শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪


মুসলিমদের উদ্বেগ ও আশাবাদ আদনান মনোয়ার হুসাইন প্রকাশ : ১৪ মার্চ, ২০১৪ ০০:০০:০০ অন্তঃসারশূন্য আশ্বাস নয়, সত্যিকার অর্থেই তাদের জন্য কিছু করার রয়েছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের ফায়দা হাসিলের তালে থাকার মধ্যে মুসলমানরা নিজেদের কোণঠাসা মনে করছেন। গোটা ভারতে এ সম্প্রদায়ের একই অবস্থা
ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ মুসলমান। রাজ্যগুলোর মধ্যে একমাত্র জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, অল্প্রব্দপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, কেরালা ও বিহারে বিপুলসংখ্যক মুসলমান রয়েছে। লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে অন্তত ৪৬টির ভোটারদের ৩০ শতাংশের বেশি মুসলমান। অন্তত ১১০টি আসনে মুসলমান ভোটাররা বড় রকম প্রভাব রাখতে পারবেন বলে মনে করা হয়। ফলে তারা বিপুলভাবে কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়লে ভারতের জটিল রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নাটকীয়ভাবে পাল্টে যেতে পারে। লোকসভায় বর্তমানে মাত্র ৩০ জন মুসলমান এমপি আছেন। গোটা হাউসের হিসাবে যা মাত্র ৬ শতাংশ। কোনো দলই মুসলমানদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে যথাযথ উদ্যোগী হয়নি। ২০০৯ সালের বিগত লোকসভা নির্বাচনে অন্তত ২০টি রাজ্য থেকে একজন মুসলমানও এমপি নির্বাচিত হননি। ওই নির্বাচনে ৮৩২ জন মুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আরশি খানের মতে, 'শুধু নিরাপত্তা, স্বাধীনতা বা ভালোমন্দ নয়, মুসলমানদের মনে এমন ধারণাও আছে যে, তাদের খোদ পরিচয়ই হুমকির মুখে।' তার বলেন, 'ক্ষমতার ভাগাভাগির পদ্ধতিতেই ঘাটতি রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে এমন দ্বিধাগ্রস্ততা রয়েছে যে, তারা কাকে ভোট দেবেন, কারণ তাদের ভোট আসলেই কোনো বিষয় নয়। আমার শিক্ষার্থীরা অনেক সময়ই কাকতালীয় কিছুর জন্য প্রার্থনা করে বলে আমার মনে হয়।' ভারতের মুসলমানরা এখনও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে। ২০০৬ সালে সাচার কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ মুসলমান শিশু হয় বিদ্যালয়েই যায় না, নয়তো ঝরে পড়ে। ভারতের মোট স্নাতক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মুসলমান। মাত্র ১৩ মুসলমান শ্রমজীবীর নিয়মিত কর্মসংস্থান রয়েছে। আমলাতন্ত্রে মুসলমানদের উপস্থিতি মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৭ সালের রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান যেসব বাড়িতে বাস করেন তাতে পানি ও টয়লেটের যথাযথ সুবিধা নেই। এসব প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, ভারতের মুসলমানদের বিষয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্তঃসারশূন্য আশ্বাস নয়, সত্যিকার অর্থেই তাদের জন্য কিছু করার রয়েছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের ফায়দা হাসিলের তালে থাকার মধ্যে মুসলমানরা নিজেদের কোণঠাসা মনে করছেন। গোটা ভারতে এ সম্প্রদায়ের একই অবস্থা। মুসলমানদের সংগঠনগুলোর ভাবধারায় রয়েছে পার্থক্য। দিলি্লভিত্তিক তাবলিগ জামাত মনে করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার উপায় হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ও ইসলামী মতবাদগুলোর প্রতি উপেক্ষার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ধর্মীয় পুনরুত্থান। অন্যদিকে, প্রাগ্রসর মুসলমান চিন্তকরা মনে করেন, পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে মুসলমানদের প্রয়োজন শিক্ষা ও সমাজের সঙ্গে একীভূত হওয়া। কেউ কেউ আবার উগ্রবাদিতাকে প্রশ্রয় দেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর শুরু হওয়া 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ভারতের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিশেষত মুসলমানরা এতে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পরের বছরের গুজরাট দাঙ্গায় নিহত হন হাজারো মুসলমান। চারদিকে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টির কারণে বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করেন ভারতীয় মুসলমানরা। এখন মিডিয়াও সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী হিসেবে মুসলমানদের যেভাবে তুলে ধরছে, তাতেও আহত হওয়ার অনেক কিছু আছে। এসব কারণে হিন্দু-মুসলমান দূরত্ব বাড়ছে, ফলে রাষ্ট্র-মুসলমান দূরত্বও সৃষ্টি হচ্ছে। মুজাফফরনগরের দাঙ্গা ও গুজরাটের বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়াতে অনেক মুসলমানই পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখতে পান। বিহারের একজন সরকারি চাকরিজীবী বললেন, 'মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কোনো উগ্র ইসলামপন্থি ক্ষমতাসীন হওয়ার পথে থাকলে সংখ্যালঘুরা যেমন অনুভব করে, মোদির পক্ষে ভারতে ব্যাপক সাড়া দেখে আমরাও তেমনটি অনুভব করছি।' গুজরাটের গোধরার একজন মুসলমান বাসিন্দা জানান তার হতাশার কথা। নরেন্দ্র মোদি প্রশ্নে তিনি বলেন, 'মুসলমানদের সামনে কম মন্দ ও বেশি মন্দের মধ্যে কাউকে বেছে নেওয়ার বিকল্পই থাকে। কংগ্রেসও আমাদের সত্যিকার উন্নয়নের জন্য কিছু করেনি। বরং ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছে।' এই ভোটব্যাংক ভাঙতে অনেক মুসলমানই মনে করেন ভোটের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ফার্স্টপাস্ট দ্য পোস্ট (বেশির ভোট প্রাপকই বিজয়ী) ভোটিং পদ্ধতি বাতিল করে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু করতে হবে। এ দাবির পক্ষে তাদের যুক্তিও আছে। আসামে ৩০.৯ শতাংশ মুসলমান ভোটার থাকার পরও ১৪ এমপির মধ্যে মাত্র দু'জন মুসলমান। উত্তর প্রদেশে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ মুসলিম ভোটার অথচ ৮০ এমপির মাত্র ৭ জন মুসলমান। কর্ণাটকে ১২.২৩ শতাংশ মুসলমান ভোটার থাকার পরও রাজ্যে একজনও মুসলিম এমপি নেই। ২০০৯ সালে ৩৬ শতাংশ মুসলমান ভোট দিয়েছিলেন কংগ্রেসকে। মাত্র ৩ শতাংশ দিয়েছিলেন বিজেপিকে। ভাগ্যের পরিবর্তন তবু কিছু হয়নি। ভোট কাজে লাগে না এমন অনুভূতিও তরুণ মুসলমান ভোটারদের মধ্যে প্রবল। অনেকেই বলছেন অহেতুক তারা ভোট দিতে যাবেন না। আবার কালবে সাদিকের মতো অনেক মুসলমান চিন্তক মনে করেন, ভোট না দিলে গোটা প্রক্রিয়া এমনকি সমাজ থেকেও আলাদা হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাদের মতে, মুসলমানদের ভারতের মূল স্রোতধারায় মিশে যাওয়ার জন্য লড়তে হবে। মূলধারায় একীভূত না হওয়া পর্যন্ত মুসলমানদের ভাগ্য উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। চিন্তাশীল মুসলমানরা মনে করেন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সব দিক দিয়ে উন্নয়নই কেবল এ সম্প্রদায়ের দুর্দশা ঠেকাতে পারে। আধুনিক, উন্নত ও শক্তিশালী ভারতের জন্যও তার সব সম্প্রদায়ের সমানতালে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। সূত্র :ইন্ডিয়া টুডে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন