অন্তত ৫০টি কারখানার শ্রমিক। খরচ কমানোর কৌশল হিসেবেই শ্রমিক ছাঁটাই করছেন মালিকরা। মজুরি নিয়ে চলা শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিচ্ছেন তারা। তবে এ ঘটনায় খাতটি আবারও অস্থির হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শ্রমিক নেতারা। এসব কারখানা কর্তৃপক্ষই ওই সব শ্রমিকের বিরুদ্ধে অসন্তোষের অভিযোগ এনে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তবে তার আগে পাওনা মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানান, নতুন মজুরি কাঠামো ডিসেম্বর থেকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। তার আগে যতটা সম্ভব খরচ কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন মালিকরা। তবে শ্রমিক নেতাদের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিকরা। কিছুসংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই করে কারখানার খরচ কমানো সম্ভব নয় জানিয়ে তারা বলেন, দুই বছর ধরেই শ্রমিক বিক্ষোভকে পুঁজি করে অসন্তোষ সৃষ্টিতে তৎপর একটি চক্র। এর নেপথ্যে রয়েছেন ১০-১২টি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এ চক্রের ১৫-২০ জন করে শ্রমিক প্রত্যেক কারখানায়ই কাজ করছেন। কার্ড পাঞ্চের পর কাজ না করেই কারখানা থেকে বেরিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন এ চক্রের সদস্যরা। এটা বন্ধ করতেই মালিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে বিক্ষোভে জড়িত শ্রমিকদের ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা নিয়েছেন। সেটাই এখন বাস্তবায়ন করছেন তারা।
উৎসঃ মানবজমিন
Share on facebook Share on email Share on print 5
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন