শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৩
বাংলাদেশের সমকামীতা নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন!
16 Nov, 2013
বাংলাদেশে সমকামিতা: এখনো পর্দার আড়ালে
ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন সুমন ও পলাশ।
এখানে তাদের আসল নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।
চার বছর আগে তাদের বন্ধুত্ব হয়, এবং তারা এক সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
সুন্দর করে গোছানো পরিপাটি একটা একটা সংসার।
সুমন বলছিলেন এর আগেও তার আরেকটি ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল।
সেই সম্পর্কের ভাঙ্গনের পর তিনি বর্তমানে পলাশের সাথে আছেন।
সুমন বলছিলেন, সমকামীরা একটা সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে চায়। যেহেতু তারা সম্পর্কটা চালিয়ে যেতে পারে না তাই তারা আরেকটা সম্পর্কে জড়ায়।
''প্রথমে আমার একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল বারো বছর।পরে আমি একটা সম্পর্কে জড়িয়েছি। জানিনা এটা কতদিন চালিয়ে যেতে পারবো। কারণ সমাজ আমাদেরকে সে সুযোগটা দেয় না,'' সুমন বলেন।
সুমনের পরিবার তার এই পরুষের প্রতি আকর্ষণের কথা জানেন।
এবং পরিবারের মানুষরা এটা মেনে না নেওয়াতেই তিনি আলাদা বাসা নিয়ে থাকেন।
আর সুমনের সঙ্গী তার বাবা মায়ের সাথে সপ্তাহের ৫ টি দিন থাকেন আর বাকি দুটি দিনে বন্ধুদের সাথে থাকবেন বলে সুমনের কাছে থাকেন।
সমকামি
বয়েস অব বাংলাদেশের প্রতিনিধি তানভীর আলীম
"আমরা চাচ্ছি সমাজ যেন আমাদেরকে স্বীকৃতি দেয় এবং দেশের আইন সংশোধন করা হয়"
তানভীর আলিম
কারণ পলাশ তার পরিবারের কাছে কথা গুলো বলতে পারেননি।
চট্টগ্রামে ছেলে আরিফ বলছিলেন যখন তিনি স্কুলে পরেন তখনি তিনি তার নিজের মধ্যেকার পরিবর্তন গুলো টের পান।
“প্রথমে সবাই আমার বাবাকে নালিশ করতো। আমার বাবা ওদেরকে বলতেন বয়সের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে,'' আরিফ বলেন।
আরিফের পরবর্তীতে সম্পর্কের হয় তার বাবার এক বন্ধুর সাথে। দীর্ঘদিন তিনি আরিফের পড়াশোনা সহ সব খরচ বহন করেন।
আরিফ বলছিলেন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ থাকলে বাবার ঔ বন্ধুর প্রতি তিনি কোন মানসিক টান বা ভালোবাসা বোধ করতে না।
পরে তার সম্পর্ক হয় তার স্কুলের এক বন্ধুর সাথে। দীর্ঘদিন তার সাথেই চলে তার সম্পর্ক।
তবে বন্ধুটি এক সময় পরিবার ও সমাজের চাপে বিয়ে করেন একটি মেয়েকে। এর পর থেকেই আরিফ একা।
সমকামী পুরুষদের সংগঠন
শুধু ছেলেরাই যে ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তাই নয় মেয়েরাও মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং সম্পর্ক তৈরি করছে।
এমন বেশ কিছু মেয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে কিন্তু তারা এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি নন।
বাংলাদেশে সমকামী পুরুষ বা যাদেরকে গে বলা হয় তাদের সমাজে এখন যতটা খোলামেলা ভাবে প্রকাশ হতে দেখা যাচ্ছে মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টা অনেকটাই চাপা পরে আছে।
কয়েকজন সমকামী পুরুষ মিলে 'বয়েস অফ বা্ংলাদেশ' নামে অনলাইনে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে।
সমকামি
বয়েস অব বাংলাদেশের দশ বছর
"প্রথমে সবাই আমার বাবাকে নালিশ করতো। আমার বাবা ওদেরকে বলতেন বয়সের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে"
আরিফ
এগারো বছর আগে তৈরি করা এই ওয়েবসাইটটি জন্য তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
'বয়েস অফ বাংলাদেশ' বা বব এর একজন প্রতিনিধি তানভীর আলিম বলছিলেন, এর মাধ্যমে অনেকেই এখন তাদের সঙ্গী খুঁজে নিচ্ছেন আর বব কাজ করছে বাংলাদেশের এই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ও অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে।
''আট বছর আগে, ২০০৫ সালে একটা একটা গেট টুগেদারের ব্যবস্থা করা হয়, সেখানে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়,'' বলেন মি: আলিম, যিনি নিজেও একজন সমকামী পুরুষ।
সেখান থেকে তারা সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজমের পথ বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নেন।
''এখন আমরা চাচ্ছি সমাজ যেন আমাদের কে স্বীকৃতি দেয়, এবং বাংলাদেশের আইনেও আমাদের সম্পর্কে যা বলা আছে সেটা যাতে সংশোধন করা হয়,'' মি:আলিম বলেন।
তানভীর বলছিলেন এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুকে 'বয়েস অফ বাংলাদেশ'এর পেইজও রয়েছে।
ফেইসবুকে তাদেরকে ফলো করেন দুহাজারের মত মানুষ।
এছাড়া মাঝে তারা কিছু অনুষ্ঠান করেন সেখানে দু থেকে আড়াইশ মানুষ আসেন।
এদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন বয়স এবং পেশার ছেলেরা রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আইনে দণ্ডনীয়
সমকামি
মাঝে মাঝে তারা অনুষ্ঠান করে দেখা করেন
"বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে এটাকে অস্বাভাবিক অপরাধ হিসেবে গন্য করা হয়েছে"
সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী সানায়ইয়া আনসারী
কিন্তু তানভীর যে তাদের যে অধিকার বা স্বীকৃতির কথা বললেন সেবিষয়ে বাংলাদেশের আইনে কি বলা আছে।
সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী সানায়ইয়া আনসারীর বলছেন, যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে আইনের চোখে সবাই সমান এবং সমানভাবে আশ্রয় লাভের অধিকারী, কিন্তু সমকামিদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে।
''বাংলাদেশের আইনে পরিষ্কার ভাবে বলা আছে সম লিঙ্গের কোন মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা অস্বাভাবিক একটি অপরাধ,'' তিনি বলেন।
সমকামিতার জন্য ১০ বছর কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে বলে সানয়ইয়া আনসারী জানান।
তিনি বলেন, যে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে বলা আছে বর্ণ, ধর্ম, গোত্র বা জন্ম স্থানভেদে কারও সাথে বৈষম্য করা যাবে না।
তবে বাংলাদেশের দণ্ডবিধি আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছাকৃত ভাবে প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে পুরুষ পুরুষের সাথে, এবং নারী নারীর সাথে যদি কোন যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তিনি অপরাধী হবেন।
''বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে এটাকে অস্বাভাবিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে,'' তিনি বলেন।
কারণ নিয়ে বিতর্ক
একটা পুরুষের সাথে পুরুষের বা একটি মেয়ের সাথে মেয়ের মানসিক ও শারীরিক আকর্ষণবোধকেই সাধারণ অর্থে সমকামীতা হিসেবে ধরা হয়।
তবে কোন পুরুষ বা নারী সমকামী হয়, তা নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক রয়েছে।
নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রচলিত যে সম্পর্ক তার বাইরে এই ধরনের আকাঙ্ক্ষা কি একটি মানুষের বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু হয়, না তারা জন্মগত ভাবে এই বৈশিষ্ট্য নিয়েই জন্মায়?
এসব জানতে আমি কথা বলছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক শাহনুর হোসেনের সাথে।
মি. হোসেন বলছিলেন, একটা বয়সের পর যখন তারা দেখে তাদের অন্য বন্ধুরা মেয়েদের ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করছে, তখন তাদের ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা।
তারা ছেলেদের ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করে।
"এটা জন্মগত, না হরমোনাল, না মানসিক সেটা বলা কঠিন"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক শাহনুর হোসেন
''তবে এটা জন্মগত, না হরমোনাল, না মানসিক সেটা বলা কঠিন,'' মি: হোসেন বলেন।
চরম হতাশা
আমার আরেকজন সমকামী পুরুষের সাথে কথা হল যিনি ছোট বেলা থেকেই বুঝতে পারছিলেন তার পরিবর্তন গুলোর কথা।
যখন বুঝতে পারলেন তিনি অন্যান্য ছেলেদের থেকে আলাদা তখন নিমজ্জিত হলেন চরম হতাশায়।
কাছের বন্ধু, বাবা-মা, বা পরিবারের কোন সদস্যের, কারও কাছেই তিনি আজও বলতে পারেননি তার এই পুরুষের প্রতি আকর্ষণের কথা।
ছেলেটি বলছিলেন সবচেয়ে কাছের বন্ধুর কাছে শুধু মাত্র সমকামীতা বিষয়ে আলোচনা করতে যেয়েই তাকে শুনতে হয়েছে নেতিবাচক কথা।
ছেলেটি বলছিলেন, বিষয়টি কেও সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে চাননা।
যখন জানতে পারেন তখন তার প্রতিক্রিয়াটা খুব নেতিবাচক থাকে। অনেক সমস্যার মুখে পরতে হয়।
''আমি গে,'' তিনি বললেন।
''তবে আমার খুব কাছের একটা বন্ধুর কাছে শুধু মাত্র সমকামিতার বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে গেলে সে আমাকে অনেক খারাপ কথা শুনায়,'' তিনি বলেন।
পরে তার আর সাহস হয়নি তকে ব্যাপারটা সরাসরি বলার।
"আমি যে গে এটা আজ পর্যন্ত আমি কাওকে বলতে পারিনি"
সমকামি একজন ছেলে
''আমাদের অনুভূতিটা কেও বোঝার চেষ্টা করে না, সে ফ্যামিলি হোক বা বন্ধুরা হোক। তাই আমি আজও কাওকে বলিনি,'' তিনি বলেন
বাংলাদেশের সমকামিদের নিয়ে অল্প বিস্তর কাজ করছেন বেসরকারি কিছু সংস্থা।
মূলত তাদের স্বাস্থ্যের দিক বা এইডস প্রতিরোধে তাদের কাজ বেশি ।
সংস্থাগুলো বলছে যৌন প্রবণতার ব্যাপারে বাংলাদেশে খোলাখুলি কথা বলাটা সহজ না হওয়াই তাদের কাছে এর সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই।
তবে বলা হয় একটি দেশের ১০ শতাংশ মানুষ প্রচলিত যৌনকর্মের বাইরে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।
বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় তাই আরিফ বা পলাশের মত গুটি কয়েক জন পরিবারের বাইরে এসে নিজেদের মত করে বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে নিলেও অন্যদের পথ ততটা সহজ নয়।
উৎসঃ বিবিসি বাংলা
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন