ওরা লাখপতি থেকে কোটিপতি
23 Dec, 2013
মহাজোট সরকার আমলের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী প্রায় সবাই কোটিপতি। গত নির্বাচনে তাদের অধিকাংশের সম্পদের পরিমাণ ছিল লাখ টাকার ঘরে। পাঁচ বছরে তা প্রায় কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো কারও কারও সম্পদ বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামাতে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের প্রায় প্রত্যেকেই ন্যূনতম কোটি টাকার সম্পদের বিবরণী জমা দিয়েছেন। প্রায় দেড় ডজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রবীণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নবীন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেশি। মন্ত্রীদের মধ্যে সম্পদ অর্জনে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। পাঁচ বছরে তার স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২ হাজার ২৯০ গুণ। এর বাইরে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১০৭ গুণ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইসিতে জমা দেয়া সম্পদের বিবরণী ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেয়া সম্পদের বিবরণীতে উঠে এসেছে এ চিত্র। পাঁচ বছর আগে নির্বাচন কমিশনে দেয়া ড. হাছান মাহমুদের সম্পদের বিবরণীতে দেখা যায়Ñ তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০ হাজার টাকা সমমূল্যের। তবে গত পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা সমমূল্যের। অর্থাৎ তার সম্পদ বৃদ্ধির হার ২ হাজার ২৯০ শতাংশ।
সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান নবম সংসদ নির্বাচনের আগে সম্পদের যে বিবরণী দিয়েছিলেন তাতে তার ১০ লাখ ৩৩ হাজার টাকা সমমূল্যের সম্পদ ছিল। এবারের বিবরণীতে সম্পদ প্রায় ১০৭ ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ কোটি ৩ লাখ টাকা সমমূল্যের। সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও যুবলীগের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানক এবার ইসিতে সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে তিনি ও তার স্ত্রীর আয় হয়েছে ৭ কোটি ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে তাদের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি ২৮ লাখ টাকার, যা নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ছিল ৯৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা সমমূল্যের। মহাজোট সরকারের মন্ত্রী আফসারুল আমিন পেশায় চিকিৎসক হলেও প্র্যাকটিস করেন না। রাজনীতি আর মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তার অবস্থান পাল্টে যায়। ২০০৮ সালে নির্বাচনে তিনি ও তার স্ত্রীর নামে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২৮ হাজার ৪৯২ টাকা। আর ২০১৩ সালে তা প্রায় ১৬ গুণ বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ টাকা। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ২০০৮ সালে আইন পেশা থেকে বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। দানসূত্রে তিনি মালিক হয়েছেন ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটের। নিজের ও স্ত্রীর নামে পোস্টাল ও সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ হয়েছে ১ কোটি ৮৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪২ টাকা। আগে এ ধরনের কোনো বিনিয়োগ ছিল না তার। আগে তারা ব্যাংকের কাছে কোনো ধরনের দায় না থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তার দায় রয়েছে ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ৪০৯ টাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপঙ্কর তালুকদারের বার্ষিক আয় এখন ৫৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। আয়ের উৎস ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া। ২০০৮ সালে এ আয় ছিল ৭ লাখ টাকা। প্রতিমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে নগদ অর্থের পরিমাণ ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে নগদ ৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং মোটরযানের দাম ৬৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে তার অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল মাত্র ৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। দীপঙ্কর তালুকদারের স্থাবর সম্পত্তির আর্থিক মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
গত পাঁচ বছরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পদের মধ্যে বহুগুণে বেড়েছে দালান-কোঠার মূল্য। ২০০৮ সালের হলফনামায় তিনি ৫২ একর কৃষি জমির হিসাব দিয়েছিলেন। ওই হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন ২৮ একর করে দুটি জমির ওপর চা বাগান, রাবার বাগান ও মৎস্য খামার রয়েছে তার। এবার দেয়া হলফনামায় জমিজমার এত বেশি হিসাব দেননি তিনি। এবারের হলফনামায় উল্লেখ করেছেন ১০ একর কৃষি জমির কথা। চা বাগান, রাবার বাগান ও মৎস্য খামারগুলোর উল্লেখ এবার নেই। এর বাইরে ৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূল্যের একটি দালান ও ৫৪ লাখ টাকা মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে তার। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অর্থমূল্য উল্লেখ করেছেন সর্বমোট ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার কিছু বেশি। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অর্থমূল্য ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকার বেশি। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অর্থমূল্য ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বেশি। পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ তুলনামূলক কম হলেও তিনিও কোটিপতি। তার মোট সম্পদের অর্থমূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকার কিছু বেশি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি। গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোঃ মোতাহার হোসেনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি। টাকার অঙ্কে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কোটিপতি নন। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের অর্থমূল্য মাত্র ৭৫ লাখ টাকার কিছু বেশি। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নগদ টাকার পরিমাণও মাত্র ৫৫ হাজার টাকা। প্রতি বছর ‘পেশা’ থেকে তিনি ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭০০ টাকা আয় করেন। সাংবাদিকতা, বর্তমানে এমপি ও মন্ত্রী হিসেবে বেতন-ভাতা এবং বই ও পত্রপত্রিকায় লিখে তিনি এ টাকা পান বলে উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। তবে তার নিজের নামে উত্তরায় ৫ কাঠা জমিসহ ২৫ তোলা স্বর্ণ আছে। হলফনামায় ৭৫ হাজার টাকা সমপরিমাণের আসবাবপত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জন করা সম্পূর্ণ বেআইনি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সংসদ সদস্য-রাজনীতিকসহ যেই হোক না কেন কেউ জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিবিধান থাকতে হবে। না হলে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না।
উৎসঃ আলোকিত বাংলাদেশ
Share on facebook Share on email Share on print 1
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন