শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

টিকফার ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ে ওষুধ শিল্প হাসান সোহেল : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে ওষুধ শিল্পখাত। কারণ, টিকফা চুক্তির একটা বড় প্রস্তাবনা হচ্ছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ স্বত্ব অধিকার (ট্রিপস) আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। তাই দোহা ঘোষণা ২০০১ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় ট্রিপস চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব বিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পায়। একই সঙ্গে এ সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রপ্তানি করতে পারছে। এমনকি প্রয়োজন হলে এ সময়সীমা আরও বাড়ানোর কথা ছিলো। কিন্তু ইতোমধ্যে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। এছাড়াও টিকফা চুক্তির কারণে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বড় ফার্মা কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স ব্যয়সহ উৎপাদন খরচ বাড়বে। দাম বাড়বে ওষুধের। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন আয়ের মানুষ। একই সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত চড়া দামের কারণে ওষুধের অভাবে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর আগে টিকফা স্বাক্ষর করা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই আশংকা করছেন তারা। একই সঙ্গে টিকফা’র ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের উপর যে সকল বিরূপ প্রভাব পড়বে তা হলো- মেধাস্বত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না। এই আইনের ফলে পেটেন্টেড ওষুধ বানাতে পারবে না বাংলাদেশ, ফলে বাংলাদেশের অনেক ওষুধ কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ওষুধ শিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। আমাদের কয়েকগুণ বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে। টিকফা চুক্তির কারণে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বড় ফার্মা কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে বড় ধরনের লোকসানের কবলে পড়বে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বাড়বে। এতে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র ওষুধ কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের ওষুধ শিল্প উদ্যোক্তা ডি-সিক্সটিন ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিনাকি ভট্টাচার্য বলেন, দোহা ঘোষণা ২০০১ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় ট্রিপস চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল তাও হারাতে হবে। কারণ টিকফায় সে ধরনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি বলে জানান তিনি। ট্রিপস চুক্তির ফলে নিশ্চিত ওষুধের দাম জ্যামিতিকহারে বাড়বে। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন আয়ের মানুষ। কেননা, দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত চড়া দামের কারণে ওষুধের অভাবে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে বলে জানান ওষুধ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও হাডসন ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম শফিউজ্জামান। তিনি টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করা ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, পেটেন্ট এর নামে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানি কিভাবে অবাধ লুণ্ঠনের ধান্দা করে এর মাধ্যমেই বোঝা যাবে। অনেক প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে এতদিনে আমাদের ফার্মা সেক্টর তাঁর ভিতটাকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এখন সময় সেই ভিত্তিটাকে মজবুত করার। আর এখন টিকফা বাস্তবায়ন হলে এতদিনের পরিশ্রমে গড়া আমাদের ফার্মা সেক্টর ধসে পড়বে বলে মনে করেন ওষুধ শিল্প সমিতির সদস্য ও ইউনিহেলথ-ইউনিমেড ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দেক হোসাইন। এম মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরের পরেই বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাত ফার্মা সেক্টর। বর্তমানে বাংলাদেশে ওষুধশিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার এ মুহূর্তে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। গার্মেন্টস সেক্টরের পরে এ সেক্টরেই কর্মসংস্থানও বেশি। এম মোসাদ্দেক জানান, আমাদের দৈনন্দিন এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধের শতকরা ৯৭ ভাগই আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোই প্রস্তুত করছে। এ সেক্টরে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি বলা যায়। কেবলমাত্র হরমোন, ভ্যাকসিন এবং এন্টি-ক্যান্সারসহ মাত্র ৩ শতাংশ ড্রাগ আমরা বাইরে থেকে আমদানি করে থাকি। আশার কথা হচ্ছে, কিছু কিছু দেশীয় কোম্পানি এই ওষুধগুলোও প্রস্তুত করা শুরু করেছে। একই সঙ্গে আমাদের দেশীয় ওষুধের গুণগতমান অনেক ভালো বলেই বিশ্বের ৮০টির অধিক দেশে আমাদের দেশীয় কোম্পানির তৈরি করা ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা সম্ভব হয়েছে ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ এবং দোহা ঘোষণা ২০০১ এর জন্য। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালের ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স এর মাধ্যমে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া মনোপলি বাণিজ্য থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশীয় শিল্প। দেশীয় কোম্পানিগুলো ক্রমান্বয়ে নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে সেসব বিদেশি কোম্পানিগুলোর জায়গা দখল করেছে। তাই অনেক প্রভাবশালী ফার্মা কোম্পানি বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ থেকে তাঁদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে। কোন কোন বিদেশি কোম্পানি টিকে থাকার স্বার্থে বাধ্য হয়েছে দেশীয় কোম্পানির সাথে বা অন্য আরও দুই তিনটি বিদেশি কোম্পানির সাথে একীভূত হতে। এ আইনের ফলেই দেশীয় কোম্পানিগুলো আমাদের ফার্মা সেক্টরকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। দোহা ঘোষণা ২০০১ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, এ সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রপ্তানি করতে পারছে। তিনি বলেন, এ সুযোগ পাওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই ওষুধ শিল্পে বহুদূর এগিয়ে গেছে। এ সুবিধার জন্যই বিদেশি পেটেন্ট করা ওষুধ আমরা অনেক কমমূল্যে দিতে পারছি মার্কেটে। দেশীয় কোম্পানিগুলোর কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলোও বাধ্য হচ্ছে ওষুধের দাম কমিয়ে বিক্রি করতে। এতে কম লাভ হলেও তাঁদের কোন লস হচ্ছে না। মেধাস্বত্ব বিষয়ক বিধিনিষেধ এর সময়সীমা ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর কথা রয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। তবে ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভাষণে ২০৩০ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ওষুধের পেটেন্ট আইনের আওতার বাইরে রাখার যে দাবি জানিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করা গেলে টিকফা ওষুধ শিল্পের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন