যাদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হবে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল
উবায়দুর রহমান খান নদভী : নিজ দরবারে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ১২৪তম মাহফিলের শেষ দিনে ছারছিনার পীর সাহেব বলেছেন, ব্যক্তি জীবনে ঈমান-আমল ঠিক করা এবং সুন্নত পালন ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম কায়েম সম্ভব নয়। চরমোনাইয়ের পীর সাহেব তার প্রধান মাহফিলের বয়ানে বলেছেন, ঈমান-আমল শুদ্ধ করে সুন্নত অনুযায়ী জীবনযাপন করলে মানুষ ইসলামী সমাজব্যবস্থার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। ভেবেচিন্তে সমর্থন দিলে রাষ্ট্রক্ষমতায়ও ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের কোনো পীর-মাশায়েখ এমন নেই, যিনি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন। এমন কোনো আলেম নেই যিনি শরিয়তের আলোকে ব্যক্তি পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বের কথা বলেন না। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি আলহাজ এএমএম বাহাউদ্দীনের একটি উক্তি গত ক’বছর ধরে বাংলাদেশের ইসলামী অঙ্গনে সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, ইসলাম প্রচারকর্মী ও ধর্মপ্রাণ তরুণ প্রজন্মের কাছে এ উক্তিটিই এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও আকর্ষণীয়। তিনি বলেছিলেন, আগামী ২৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্র। জমিয়াতের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা কবি রূহুল আমীন খান দেশের সকল তরিকার পীর-মাশায়েখের আহ্বানে সারাদেশ ছুটে বেড়ান। তার দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত ঐক্য ও সংহতির বাণী দেশের ধর্মীয় অঙ্গনে বৃহত্তর ঐক্যের অনন্য বাতাবরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও ধর্মবিদ্বেষী নানা চক্র সক্রিয় রয়েছে ধর্মহীন বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে। কিছু লোক এমনও আছে যারা বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় চেতনা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু তাদের এ স্বপ্ন কখনই পূরণ হওয়ার নয়। কেননা, শুরু থেকেই বাংলাদেশ ইসলামের জন্য নির্ধারিত। এ ভূখ-ের ভাগ্য ইসলামের সাথে যুক্ত। তা ছাড়া, এ দেশটি সৌভাগ্যক্রমে সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছে। মুসলিম শাসন এখানে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে কায়েম হলেও ইসলামী সমাজ সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থার সূচনা এখানে ইসলামের সূচনাকাল থেকেই হয়েছে। এখানে নানা তরিকার লক্ষ পীর-আউলিয়া, বিভিন্ন ধারার লক্ষ মাদরাসা, দাওয়াতি কার্যক্রমের বিশ্ব ইজতেমা, আন্তর্জাতিকমানের হাফেজ, আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, কোটি কোটি নবীপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ আবাল-বৃদ্ধ বণিতা, অসংখ্য-অগণিত ইসলামপ্রিয় জনতা, অসাধারণ অধিক মসজিদ-মাদরাসা, দরবার-খানাকাহ সুন্নতের নজিরবিহীন বিস্তার ও চর্চা কি বলে দেয় না যে, বাংলাদেশ কোনদিকে যাবে?
আগেই বলেছি যে, খোদায়ী সাম্রাজ্যের অলিখিত বিধান, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক ইশারা এ সত্যটি প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে মহানবী (সা.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছেন কিংবা খোলাফায়ে রাশেদীনের হাতে যেসব ভূখ- বিজিত হয়েছে, সে সব জায়গা থেকে ইসলাম কোনোদিন বিদায় নেয়নি। এসব অঞ্চলের মুসলমান বিপদে পড়েছে ঠিকই; কিন্তু নিশ্চিহ্ন বা বিপর্যস্ত হয়নি। আলহামদু লিল্লাহ, আমাদের বাংলাদেশও সাহাবায়ে কেরামের পদধূলিতে ধন্য। ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের পর যে কোনো এক সময় অন্তত পাঁচজন সাহাবি এ দেশের উপকূলে নৌযান নোঙর করেছিলেন। তখনও পর্যন্ত আমাদের প্রাণের নবী হজরত (সা.) মদিনায় হিজরত করেননি। হিজরত সংঘটিত হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। এসব সাহাবির মধ্যে দু’জনের কবর চীনের ক্যান্টনে সাহাবি মসজিদের চত্বরে। বাকি তিনজনও প্রাচ্যের কোথাও সমাহিত।
ইসলামের প্রথম যুগে, নবুওয়তি কার্যক্রমের সদ্য সূচনায় ইসলামগ্রহণকারী সাহাবি দল বাংলায় আগমন করায় এ দেশের ইসলামী সমাজের বয়স প্রায় ইসলামের সমান। আরব থেকে দূরের হলেও এ দেশের ইসলামী বিশ্বাস ও চেতনা পবিত্র মক্কা-মদিনার মানুষের তুলনায় খুব বেশি ছোট নয়।
ইসলাম চর্চা খুব আগে শুরু হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ বর্তমান দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা উর্বর ইসলামী সম্ভাবনার দেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ সীমিত ভূখ- পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মুসলিম অধিবাস। একই ভাষায় কথা বলা, অভিন্ন জাতিসত্তার এত বড় মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বের আর কোথাও নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঈমান, আমল ও আখলাকের অনুসারী মানুষ এ দেশে বাস করে। হয়ত অনেক ত্রুটি ও অপূর্ণতা তাদের আছে, আছে ব্যর্থতা, আছে বদনাম, কিন্তু ইতিবাচক অসংখ্য দিকও এমন আছে যা- সারা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাহাবিদের বরকত দিয়ে শুরু হয়ে লাখো ওলি-আউলিয়া, পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরামের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অনন্য সাধনার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সেরা মুসলিম জনবসতি। এত মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব, হেফজখানা, ইসলামী প্রকাশনা, সংগঠন, দরবার, খানকাহ, হাফেজ, আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, ওয়ায়েজ, ইমাম, খতিব ও ইসলামী চিন্তাবিদ দুনিয়ার আর কোথাও নেই। এ গৌরব বাংলাদেশের, এ গৌরব বাংলাদেশের মানুষের।
অতি অল্পসংখ্যক ধর্মবিদ্বেষী লোকছাড়া এ দেশের সকল দল, শ্রেণী-পেশা ও পর্যায়ের মানুষই ধর্মপ্রাণ। হাতে গোনা কিছু ‘নাস্তিক’ খুব নগণ্য সংখ্যক ধর্মত্যাগী ‘মুরতাদ’ ও ইসলামবিরোধী বিশ্বচক্রের মুষ্টিমেয় ‘দালাল’ ছাড়া বাংলাদেশের সকল মানুষ ধর্মের প্রতি আন্তরিক। এর শত শত প্রমাণ ভরদুপুরে মধ্যগগনে তেজোদ্দীপ্ত সূর্যের মতোই স্পষ্ট। যারা চিন্তা করেন, যাদের চোখ খোলা আছে, তারা খুব সহজেই উপলব্ধি করেন বাংলাদেশের মানুষের ধর্মপ্রিয়তা। তাদের নীতি-নিষ্ঠা, ভক্তি ও প্রেম। তাদের মূল্যবোধ ও মানবিকতা। বয়স ও সময়ের বিবর্তনে এ দেশে কেউই তার শেষ জীবনে ধার্মিক না হয়ে পারে না।
শুরু থেকেই এ দেশবাসীর মনন তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন এ দেশের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ওয়াজ, উপদেশ ও মায়ামমতাপূর্ণ আচরণের পথ ধরে তারা বাংলাদেশের মানুষকে জড়িয়ে রাখেন। দেড় হাজার বছর যাবৎ এ দেশের মানুষের দুঃখে-সুখে, আনন্দ-বেদনায় যেমন ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে লক্ষ কোটি ওলি-আউলিয়া, পীর-মাশায়েখ-গাউস, কুতুব, আলেম, ওলামা, ওস্তাদ ও মুরব্বি। যাদের মমতার বন্ধনে এ দেশ আবদ্ধ। আবদ্ধ এর প্রকৃতি প্রাণ ও পরিবেশ। খোদায়ী বিধানের মায়ার বাঁধনে যুক্ত যাদের জীবন মহান রাসূলের (সা.) অশেষ মহব্বত, দয়া, মায়া, কৃপা ও করুণার প্রীতিডোরে বাঁধা পড়ে আছে চিরজনমের মতো। আল্লাহর ওলিদের ভালোবাসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কোরআন ও সুন্নাহর টানে ঐক্যবদ্ধ। শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফতের সুতায় তারা পরস্পরে সংযুক্ত। ইসলাম তাদের স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে, স্বাধীনতা ও সম্মান দিয়েছে। উন্নত সভ্যতা, পবিত্র সংস্কৃতি ও অনন্য সম্প্রীতি সবই তাদের প্রতি মহান রাসূলের (সা.) সুন্নতের দান।
স্বভাবত কোমল, প্রয়োজনে কঠোর, মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত এ দেশবাসী শত বাধা উপেক্ষা করেও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান আদর্শ জাতি। শান্তিপ্রিয় উন্নত জাতির এ ভূখ-টিই আগামী দিনের বিশ্বসভ্যতার গতিপথ নির্দেশ করতে তৈরি হচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্বের বুকে আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রের রোল মডেলরূপে। দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে কেবল বিগত দু’তিন মাসে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, পাড়ায়-মহল্লায় অনুষ্ঠিত লক্ষ লক্ষ ছোট বড় দ্বীনী মাহফিলের কথাই ভেবে দেখুন। সাড়ে চার লাখ জামে মসজিদ, পাঞ্জেগানা মসজিদ, নামাজকক্ষ ও ইবাদতখানায় তো প্রতি মুহূর্তে ধর্মচর্চা চলছেই, পাশাপাশি হাজার হাজার মাদরাসা, মসজিদ, মারকাজ, মক্তব, তালিমগৃহ, খানকাহ, দরবার ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নানা উপায়ে মানুষকে কোরআন-সুন্নাহর বাণীর সাথে পরিচিত করানোর কাজ রাতদিনই চলছে। বিচ্ছিন্নভাবে রীতিমতো দ্বীন চর্চার চেয়ে বড় পরিসরে ধর্মীয় ভাবধারার অনুশীলন ও চর্চার কাজটি যুগ যুগ ধরে আঞ্জাম দিচ্ছে দেশের বড় বড় দরবারগুলো। যেমন, আজ সমাপ্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন ও প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নির্দেশনাকেন্দ্র ছারছিনার ঐতিহাসিক মাহফিল। ক’দিন আগে শেষ হলো কীর্তনখোলার তীরে ঐতিহ্যবাহী চরমোনাইয়ের বিশাল মাহফিল। একই ধারার রীতিতে সুশিক্ষিত, সমচিন্তা ও সংহত আমল-আখলাকের অধিকারী মুরিদ ও শুভানুধ্যায়ীদের এত বড় সমাবেশ আর কোথাও হয় কি না সন্দেহ। আগে-পরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দেশের ঐতিহ্যবাহী নানা ধারার অনেক আধ্যাত্মিক কেন্দ্রভূমির সালানা মাহফিল। কাদেরিয়া তরিকাসহ প্রসিদ্ধ চার তরিকার সূত্র থেকে আলোকপ্রাপ্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেটসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলের সকল পীর-মাশায়েখ ও ওলামায়ে কেরাম গত তিন মাসের মধ্যে তাদের কোটি কোটি ভক্তের সাথে নিয়মিত গণসংযোগ সম্পন্ন করেছেন। এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে যেমন, মৌকারার মাহফিল, সোনাকান্দার মাহফিল, ফান্দাউকের মাহফিল, নেছারাবাদের মাহফিল, ফুলতলীর মাহফিল, ফুরফুরার মাহফিল, মানিকগঞ্জের পীর সাহেবের মাহফিল, কাগতিয়ার মাহফিল, চট্টগ্রামের বিভিন্ন তরিকার অসংখ্য মাহফিল- কোনটির চেয়ে কোনটির লোকসংখ্যা কম হবে? বর্ণিত এসব বিখ্যাত মাহফিলে ১০ থেকে ৬০ লাখ পর্যন্ত মানুষ যোগদান করে থাকেন। এ ছাড়াও দেশের নানা জায়গায় দরস, তাফসির, কনফারেন্স, ইজতেমা, ইসলাহী জোড়, তাবলিগী জোড়, শানে রিসালত সম্মেলন, মাদরাসা বা সংস্থার বার্ষিক সম্মেলন নামে যে অসংখ্য অনুষ্ঠান হয় এসবের প্রতিটিতেই তিন হাজার থেকে তিন লাখ পর্যন্ত লোক যেমন সমাগম হয়, পাঁচ লাখ থেকে পঞ্চাশ লাখও হয়। উত্তরবঙ্গের বড় বড় শহর, মাদারীপুরের শিবচর ও রাজধানীর কোনো কোনো স্থানে দাওয়াতুল হকের প্রতিটি ওলামা সমাবেশে এ বছর গড়ে পঞ্চাশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ আলেম ও পীর-মাশায়েখ সমবেত হয়েছেন। ছারছিনা, ফুরফুরা, চরমোনাইসহ অন্যান্য বিখ্যাত দরবারের ছোট-বড় সব মাহফিল মিলিয়ে কয়েক কোটি লোকের সমাবেশ তারা করেছেন। নানা তরিকা ও ঘরানার মাহফিল মিলিয়ে বাংলাদেশের পীর-মাশায়েখ, আলেম ও মুবাল্লিগরা মাত্র দু’তিন মাসে অন্তত ৬ কোটি নাগরিকের সাথে সরাসরি ভাব ও ভাবনা বিনিময় করেছেন। পুরুষ ও শিশু-কিশোরদের মাধ্যমে এসব সংযোগ ও বিনিময়ের প্রভাব সংশ্লিষ্ট নারীমহলেও পড়েছে। এ হিসাবে ধর্মীয় বিষয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং প্রগাঢ় নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার এ কর্মচাঞ্চল্যে ১০/১২ কোটি মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছেন। এত বড় গণসংযোগ এদেশের আর কোনো সেক্টরে এতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনোদিনই সম্ভবপর নয়। কারণ, আধ্যাত্মিক চেতনা ও ঈমানী প্রেরণার তাগিদ থেকেই মানুষ প্রবল ধর্মীয় আবেগ নিয়ে এসব কর্মচাঞ্চল্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। নিজের জানমাল ও সময় সৎপথে ব্যয় করার উদ্দীপনা তাদের শক্তি জোগায়। কোরআন সুন্নাহ, দ্বীন ও শরিয়ত, আল্লাহ রাসূল (সা.)-এর মহব্বত, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও দ্বীনের সেবায় নিয়োজিত ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি ও ভালোবাসা তাদের উজ্জীবিত করে।
আপনি দেশের যে কোনো পীর-মাশায়েখ ও দরবারের কথাই ভাবুন না কেন, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন তারা মূলত প্রধান চার তরিকার অনুসারী। কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশেবন্দীয়া ও মোজাদ্দেদীয়া ঐতিহ্য মানেন না এমন কেউই এ দেশের পীর হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পান না। তা ছাড়া, উপমহাদেশে নিকট অতীতে সব তরিকার সুষম প্রতিনিধিত্বকারী দেহলভী খান্দানের সাথে সব ঘরানাই চিন্তাগতসূত্রে আবদ্ধ। স্বীকৃত কিছু পার্থক্য বা বৈচিত্র্য ছাড়া চার তরিকা বা এ থেকে উদ্ভূত প্রশাখাগত সিলসিলার ক্ষেত্রে বড় কোনো বৈপরীত্য নেই। তবে প্রকৃত ইলম ও সুন্নতের ভিত্তির ওপর রচিত ধারাসমূহ যখনই অতীত মুরব্বিগণের বিশুদ্ধ আকিদা, নিখুঁত ইলম, তাকওয়া, নির্মোহ অন্তকরণ, ত্যাগ ও সাধনার কঠিন পথ থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়, তখন সিলসিলার প্রাণশক্তি বিলুপ্ত হতে থাকে। মারেফতের নূর কমতে শুরু করে এবং বেলায়েত, কারামাত ও কবুলিয়্যত সলব কিংবা মুন্তাকিল হয়ে যায়। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের সকল ঘরানার ওলামা-মাশায়েখ অতীত ঐতিহ্যের মূলধারা দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে থাকবেন। ইলম ও মারেফাতের পথে দুনিয়া যেন বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। রুশ্দ ও হেদায়েতের পথে খাসায়েলে রাজিলা যেন বাদ না সাধে। তাওহিদ ও রিসালতের উজ্জ্বল আকাশে যেন শিরক ও বিদ’আতের কুয়াশা না জমতে পারে। নিজেদের মধ্যকার যে কোনো বিরোধ ‘দ্বীন হচ্ছে শুভকামনার অপর নাম’-এ নীতির ভিত্তিতে পারস্পরিক মিল মহব্বতের পথ ধরে মিটিয়ে ফেলতে হবে, যদি যৌক্তিক কারণে তা সম্ভব না হয় তাহলে সংলাপ ও মুক্তমনা বিতর্কের মাধ্যমে তা সহনীয় পর্যায়ে আনা চাই। সম্ভব হলে পুরনো বিরোধ নিঃশেষে মিটিয়ে ফেলা চাই। মতবৈচিত্র্য ও বর্ণিল কর্মপদ্ধতির মধ্যেই মৌলিক ইস্যুতে ঐক্য গড়তে হবে। কেননা পার্থিব জীবন একটাই। বাংলাদেশকে ভালোবাসলে নবী করিম (সা.)-এর উত্তরসূরী ওলামা-মাশায়েখকে বিভ্রান্ত, পথহারা মানুষদের প্রীতিময় অন্তর নিয়ে আল্লাহর পথে টানতে হবে। দ্বীনী ভাই-বোনদের সম্মান ও স্নেহের সাথে ঐক্যের বিস্তীর্ণ ভুবনে ধরে রাখতে হবে। রাজনৈতিক বা সামাজিক বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতার ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সকল সৃষ্টিকে কল্যাণের দিশা দিতে হবে। নবী করিম (সা.)-এর সম্মানে নিবেদিত এ বাংলাদেশের মানুষকে দেখতে হবে সাহাবায়ে কেরামের মমতাময় চোখের আলোয়। দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ভালোবাসতে হবে অতীতযুগের আউলিয়ায়ে কেরামের মতো অন্তকরণ দিয়ে। যারা বুঝবেন না, তাদের হেদায়েত ও বোধোদয়ের জন্য থাকতে হবে শুভাশিষপূর্ণ দীর্ঘপ্রতীক্ষা। যারা একমত হবেন তাদের জন্যে উৎসর্গ করতে হবে নিজেদের সবটুকু ভবিষ্যৎ। বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি শুভকামনা নিয়ে, যেভাবে জীবন উৎসর্গ করেছেন সাহাবায়ে কেরাম। পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করতে হবে। পথহারা মানুষটিকে ভাবতে হবে নিজের অসুস্থ সন্তান ও ভাইয়ের মতো। চিকিৎসকের মমতায় সারিয়ে তুলতে হবে অপরাধ, দুর্নীতি, পাপাচার ও অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়া মানুষটিকে। একটি একটি করে ফুল ফোটাতে হবে, সাজাতে হবে মহানবীর (সা.) রক্ত ও অশ্রুসিক্ত উম্মতের বাগান। আগামী দিনে মানব সভ্যতার আশা-ভরসার স্থল বাংলাদেশকে সব পীর-আউলিয়া, ওলামা-মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ নাগরিক মিলে পরিণত করতে হবে এই গ্রহের সকল মানুষের অনুসরণীয় আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রে।
*
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন