রওশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজের নির্দেশ এরশাদের
16 Dec, 2013
'আমি নির্বাচনে নেই'—মুখে এমন কথা বললেও বাস্তবে নির্বাচনে পুরোদমে সক্রিয় জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তিনি। একইসঙ্গে স্ত্রী ও দলের জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি দলীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশ মেনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বণ্টনকৃত আসনসমূহে জাপা নেতারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। ওইসব আসনে দলীয় প্রার্থীদের জাপার নির্বাচনী প্রতীক 'লাঙ্গল' বরাদ্দ দেয়ার জন্য দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা বরাবরে দলের প্যাডে লিখিত চিঠি দিয়েছেন।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গতকাল রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় সিএমএইচে এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গে গওহর রিজভীর স্ত্রী-কন্যাও ছিলেন। সূত্র মতে, তারা সেখানে এরশাদের সঙ্গে নির্বাচন ও দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেন। গওহর পত্নী এরশাদকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। পুরো সময়ে এরশাদ ছিলেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে এবং হাসিখুশি।
অন্যদিকে, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের কথা বললেও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ গতকাল মন্ত্রিসভা কমিটির এক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির এই বৈঠকে যোগ দেন পানিসম্পদ মন্ত্রীর পদ থেকে 'পদত্যাগকারী' ব্যারিস্টার আনিস।
জাপা নেতাদের কয়েকজন ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এরশাদের এসব কার্যক্রমই প্রমাণ করছে তিনি ও তার দল নির্বাচনেই আছেন। এর বাইরে কোনো কোনো নেতা বিচ্ছিন্নভাবে এবং এরশাদের পক্ষে তার বিশেষ উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ গণমাধ্যমের কাছে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। জাপার নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে গতকাল কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রওশন এরশাদের সঙ্গে এরশাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। রওশন যা করছেন এবং তার সঙ্গে দলের নেতা ও প্রার্থীরা দফায় দফায় বৈঠক করে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, সবই হচ্ছে এরশাদের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী। সূত্রের দাবি, এরশাদের পরামর্শেই তার ভাই জিএম কাদের ও দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারসহ কেন্দ্রীয় সব নেতা শুক্রবার থেকে মিডিয়াকে এড়িয়ে চলছেন। তবে গতকাল সকালে এরশাদের সঙ্গে দেখা করার পর বিকালে রুহুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন 'অন্ধকার কেটে যাবে।'
রওশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার নির্দেশ :হাসপাতালে এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন-এমন একজন ইত্তেফাকের কাছে স্বীকার করেন, কৌশলে ঘোষিত তফসিলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে থাকার এবং এ লক্ষ্যে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রওশন এরশাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন এরশাদ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে—এরকম ৪৫-৬০টি আসনে এরশাদের পরামর্শেই জাপার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। এরশাদ, জিএম কাদের ও রুহুল আমিন হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিয়েছেন বললেও তাছিল কার্যত কৌশলগত। দলের ভেতর যারা 'এরশাদপন্থী' হিসেবে পরিচিত এরকম নেতারাও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। মূলত সমঝোতার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদেরই সিংহভাগ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যারা নির্বাচনে থেকে গেছেন তারা সবাই রওশনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। এছাড়া কোন আসনে জাপার কাকে রাখতে হবে, কোন আসনে জাপার কাকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করাতে হবে- গত তিনদিনে হাসপাতালে থেকেই সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে এসব নির্দেশনা দিচ্ছেন এরশাদ। বিশেষ করে দলের নেতা জিএম কাদের, রুহুল আমিন হাওলাদার ও নিজের ব্যক্তিগত সচিব মেজর (অব.) খালেদ আখতারের মাধ্যমে এসব নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি।
'লাঙ্গল' প্রতীক বরাদ্দ দিতে
জাপা মহাসচিবের চিঠি
যেসব আসনে জাপা প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি, তাদেরকে দলীয় প্রতীক 'লাঙ্গল' বরাদ্দ দিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দলীয় প্যাডে চিঠি দিয়েছেন জাপা মহাসচিব। এরকম কয়েকটি চিঠি ইত্তেফাকের কাছেও এসেছে। অন্যদিকে, যারা দলের নির্দেশ অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবে না, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন এরশাদ। তবে এরকম কারও বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং যারা কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে গেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন এরশাদ।
এরশাদ, রওশন, জিএম কাদের ও
হাওলাদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
এরশাদ তিনটি আসনেই, তার স্ত্রী রওশন একটিতে, ভাই জিএম কাদের দুটি আসনে এবং দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ১টি আসনে বৈধ প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন। 'লাঙ্গল' প্রতীকে তারা এখনও প্রার্থী। এমনকি তারা সকলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এছাড়া জাপা নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, মাইদুল ইসলাম, শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, নূরুল ইসলাম তালুকদার, নূরুল ইসলাম ওমর, সালাহউদ্দিন আহমেদ, লিয়াকত হোসেন খোকা, নাসিম ওসমান, পীর ফজলুর রহমান, সেলিম উদ্দিন, আব্দুল মুনিম চৌধুরী, আমির হোসেন, নূরুল ইসলাম, মোহাম্মদ নোমান ও মো. ইলিয়াছসহ অনেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে।
এরশাদের খাবার যায় বাসা থেকে
রাজধানীর বারিধারায় নিজ বাসা থেকে র্যাবের গাড়িতে করে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে সিএমএইচে ভর্তি হন এইচএম এরশাদ। ওই রাতেই তার সঙ্গে হাতপাতালে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করেন রুহুল আমিন হাওলাদার। বলা হচ্ছে এরশাদ 'অসুস্থ' এবং 'আটক'। তবে গত তিনদিনেই এরশাদের খাবার গেছে তার নিজের বারিধারার বাসা থেকে। এরশাদের ব্যক্তিগত স্টাফ ওহাব প্রতিদিন নাশতা ও খাবার নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন। জাপা চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতিদিনই কয়েকবার দেখা করছেন তার ব্যক্তিগত সচিব মেজর (অব.) খালেদ আখতার। এরশাদ সঙ্গে তার একাধিক মোবাইল ফোনও রেখেছেন। সাধারণত সেগুলো বন্ধ রাখেন, প্রয়োজনমত মোবাইল খুলে বিভিন্ন জনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন বলে তার ব্যক্তিগত একাধিক স্টাফ গতকাল ইত্তেফাককে নিশ্চিত করেন।
হাসপাতাল থেকেই সাংগঠনিক কার্যক্রম
জাপা মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার নিজেই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এরশাদ কিছুটা অসুস্থ, হাসপাতালে তার চিকিত্সা চলছে। তবে হাসপাতালে ভর্তির পরদিন থেকেই এরশাদ সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। তার বিশেষ উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, এরশাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। এসময় এক বিশেষ বার্তায় এরশাদ বলেছেন 'আমি অসুস্থ নই, গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে আমাকে চিকিত্সার কথা বলে হাসপাতালে আটকে রাখা হয়েছে।' শনিবারও ববি হাজ্জাজ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তার সঙ্গে এদিনও এরশাদের যোগাযোগ হয়েছে। এদিন এরশাদ তাকে বলেছেন 'তিনি নির্বাচনে নেই, তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা গ্রহণ করা হয়নি, সরকার জোর করে তাকে এমপি বানিয়ে দিচ্ছে।' শনিবার সকালে এরশাদের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করে সাংগঠনিক বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন জিএম কাদের ও রুহুল আমিন হাওলাদার।
গতকালও তারা দু'জন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জাপা চেয়ারম্যান গতকাল চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ও পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলনকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়াও জাপা চেয়ারম্যান গতকাল রংপুর জেলা ও মহানগরের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য করিম উদ্দিন ভরসাকে আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফাকে সদস্য সচিব করে রংপুর জেলা জাপার আহ্বায়ক কমিটি এবং আব্দুর রউফ মানিককে আহ্বায়ক ও এসএম ইয়াসিরকে সদস্য সচিব করে রংপুর মহানগর জাপার আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন। জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পার্টির চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারা মোতাবেক এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
আটকের পর ছাড়া পেলেন ববি হাজ্জাজ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন