শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৩
খোলা আকাশের নিচে প্রশ্রাব-পায়খানা ও ইন্ডিয়ান সংস্কৃতি!
২২ নভেম্বর,২০১৩
13
আলাউদ্দীন মোহাম্মদ
ইন্ডিয়া’র কেন্দ্রীয় রাজধানী নিউ দিল্লী’র ঝকঝকে রাস্তায় নতুন নতুন চলতে গেলে একটি বিষয় দেখে আপনার চোখ আটকে যাবেই। অটোওয়ালা, মোটরবাইকার, প্রাইভেট গাড়ি’র চালক, প্রাইভেট গাড়ির যাত্রী থেকে শুরু করে মার্সিডিজ থামিয়েও যদি কোন ভদ্রলোক রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে শুরু করে তাহলে যেন আপনি ভড়কে না উঠেন! ওদের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকাবেন না যেন! এখানে কেউ ওদের দিকে তাকায় না! এটাই এখানকার কালচার যেটা পর্যবেক্ষণ করে অর্থনৈতিক দার্শনিক অমর্ত্য সেন দুঃখ করে বলেছিলেন ‘ইন্ডিয়ার মেট্রোপলিগুলোতে যে হারে কন্ডোমিনিয়াম গড়ে উঠছে তার সিকিভাগ হারেও যদি গণশৌচাগার গড়ে উঠত!’
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে ইন্ডিয়া যে এগিয়ে যাচ্ছে বলে একটা ধোঁয়া উঠছে অর্থনৈতিক দুনিয়ায় যারা আবার ‘ব্রিক্স’ নামের অর্থনৈতিক জোট গঠন করে সেটার ঢাকও পেটাচ্ছে সে উন্নয়নের নমুনা কই? সেটা কি শুধু বলিউড, বার আর শহরের রাস্তায় সাড়ি উঁচা উঁচা ফ্লাইওভার? সেটাই উন্নয়ন কিনা সে প্রশ্নের সমাধান অবশ্য আগেই হয়ে গিয়েছে। একটা সময় উন্নয়নের সূচক ছিল মোটা দাগে মাথাপিছু উৎপাদন কিংবা আয়ের পরিমাণ কত এবং এই আয় কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটার হিসেব-নিকেষ। মানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়া মানেই উন্নয়ন। সেটা উন্নয়নচিন্তায় অনেক দশক ধরে বিরাজ করলেও গত ৩-৪ দশকে সে চিন্তায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।
১৯৭০ সালের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ‘কর্মসংস্থান প্রকল্প’ থেকে শুরু করে দারিদ্র ও বৈষম্য দূরীকরণ, মৌলিক চাহিদা এবং সবশেষে অমর্ত্য সেনের ‘সক্ষমতা’র গবেষণা থেকে পাকিস্তানের মাহবুবুল হকের হাত ধরে সেই ১৯৯০ এর দিকে প্রথম যে মানব উন্নয়ন সূচক প্রকাশ করা হয় যেখানে উন্নয়নকে মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে বিষয়গুলোতে উন্নয়ন দরকার সে নিরিখে উন্নয়ন দেখা শুরু হয় সেটাই এখন পর্যন্ত সর্বাধিক স্বীকৃত উন্নয়নের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
আর এই মানব উন্নয়নের তিনটি সূচক হল শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন, সাস্থ্যক্ষেত্রে অর্জন এবং মাথাপিছু গড় আয়ের সাধারণ গড়। এই শিক্ষাক্ষেত্রের অর্জন দেখা হয় গড় শিক্ষাজীবন এবং প্রত্যাশিত শিক্ষাজীবনের সমন্বয়ে, আর স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অর্জন গড় প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল এবং মাথাপিছু আয় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মাথাপিছু আয়ের আপেক্ষিক বিচারে। তো এই সময়ে উন্নয়ন মানেই হল, এই সূচকগুলোতে অগ্রগতি। এই প্রবন্ধের বিষয় অবশ্য উন্নয়ন চিন্তার আলোচনা নয়। এটা সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টের তথ্যের আলোকে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া’র অর্থনীতির দ্বৈত রূপ কিংবা এর দর্শনের দিকে একটু হালকা নজরমাত্র।
‘স্লামডগ মিলিনিয়ারে’ হয়তো অনেকেই দেখে থেকেছেন শিশুশিল্পী’র মলের জলে পবিত্র হয়ে তার প্রিয় বলিউড তারকার সাক্ষাৎ লাভের চিত্রটি। এটা শুধু একটি চলচ্চিত্রেরই দৃশ্য নয়। এটা যেন ইন্ডিয়ার এক প্রান্তে আয়েশ করে গড়ে উঠা ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’ আরেক প্রান্তে এর প্রতি ‘স্লামডগ’দের ইনক্রেডিবল সম্মোহন। প্রায় সোয়াশ’ কোটি মানুষের দেশ ভারতে অর্ধেকেরও বেশি মানুষই এই মলজলে (মলজল না হলেও মল-হাওয়া তো বলাই যায়) সিক্ত হওয়ার কাজটি প্রতিদিন সম্পন্ন করে থাকেন পরম আরামপ্রিয়তায় খোলা আকাশের নিচে! প্রশ্ন হল, ইন্ডিয়ার অর্থনীতি যেভাবে বিগত দুই দশক ধরে প্রবৃদ্ধির সূচকে দৌড়াচ্ছে সেখানে কেন এখনো দেশের এত মানুষকে খোলা আকাশের নিচেই শৌচাগারের কাজ সারতে হচ্ছে? এটা কি ইন্ডিয়ার উন্নয়ন দর্শনের কোন সমস্যা নাকি তার সংস্কৃতির মজ্জাতেই লুকিয়ে আছে এ রোগ তা ভাবিয়ে তুলছে স্বয়ং রিপোর্ট প্রকাশক বিশ্ব ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক-গবেষকগণদেরও। অবশ্য দিল্লীর পথে-ঘাটে মধ্যবিত্তের বিষয়টি যে অর্থনৈতিক কারণেরও বাইরের কিছু সেটা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়!
বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গোটা দুনিয়ায় আড়াইশ’ কোটিরও বেশি মানুষের কোনো শৌচাগার নেই। আর তার মধ্যে একশো কোটিকেই মলত্যাগ করতে হয় চার দেয়ালের বাইরে। আর এদের মধ্যে অন্তত ষাট কোটিই ভারতে, যা সে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ! আরআরইউনিসেফের সাম্প্রতিক রিপোর্টে নেপালের ক্ষেত্রে এই হার ৪৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৪ শতাংশ। শৌচাগারের অভাবে বাইরে মলত্যাগ করতে যেতে হচ্ছে এটা তো এই দুনিয়ায় আর শুধু ভদ্রলোকী সমস্যা নয় এ সমস্যা ডেকে নিয়ে আনছে বিভিন্ন পানি ও বায়ুবাহিত রোগসহ শিশুমৃত্যুর। আর এ সমস্যার মূল যে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা কিংবা আয়ের বিস্তার নয় তা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, সুস্নাত চৌধুরী যিনি দেখিয়েছেন, ‘ভারতে ধনী-দরিদ্র, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সর্বোপরি স্যানিটেশনের প্রতি অনীহা এর পেছনের অর্থনৈতিক কারণকে প্রধান সমস্যা বলে প্রমাণ করে না বরং এটা সমাজের মধ্যে এস্টাব্লিসড একটা কালচারকেই নির্দেশ করে যে কারণে দেখা যায় জরিমানার ভয় দেখিয়ে কিংবা দেব-দেবীর ছবিওয়ালা টাইলস লাগিয়ে টয়লেট ব্যবহার করতে বাধ্য করতে হয়।’
আর ‘ওয়াটার এইডে’র প্রতিবেদন মতে- ‘Religious and societal mindsets have further aggravated the situation।’ এই গবেষক বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন, ‘দেশের প্রত্যন্ত এক জেলার চাষীর হাতে ফসল বেচে কিছু টাকা এলে তিনি হয়তো বাড়িতে শৌচাগার বানানোর আগে একটা রঙিন টিভি কেনার কথাই ভাববেন। তার কারণ আর কিছুই নয়, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যাওয়াটাই এসব মানুষের অভ্যাস আর বহু বছরের সেই অভ্যাসটা পাল্টানো খুব কঠিন।’
আর ইন্ডিয়া জুড়ে যে বিতর্কটা রাজনৈতিক মহলেও প্রচলিত সেটা হল, ‘শৌচালয় না দেবালয়, শেষ বিচারে প্রতিধ্বনিত হয় দেবালয়, দেবালয়’। রাজনৈতিকভাবে হয়তো দেবালয় প্রতিষ্ঠাতেই ফায়দা বেশি কিংবা জনগণ দেবালয়ে প্রবেশের জন্য শৌচালয়ের প্রয়োজনটা খুব একটা বোধ করেন না।
এটা সত্য যে স্যানিটেশন বিষয়টার সাথে সংস্কৃতির একটা বিরাট সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ করার গড় হার শতকরা ৪ শতাংশ হলেও দেখা যায় অঞ্চলভেদে অর্থনৈতিক ব্যবধান আমলে না নিয়েও এই হারের ভিন্নতা রয়েছে। এক গবেষক বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ জেলার একটি উপজেলার সাথে দক্ষিণাঞ্চলের একটি উপজেলার স্যানিটেশন নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন অর্থনৈতিক বিচারে খুব বেশি দূরত্বে অবস্থান না করলেও শেষোক্ত জেলাটির সাথে পূর্বোক্ত জেলাটার ব্যবধান বিস্তর মাত্রার প্রায় ২৩ শতাংশই বটে।
কেন এই শৌচালয় বিমুখতা? বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিভিন্ন কারণ খোঁজা গেলেও আমি এখানে সুস্নাত চৌধুরীর গবেষণার ফলাফলেই সীমাবদ্ধ থাকব আর বেশি যেটা যোগ করব সেটা হল এই সাংস্কৃতিক কারণটা কীভাবে বিবর্তিত কিংবা পরিবর্তিত হতে পারে। এর জন্য খুব দূরে যেতে চাই না বরং প্রথমই তাকাতে চাই, বাংলাদেশের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থার দিকে। এই তুলনার প্রথম কারণ হলো, পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সমাজের অতীত সাংস্কৃতিক সাযুজ্যতা এবং দ্বিতীয়ত পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি অর্থনৈতিক অবস্থা যদিও সংখ্যাতাত্বিক বিচারে এর প্রমাণ পাওয়া খুব সরল হবে না যদিও কিন্তু ভারতবর্ষের এককালের রাজধানী এবং হালের প্রথম সারির মেট্রোপলিটন সিটির রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের তুলনা খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশিত। আর এই তুলনার উদ্দেশ্যে হল ভাষা- সংস্কৃতি ও জীবন-যাত্রার অদূর অতীতের অভিন্নতা এবং ইতিহাসের একটি বাকে মূলত ধর্মবিশ্বাস ও ফিউডাল সোসাইটির জটিল হিসেবের মারপ্যাঁচে এর বিভাজন এবং বিভাজনোত্তর এই দুই অংশের সমাজব্যবস্থার মানসিক পরিবর্তন কিংবা সাদামাটাভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারণার সাথে এই মলত্যাগের সংস্কৃতি কিংবা জীবনপ্রণালীর কোন সম্পর্ক আছে কিনা সে ‘হাইপোথিসিস’ উত্থাপন করা।
তো ২০১২ সালের ইন্ডিয়ার সেন্সাসে’র তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ৩৮.৬ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে থাকে আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ৪ শতাংশ। এই হাইপোথিসিসে কিন্তু আমি অর্থনৈতিক অবস্থা এবং রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়টা অস্বীকার করছি না শুধু বিকল্প কারণটির প্রভাব পাশাপাশি দুইটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কি ভূমিকা রেখেছে সেটার অস্বিত্ব খুঁজে দেখার চেষ্টা এবং সেক্ষেত্রে প্রথমেই দেখতে হবে বাংলাদেশের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিরূপ দূরত্ব বেড়েছে এবং এই সাংস্কৃতিক দূরত্বের মূলসূত্র কী? আমি মনে করি এই দূরত্বের সূত্র নির্ধারণের মাধ্যমেই অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল এবং ভারতের চেয়ে মাথাপিছু আয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দরিদ্র হওয়া স্বত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশেষ এই ক্ষেত্রের অর্জনকে ব্যখ্যা করা যাবে। সুস্নাত চৌধুরীর গবেষণালব্ধ ফল অন্তত আমাদের সেই ইঙ্গিতটাই দেয়।
আলাউদ্দীন মোহাম্মদ, কবি ও প্রাবন্ধিক
alauddin0112@gmail.com
(প্রকাশিত মত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে rtnn.net -এর সম্পাদকীয় অবস্থানের কোনো মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। লেখকের বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে rtnn.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।)
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন