মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৩
‘বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত আমেরিকা এক হয়ে যাবে’
13 Nov, 2013
একদলীয় নির্বাচন করে সরকার টিকতে পারবে না বলে মনে করেন প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকা ও ভারত শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় আসবে বলে তার বিশ্বাস। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির আগমনের কোন সম্ভাবনাও দেখছেন না প্রবীণ এ রাজনীতির গবেষক। মঙ্গলবার মানবজমিন-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায় সরকার একদলীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ওই সরকার বেশি দিন টিকতে পারেনি। শেখ হাসিনা একদলীয় নির্বাচন করে সরকার গঠন করলেও বেশি দিন টিকতে পারবেন না। আর ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশেও সমর্থন পাবে না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মেনে নেবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা নির্বাচন একটা করবেনই। আর ওই নির্বাচনের আগে প্রচুর সহিংসতা হবে। হরতাল হবে। ধর্মঘট হবে। সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসবে। বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন প্রতিরোধ করবে। তাদের সঙ্গে সাধারণ জনগণও যোগ দিতে পারে। ফলে দেশে আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারও সংবিধানের ব্যাখা দিয়েছিল। তারা নির্বাচন একটা করেছিলেন। কিন্তু টিকতে পারেননি। শেখ হাসিনা নির্বাচন একটা করলেও ১৯৯৬ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। জরিপে দেখা গেছে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। দেশী-বিদেশী সব জরিপই বলছে বেশির ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এটা আওয়ামী লীগের মেনে নেয়া উচিত। এটাই গণতন্ত্র। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করবেন। কিন্তু তার মনে রাখা উচিত তিনিই সংবিধান পরিবর্তন করেছেন। আর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনেই জয়লাভ করেছেন। প্রবীণ এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও জটিল হবে। হরতাল হচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে। এরজন্য দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দায়ী। এককভাবে কাউকে দায় দেয়া যাবে না। সার্বিক পরিস্থিতি উন্নতির জন্য বড় দু’দলেরই ছাড় দিতে হবে। অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, ১৯৯৬ সালেও এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তখন অস্ট্রেলিয়ার কূটনৈতিক স্যার স্টিফেন নিনিয়ান দু’দল থেকে ৫ জন করে সরকার গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে প্রস্তাব মেনে নেয়নি। বর্তমানে একই সমস্যা তৈরি হয়েছে। সারা দুনিয়ার কূটনৈতিকরা বাংলাদেশের দিকে নজর রাখছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীন, ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া গভীরভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছে। এটা করছে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে। সবারই এখানে বড় ধরনের স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি তাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পৃথিবীর সকল গণতন্ত্রকামী মানুষের বাংলাদেশের জনগণের প্রতি একটা সহানুভূতি রয়েছে। এখানে আবার সংঘাত-সংঘর্ষ হোক এটা কেউ চায় না। এজন্য তারা আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের ওপর জোর দিচ্ছে। অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আমেরিকা ও ভারত একমত হতে পারেনি। আমার বিশ্বাস একসময় আমেরিকা ও ভারত সমঝোতায় আসবে। এজন্য বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ঢাকা থেকে দিল্লি সেখান থেকে ওয়াশিংটনে দৌড়াদৌড়ি করছেন। এর মধ্যে একটা গুরুত্ব রয়েছে। কূটনীনিতকরা তাদের দায়িত্ব থেকেই এটা করছেন। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, ভারত ইতিমধ্যে একটা লিখিত বক্তব্য দিয়েছে। সেখানে অবাধ-সুষ্ঠু ও সংলাপের কথা বলা হয়েছে। এটা যদি ভারতের সঠিক বক্তব্য হয় তাহলে বুঝতে হবে তারা আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। কিন্তু এটাও সত্য শেখ হাসিনা ভারতকে সম্ভাব্য সব সুযোগ-সুবিধাই দিয়েছেন। ভারত তার পক্ষে অবস্থান নেবে এটা স্বাভাবিক। প্রতৃতপক্ষে ভারতের অবস্থান কি তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এটাও ঠিক ভারত অন্ধভাবে কাউকে সমর্থন দেবে না। প্রবীণ এ অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হোক তা ভারত কখনওই চাইবে না। এটা তাদের জন্য কল্যাণকরও নয়।
মন্ত্রীদের পদত্যাগ ও সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কেউ পদত্যাগ করলেই পদটি শূন্য হয়ে যাবে। এটা গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সরকার এ নিয়ে বিতর্ক করেছে। বিএনপি বলছে তারা সর্বদলীয় সরকারে যোগ দেবেন না। তাহলে এটাকে তো সর্বদলীয় সরকার বলা যাবে না। এটা হবে মূলত ১৪ দলীয় সরকার। একে বলতে হবে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণাধীন সরকার। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, এখন অনেকে প্রশ্ন করছেন আবার কি বাকশাল ফিরে আসছে, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে কাগজে-কলমে বাকশাল করা আর সম্ভব নয়। অনেকে বলছেন, শেখ হাসিনা নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। ক্ষমতা চলে গেলে সব বিপদ তার গাড়ে চাপতে পারে। এটা নিয়ে তিনি চিন্তিত। এজন্য তিনি আবার ক্ষমতায় থাকতে চান। এজন্য তিনি একদলীয় সরকারের দিকে হাঁটছেন। এটা করে তেমন লাভ হবে না। একদলীয় নির্বাচন করে আওয়ামী লীগও বেশি দিন টিকতে পারবে না। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমানে আমি তৃতীয় শক্তির লক্ষণ দেখছি না। তৃতীয় শক্তি সাধারণত রাজনৈতিক নেতাদের মৌন সমর্থন নিয়ে আসে। বর্তমানে সে ধরনের কোন লক্ষণ নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সবাই নির্বাচন চায়। সমস্যা হচ্ছে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, নিজেদের সমস্যা নিজেরাই আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। দুই নেতার ফোনালাপের মধ্যে দিয়ে একটা শুভ সূচনা শুরু হয়েছিল। এটা সরকারই নষ্ট করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতাকে দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি হরতালের মধ্যে যেতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বলেছেন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা উচিত ছিল। সরকারই উদ্যোগটা নষ্ট করে দিয়েছে। এখনও সময় আছে আলাপ-আলোচনা করার। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে সরকার নতুন করে সঙ্কট তৈরি করেছে। তারা একদিকে সংলাপের কথা বলছে অন্যদিকে হার্ড লাইনে যাচ্ছে। এটা করে মানুষের সমর্থন হারাচ্ছে। খালেদা জিয়ার বাসায় পানির লাইন বন্ধ করে সরকার নিকৃষ্ট কাজ করেছে বলে মনে করে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, এখন অনেকেই বলছে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সরকারের ন্যূনতম দূরদর্শিতা থাকলে তারা এটা করবেন না। তাহলে জনগণের সমস্ত সহানূভূতি খালেদা জিয়ার প্রতি চলে যাবে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকার শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অনেক অত্যাচার করেছে। ইউনূসের বিশ্বব্যাপী সুনাম ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এজন্য আমেরিকা আওয়ামী লীগের ওপর কিছুটা বিরক্ত। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, দু’নেত্রীর ফোনালাপের পর দেশের মানুষ অনেক আশাবাদী হয়েছিল। মনে হয় একটা সমাধান হবে। কিন্তু তাদের আশা অনেকটা ভেস্তে গেছে। এখন সাধারণ মানুষের অবস্থান অনেকটা এরকম ‘আশার আলো শেষ হচ্ছে তবু আমরা আশাবাদী’ অর্থাৎ Hope against hope। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বলেন, জাতিসংঘ দু’দলকেই অধিবেশনে লোক পাঠানোর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু কোন দলই প্রতিনিধি পাঠায়নি। পাঠালে হয়তো একটা সমাধান বেরিয়ে আসতো। জাতিসংঘ সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করছে বলে মনে করেন প্রবীণ এ গবেষক। অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের লোকজন এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারাও এখন হামলার শিকার হচ্ছেন। উল্লেখ্য, এর আগে তিনি মানবজমিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন জাতিসংঘ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে পারে। ৬ই আগস্ট তার ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ২৩শে আগস্ট জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করে সংলাপে বসার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করে ২০০৬ সালে অবসর নেন। পড়িয়েছেন বিশ্বের অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার লেখা বই সারা দুনিয়ার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। The Security of Small States in the Third World, Military Withdrawal from Politics: A Comparative Study তার বিখ্যাত গ্রন্থ। অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান ১৯৩৮ সালের ১লা জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Political Development in Pakistan শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য ১৯৬৬ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৫৯ সালে অনার্স ও ১৯৬০ সালে মাস্টার্স পাস করেন। তিনি Cambridge Encyclopedia of India, Pakistan, Bangladesh, Srilanka, Nepal, Bhutan, Maldives-এর উপদেষ্টা সম্পাদক।
উৎসঃ মানবজমিন
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন