বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩
রেল নাশকতার নেপথ্যে রেল কর্মীরাই! গোয়েন্দা প্রতিবেদন
05 Dec, 2013
১৮ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশনের আশপাশেও বড় ধরনের নাশকতা চালানো হয়। রেললাইন উপড়ে ফেলা থেকে শুরু করে ফিসপ্লেট খুলে ফেলা, লাইনে আগুন দেয়া ও স্লিপার তুলে ফেলা হয়। এ কারণে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
গত ফেব্রুয়ারি থেকিই চলছে এ নাশকতা। এ পর্যন্ত ১৬৯টি নাশকতার ঘটনা ঘটলেও সেটা এড়ানোর কোনো চেষ্টা নেই রেলওয়ের। এসব নাশকতার নেপথ্যে রেলওয়ের নিজস্ব কর্মীরাই জড়িত বলে মনে করছেন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে গোয়েন্দা শাখার পৃথক প্রতিবেদনেও এ ধরনের আভাস দেয়া হয়েছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, নাশকতার বড় আঘাত আসে রেলওয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। এ পথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও কুমিল্লায় তিন দফা ফিসপ্লেট ও লাইন খুলে ফেলা হয়। এর মধ্যে অবরোধ শুরুর আগে গত সোমবার রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় কসবা ও ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যে ৬৬৮ ফুট লাইন (এক কিলোমিটারের বেশি) তুলে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, মাত্র ৪০ মিনিটে কসবা ও ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যে এক কিলোমিটারের বেশি রেললাইন তুলে ফেলা হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে এত দ্রুত রেললাইন তুলে ফেলা সম্ভব নয়। এছাড়া লাইনটি তোলার জন্য ফিসপ্লেট ও রেলক্লিপ খোলা হয়। এজন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র দরকার; যা সাধারণ মানুষের কাছে থাকার কথা নয়।
এছাড়া গত মঙ্গলবার সকাল থেকে অবরোধ শুরু হলেও সোমবার রাতেই লাইন তুলে ফেলা অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা বলে রেল বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
জানা গেছে, প্রতিটি ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে রেলপথ চেকআপ করার কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না। তাই দিন দিন ট্রেন দুর্ঘটনা বাড়ছে। পিডব্লিউআই (পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর) সপ্তাহে একদিন এবং এপিডব্লিউআই (অ্যাসিস্ট্যান্ট পার্মানেন্ট ওয়ে ইন্সপেক্টর) সপ্তাহে তিন দিন এলাকাভিত্তিক রেলপথ পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তারা তা করছেন না।
অন্যদিকে মিস্ত্রির প্রতিদিন লাইন চেক করা এবং চাবিম্যানের প্রতিদিন লাইনের চাবি, ওয়াশার, নাট-বল্টু চেক করার কথা থাকলেও তারা করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান প্রকৌশলীর অধীনে পিডব্লিউআই, এপিডব্লিউআই, মিস্ত্রি, চাবিম্যানসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত থাকেন। এদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে নাশকতার ঘটনা রেড়েই চলছে।
এছাড়া রেলওয়েতে তিন ধরনের স্বীকৃত নিরাপত্তা টহলের ব্যবস্থা থাকলেও তা পুরোপুরি কার্যকর নেই। ফলে নাশকতার শিকার হয়ে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জীবনের ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে ইমার্জেন্সি শাটল, ইমার্জেন্সি ট্রলি ও ইমার্জেন্সি টহলব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম রয়েছে। এই তিনটি ব্যবস্থা কার্যকর থাকলে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেনগুলোকে নাশকতার হাত থেকে রক্ষা করা অনেকটাই সম্ভব।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর থেকেই মূলত রেল যোগাযোগে নাশকতা শুরু। ১৮ দলীয় জোটের দুই দফা অবরোধ কর্মসূচিতে সেটা ব্যাপকতা পেয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত জরুরি উল্লিখিত তিন ব্যবস্থা কার্যকর করেনি রেলের প্রকৌশল বিভাগ।
অবরোধে নাশকতা বৃদ্ধির পর রেল কর্তৃপক্ষ সারাদেশে রেলপথ ও রেল স্থাপনার মধ্যে ৬৩২টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব স্থানে চারজন করে আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ ট্রেনের গতি কমিয়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদ্যোগ নেয়। এতে সারাদেশে ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়ে। আয়ও নেমে আসে অর্ধেকে। নিয়ম আছে স্পর্শকাতর সময় কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন গন্তব্যে ছাড়তে হলে তার আগে একটি কোচ লাগানো ইঞ্জিন যাত্রা করবে। এটাই ইমার্জেন্সি শাটল।
এটি রেললাইন ঠিক ও নিরাপদ আছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করতে করতে যাবে। আর পেছনে যাবে যাত্রীবাহী বা মালবাহী ট্রেন। ফলে রেললাইনে যে কোনো ধরনের ত্রুটি পাওয়া গেলে ইমার্জেন্সি শাটল নিকটবর্তী স্টেশন মাস্টারের কাছে আগাম বার্তা পাঠাবে।
তখন যাত্রী বা মালবাহী ট্রেনটি নিকটতম স্টেশন বা উপযুক্ত স্থানে থামিয়ে রাখা হবে, রেললাইন ঠিক না হওয়া পর্যন্ত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, লাকসাম, আখাউড়া, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনেই এই ইমার্জেন্সি শাটলের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এসব যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইমার্জেন্সি শাটলের মতো ইমার্জেন্সি ট্রলিও রেললাইন নিরাপদ আছে কিনা, তা যাত্রী বা মালবাহী ট্রেনের আগে যাত্রা করে কাছের স্টেশনে আগাম বার্তা পাঠাবে। তৃতীয় ব্যবস্থা হলো জরুরি টহল। প্রতি পাঁচ মাইল রেললাইনে একজন ম্যাটের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি দল থাকে। তারা পথ ভাগ করে সার্বক্ষণিকভাবে হেঁটে রেললাইন পর্যবেক্ষণ করবেন। যদি কোনো নাশকতার চিহ্ন দেখেন, তার তথ্য সংশ্লিষ্ট স্টেশনে জানাবেন এবং রেললাইন মেরামত করবেন। দিনের বেলায় এ কাজটি হয় বলে জানা গেছে।
ইমার্জেন্সি শাটল, ইমার্জেন্সি ট্রলি ও ইমার্জেন্সি টহলব্যবস্থা কার্যকর করার দায়িত্ব রেলের প্রকৌশল দফতরের। এতে করে রেলের প্রকৌশল দফতরের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রেলের নাশকতা এড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি বিষয়ে দায়িত্ব তাদের।
রেলওয়ের পরিচালক (ট্রাফিক) সৈয়দ জহুরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিনের নাশকতার সঙ্গে রেলওয়ের কর্মীরা যুক্ত থাকতে পারেন। কারণ রেলে ট্রেড ইউনিয়ন আছে। এসব ইউনিয়নে বিভিন্ন মতাদর্শের শ্রমিক রয়েছেন। তারা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। অবরোধের সময় বিভিন্ন জায়গায় গাছের গুড়ি ফেলে, ঢিল ছুড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধের চেষ্টা করা হয়। সাধারণ মানুষ ফিসপ্লেট বা লাইন খুলতে পারলে সব স্থানে এ চেষ্টাই করা হতো। রেলপথ আটকে অবরোধ করার প্রয়োজন হতো না। তাই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা উচিত।
এদিকে রেলপথে চলমান নাশকতায় রেলওয়েরই শ্রমিক সংগঠনভিত্তিক একশ্রেণীর কর্মচারী জড়িত বলে ইঙ্গিত পেয়েছে গোয়েন্দা শাখা। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন দিনে রেলপথে নাশকতাকারীদের অনেকের মুখ ঢাকা ছিল। তারা রেলওয়ের লোক বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা ইমামবাড়ী এলাকায় যেভাবে এক কিলোমিটার রেললাইন সরিয়ে ফেলা হয়, তা খুব অল্প সময়ের মধ্যে করা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
রেলওয়ের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অবরোধে চলমান নাশকতার সঙ্গে রেলওয়ের নিজস্ব কর্মীরা জড়িত থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তবে তারা সরাসরি এ কাজ না করলেও নাশকতাকারীদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু তাহের বলেন, ‘রেলওয়ের লোকবলের বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় অস্থায়ী নিয়োগ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এদের নাম কেটে দিলেই চাকরিচ্যুত। তাই নাশকতার সঙ্গে অস্থায়ী লোকজন জড়িত থাকলে রেলওয়ের কিছু করার নেই।’
এছাড়া নাশকতার সঙ্গে রেলওয়ের কর্মী জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
উৎসঃ বাংলামেইল২৪
Share on facebook Share on email Share on print 7
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন