শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৩
ফিরে দেখা : হরতালে মানুষের দুঃখ-কষ্ট হয়; কিন্তু এছাড়া আমাদের করার কী আছে -শেখ হাসিনা : তত্ত্বাবধায়ক দাবিতে হাসিনার হরতাল অবরোধ অসহযোগ ও গণকারফিউ
জাকির হোসেন
« আগের সংবাদ
107
পরের সংবাদ»
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিলেও এক সময় তিনিই বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিরোধী দলবিহীন কোনো নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না। নির্বাচনের নামে যে কোনো প্রহসনের নির্বাচন জনগণ প্রতিরোধ করবে। একইসঙ্গে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে
তুলেছিলেন। এই তিন দলের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস এবং বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সপথ নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাফল্য কামনা করে বলেছিলেন, জনগণের অপরিসীম ত্যাগ ও তিন দলের আন্দোলনের ফলে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। বাঙালি জাতি আর একবার প্রমাণ করেছে—জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে কোনো স্বৈরাচারী শক্তি টিকে থাকতে পারে না। ন্যায্য ও সত্যের সংগ্রাম সব সময় জয়ী হয়।
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ও অন্যান্য দাবিতে ’৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগের কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ৯৬ দিন হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ কর্মসূচি পালন করে। এই ৯৬ দিনের মধ্যে ৭০ দিন হরতাল, অবরোধ এবং ২৬ দিন অসহযোগ। এসব কর্মসূচিতে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পাশাপাশি একটি লাগাতার ৯৬ ঘন্টা, দুটি ৭২ ঘণ্টা এবং ৫টি ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডাকা হয়। আর ২৬ দিনের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যে লাগাতার পালিত হয় ২২ দিন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টার্গেট করে হরতালের কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত। এক্ষেত্রে ’৯৬ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেখানেই নির্বাচনী সফরে যান, সে জেলাতেই হরতাল ডাকা হয়। বিরোধী দলগুলোর জাতীয় ও আঞ্চলিকভাবে ডাকা এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাংচুর, বোমাবাজি, ককটেল নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এসব সহিংসতায় নিহত হয় শতাধিক মানুষ; আহত হয় সহস্রাধিক। ’৯৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শুধুমাত্র ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের দিন হরতাল ও গণকারফিউ কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত এবং আহত হয় আরো ছয় শতাধিক মানুষ’।
এদিকে বিরোধী দলগুলোর হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পিকেটিংয়ে অংশ নেন। তারা হলেন—আওয়ামী লীগের জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, কাজী জাফর আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী ফিরোজ রশীদ, জামায়াতে ইসলামীর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ প্রমুখ।
অন্যদিকে ’৯৬ সালের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আয়োজিত এক জনসভায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভেবেছেন রোজার মাসে হরতাল হবে না। ইচ্ছেমত ভোট চুরি করে একদলীয় নির্বাচন করিয়ে নেবেন। কিন্তু তিনি জানেন না রোজার মাসেও যুদ্ধ হয়েছিল। আর লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে ১৯৯৫ সালের ১৮ অক্টোবর ফার্মগেটের এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, এ সরকার হরতাল ছাড়া আন্দোলনের কোনো ভাষা বোঝে না। হরতালে মানুষের দুুঃখ-কষ্ট হয়। কিন্তু এছাড়া আমাদের করারইবা কি আছে? এদিকে লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমেদ এক সমাবেশে বলেন, ৯৬ ঘণ্টা হরতাল রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এত কিছুর পরও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভুলেই গেছেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। গত ১১ মে দলের বানানীর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এইচএম এরশাদ বলেন, আমরা কোনোদিনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে ছিলাম না। আমরা মনে করি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হলো রাজনীতিবিদদের কপালে কলঙ্কের তিলক। এই কলঙ্ক আমরা মুছে দিতে চাই। তাই আদালতের রায়কে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।
এসব ঘটনা ওই সময়ের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে দৈনিক ইনকিলাব-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এবং ’৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির অভিন্ন কর্মসূচি হিসেবে পালিত হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ বিষয়ে দৈনিক আমার দেশ-এর গবেষণা ইউনিটের কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো :
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না—শেখ হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার
মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় গতকাল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিরোধী দলবিহীন কোনো নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না। নির্বাচনের নামে যে কোনো প্রহসনের নির্বাচন জনগণ প্রতিরোধ করবে। আমি একটি অর্থবহ নির্বাচন চাই।
তিনি বলেন, এক ব্যক্তির ক্ষমতার মোহই দেশকে সংঘাত ও সন্ত্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভোট চুরি আমরা বরদাশত করতে পারি না। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছি। এই দাবি মেনে না নিয়ে যদি দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তবে তার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। দাবি না মানলে প্রধানমন্ত্রীর যে পরিণতি হবে, তার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী থাকবে না। শেখ হাসিনা আজকের অবরোধ কর্মসূচি ও আগামী ৩ ও ৪ জানুয়ারি ৪৮ ঘণ্টার হরতালকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, দাবি আদায় না করে ঘরে ফিরবেন না। সবাই মাঠে নেমে পড়ুন, যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন।...
তিনি বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কেউ যদি মোনাফেকি করে সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে যায়, তবে তার সম্পর্কে আপনারা যা খুশি তাই ব্যবস্থা নেবেন। ...শেখ হাসিনা বিরোধী দলের দাবি নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন এবং বলেন, কেন আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, সরকার কীভাবে বিরোধী দলের দাবি নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে—তা জনগণকে বোঝাতে হবে। মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদেরকেও জনগণের কাছে যেতে হবে।
(দৈনিক ইনকিলাব : ৩০ ডিসেম্বর শনিবার, ১৯৯৫)
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির অভিন্ন কর্মসূচি হিসেবে ’৯৪, ’৯৫ ও ’৯৬ সালে ডাকা হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগের কিছু চিত্র :
১৯৯৪ সাল
২৬ এপ্রিল হরতাল, ১০ সেপ্টেম্বর অবরোধ, ১১, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর হরতাল, ২৭ সেপ্টেম্বর অবরোধ, ৩০ নভেম্বর অবরোধ, ৭ ও ৮ ডিসেম্বর হরতাল, ২৪ ডিসেম্বর অবরোধ, ২৯ ডিসেম্বর অবরোধ।
১৯৯৫ সাল
২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি হরতাল, ১৯ জানুয়ারি অবরোধ, ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি হরতাল, ১২ ও ১৩ মার্চ লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল, ২৮ মার্চ ঢাকা অবরোধ, ৯ এপ্রিল ৫ বিভাগে হরতাল, ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর লাগাতার ৩২ ঘণ্টা হরতাল, ৬ সেপ্টেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ১৬, ১৭, ১৮ সেপ্টেম্বর লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতাল, ৭ এবং ৮ অক্টোবর পাঁচ বিভাগে লাগাতার ৩২ ঘণ্টা হরতাল, ১৬, ১৭, ১৮ এবং ১৯ অক্টোবর লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল, ৬ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ এবং ১৬ নভেম্বর প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ৯, ১০ এবং ১১ ডিসেম্বর লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতাল, ১৭ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ৩০ ডিসেম্বর দেশব্যাপী অবরোধ।
১৯৯৬ সাল
৩ ও ৪ জানুয়ারি লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল, ৮ ও ৯ জানুয়ারি লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল, ১৭ জানুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ২৪ জানুয়ারি সিলেটে ১১ ঘণ্টা হরতাল, ২৭ জানুয়ারি খুলনায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ২৮ জানুয়ারি খুলনায় অর্ধদিবস হরতাল, ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল, ১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হরতাল, ৩ ফেব্রুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল, ৭ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত হরতাল, ৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে হরতাল, ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে হরতাল, ১১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে হরতাল, ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ, ১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল, ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি লাগাতার অসহযোগ, ৯ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত লাগাতার ২২ দিন অসহযোগ।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন