বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

দুই দলের দুর্নীতি 05 Dec, 2013 স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর নতুনভাবে বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয় ১৯৯১ সালে। দুই নেত্রীরই প্রতিশ্রুতি ছিল, সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে রাজনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু দুই দশকে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সুশাসন অবস্থান দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। একের পর এক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে দুই দলের নেতৃত্বাধীন শাসনামলেই। গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অনেক রাঘব-বোয়ালের নামও। তবু অদ্ভুতভাবে নিশ্চুপ থেকেছেন বর্তমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ও আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকারের দুই মেয়াদে কী পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি হয়েছে, তা নিরূপণের জন্য অর্ধশতাধিক বিশেষজ্ঞ, সাবেক আমলা, বিচারপতি, অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সাবেক উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি আকার দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে বণিক বার্তা। সিংহভাগ ব্যক্তিই মতামত দেন, এরশাদ-পরবর্তী সময়ে দুটি রাজনৈতিক দলেরই প্রথম পর্যায়ের শাসনামলে তুলনামূলক কম দুর্নীতি হয়েছে। তাদের অনুমান, এ সময়ে দুর্নীতির পরিমাণ সরকারি ব্যয়ের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের মধ্যেই ছিল। তবে বিএনপির সর্বশেষ মেয়াদে (২০০১-০৬) হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতিসহ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক অনিয়মের কারণে তা ১৫ শতাংশে উন্নীত হয় বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন। আর আওয়ামী লীগের চলমান শাসনামলে শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, ব্যাংক ও রেল কেলেঙ্কারি, বিভিন্ন মাল্টিলেভেল ব্যবসার নামে যেসব দুর্নীতি হয়েছে, তা যেকোনো সময়ের দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে গেছে। রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও গত পাঁচ বছরে মোট সরকারি ব্যয়ের কমপক্ষে ২০ শতাংশ অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান। গত চার সরকারের আমলে অর্থনৈতিক সুশাসনের অভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকার। বিএনপির প্রথম সরকারের আমলে পাঁচটি অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের ১০ শতাংশ হারে মোট দুর্নীতি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ আমলে তা দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকায়। দেশের অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোট বাজেটও বাড়তে থাকে। পাশাপাশি বেড়ে যায় দুর্নীতির পরিমাণ। বিএনপির সর্বশেষ শাসনামলে মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ হারে হিসাব নিয়ে দুর্নীতি দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকার। তবে আওয়ামী লীগের চলমান শাসনামলে এর পরিমাণ সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ মেয়াদে দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা। দুর্নীতি আবার শুধু কয়েকটি খাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সেবা, শিক্ষা কিংবা স্থানীয় সরকার বিভাগসহ সব খাতে। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত কয়েক দশকে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অঙ্গীভূত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশেষ মহলকে সুবিধা দিতেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুর্নীতি করানো হচ্ছে। ফলে দুর্নীতিবাজরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনের আওতায়ও আনা যাচ্ছে না তাদের। আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ২০০১-০৬ শাসনামলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষ সময়ে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কেলেঙ্কারি আলোচনায় আসে। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৬ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ ও পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে তদন্তের পর ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন’ অনুযায়ী ব্যাংকটির উদ্যোক্তা ও ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিম এবং বেঙ্গল গ্রুপের কর্ণধার আবুল খায়ের লিটুর নামে-বেনামে থাকা সব শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয়। বর্তমানে ব্যাংকটি আইসিবি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামে পরিচালিত হলেও বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বিএনপির পর বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেও আক্রান্ত হয় ব্যাংকিং খাত। সোনালী ব্যাংক থেকে হল-মার্ক গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বেসিক ব্যাংক থেকেও কয়েকটি গ্রুপ হাতিয়ে নেয় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক থেকেও বড় অঙ্কের অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা দুই সরকারের আমলেই বহাল তবিয়তে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আর্থিক খাতগুলোকে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনভিপ্রেত রাজনৈতিক বিরূপ প্রভাব বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পড়তে শুরু করেছে। তাই এ খাতে দুর্নীতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের চেয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। শেয়ারবাজার: শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে বড় ধরনের অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে বর্তমান সরকার। দেশের ইতিহাসে দুটি ধসের ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধী সরকারের আমলে। ১৯৯৬ সালের কারসাজি ঘটনার প্রায় ১৭ বছর পার হতে চললেও সাজা পাননি কেউ। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব কটি মামলাই বছরের পর বছর স্থগিত রয়েছে। আর ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় বড় রাঘব-বোয়ালদের ছেড়ে দিয়ে মধ্যম শ্রেণীর পাঁচ কারসাজিকারীর বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে দুটি মামলা হলেও আজ পর্যন্ত শুনানি হয়নি। এ বিষয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক তথ্য প্রমাণ করে, আর্থিক খাতে দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। ঘটনাপ্রবাহ সুশাসনের অভাবকেই প্রতিষ্ঠিত করছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োজিত সরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা সুশাসনের কোনো নজির স্থাপন করতে পারেননি। অন্যায়-দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে নিরপেক্ষ আইনের শাসন প্রয়োজন। বিদ্যুৎ খাত: সরবরাহ লাইন বাড়ানোর নামে আলোচিত খাম্বা ব্যবসার জন্ম দিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। এ খাত নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় ওই সরকারের এক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগও করতে হয়। জ্বালানি খাতেও নাইকো কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন তত্কালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। এদিকে বর্তমান সরকার সুশাসনের অভাবে নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকারি বিদ্যুেকন্দ্রগুলো। বাধ্য হয়েই বাড়াতে হয়েছে ভাড়াভিত্তিক অধিক ব্যয়বহুল বিদ্যুেকন্দ্রের মেয়াদ। এক্ষেত্রে মহাপরিকল্পা বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ, জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, ২০১০ তৈরি করা হয়। আইনটির আওতায় এ বিষয়ে নেয়া কোনো সিদ্ধান্তকে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, অন্য কোনো আইনের আওতায়ও বিচার করা যাবে না। যদিও এ আইনের আওতায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের জন্ম দিয়ে সমালোচিত হয় সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বাড়লেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে। ছয় দফা বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তার পরও প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও বঞ্চিত রয়েছে জ্বালানি খাত। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট ক্রশেই ঘনীভূত হয়ে আসছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য গতি নেই। উৎপাদন বাড়াতে বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানিকে কাজ দেয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। উৎসঃ bonikbarta Share on facebook Share on email Share on print 32

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন